বাংলাদেশের ইলিশের নামে নিশ্চয় জিভ থেকে জল পড়ে। সেই মাছগুলো কি তারা পা নেড়ে নেড়ে সাঁতার কাটে? তারা বাসি মাছ নয়? কেজি কেজি বরফ দিয়ে রাখা মাছ নয়? কত মাসের আগের মরা, তার কোনও ঠিক আছে? সেই মাছ বারোশো টাকা কেজি দরে কিনিস না? বিদেশের মরা ইলিশ ভাল। আর স্বদেশের মরা জন্তু ভাল নয়? এ কেমন জাতীয়তাবিরোধী মনোভাব! লিখেছেন রবি কর।
ঢঙ দেখে পিত্তি জ্বলে যায় মাইরি। ভাড়ের মাংস, ভাগাড়ের মাংস করে এমন শুরু করেছে, যেন এতকাল গঙ্গাজলে তুলসীপাতা সেদ্ধ করে তাই খেয়ে জীবনধারন করছিল। বলি হ্যাঁ রে ভাল মানুষের বাচ্চারা, পশুর মাংস মরা খাবি না তো কি জ্যান্ত খাবি? তোরা কি কথামালার গল্পের সেই ভালুক যে মরা প্রাণী খাস না? নাকি উপেন্দ্রকিশোরের গল্পের নাককাটা রাজা যে টুনটুনিকে জ্যান্ত গিলে খাস?
এই যে বাজার থেকে রোজ রোজ মাছ কিনে আনিস, সেগুলো কি জ্যান্ত খাস? হ্যাঁ, জানি, এর উত্তরে তোরা বলবি, মাছ তো আর বাসি নয়। যেদিন মারি, সেদিন খাই। এটা কতবড় ভুল কথা, খালি ভেবে দেখ। একবিংশ শতাব্দীর বাঙালি বাচ্চারা তো কাঁটা বেছে খেতে পারে না। প্রিয় মাছ হল কাটা পোনা। সেই মাছ তো আসে অন্ধ্র থেকে। অন্ধ্র থেকে মরা মাছ এলে খেতে দোষ নেই। আর বজবজ থেকে মাংস এলে দোষ?
কী বললি? তুই কাঁটা বেছে মাছ খেতে পারিস? অন্ধ্রের মাছ খাস না? এইসব যুক্তি দেখাতে গিয়ে কিন্তু নিজের জালে নিজেই জড়িয়ে যাচ্ছিস। কাঁটা বেছে যখন খেতে পারিস, তখন নিশ্চয় ইলিশ মাছ খাস। বাংলাদেশের ইলিশের নামে নিশ্চয় জিভ থেকে জল পড়ে। তা, সেই মাছগুলো যখন বাজারে আসে, তখন কি তারা পা নেড়ে নেড়ে সাঁতার কাটে? তারা বাসি মাছ নয়? মরে শক্ত হয়ে যাওয়া, চোখ লাল হয়ে যাওয়া, কেজি কেজি বরফ দিয়ে রাখা মাছ নয়? কত মাসের আগের মরা, তার কোনও ঠিক আছে? সেই মাছ বারোশো টাকা কেজি দরে কিনিস না? বিদেশের মরা ইলিশ ভাল। আর স্বদেশের মরা জন্তু ভাল নয়? এ কেমন জাতীয়তাবিরোধী মনোভাব!
কী বললি, পচা? ভাগাড়ের মাংস পচা? আর মাছগুলো মরা হলেও পচা নয়? তাই ভাগাড়ের মাংস পছন্দ নয়? দেখ বাঙালি, শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না। তেমনি ভাগাড়ের মাংসও ঢাকা যায় না। পচা জিনিস তোরা খাস না? শুঁটকি মাছ তোরা খাস না? শুঁটকির পচা পচা গন্ধ নাকে গেলে তোদের অমৃত বলে মনে হয় না? রান্না করলে আগুনের তাপে যদি শুঁটকির জীবাণু মরে যায়, তাহলে ভাগাড়ের মাংস রান্না করলে তার জীবাণু মরবে না কেন? যদি মনে করিস, সূর্যের চড়া রোদে শুকিয়ে শুঁটকি খাওয়ার উপযুক্ত হয়ে ওঠে, তাহলে ভাগাড় থেকে মাংস কিনে, ছাদে দড়ি টাঙিয়ে শুকোতে দে। মাস খানের পরে দিব্যি খাওয়া যাবে।
আবার কী বিড়বিড় করছিস? নিশ্চয় নতুন কোনও যুক্তি। মানে, কুযুক্তি। কী? ভাগাড়ে খেলা প্রাণীগুলোর দেহে রোগের জীবাণু থাকতে পারে? তা, বাজার থেকে কেনা মাংসে জীবাণু থাকতে পারে না? মুরগির বার্ড ফ্লু আছে কিনা, ছাগলের অ্যানথ্রাক্স আছে কিনা, এগুলো জানার জন্য ব্লাড টেস্ট করিয়ে, রিপোর্ট হাতে নিয়ে তবে মাংস কিনিস বুঝি!
আসলে, বুঝতে পারছি। ভাগাড় শব্দটাতেই তোদের আপত্তি আছে। ভাবছিস, ভাগাড় জায়গাটা খুব নোঙরা, অস্বাস্থ্যকর। তাহলে সেটাই মুখ ফুটে বল। বিশ্বনাথকে বলছি, তোর বাড়িতেই মরা জন্তু ফেলে আসুক। প্রাণ ভরে খা। আরে লজ্জা কীসের, স্বয়ং মহর্ষী বিশ্বামিত্র মরা কুকুরের নাড়িভুড়ি খেয়েছিল। বিশ্বাস না হলে নৃসিংহবাবুকে জিজ্ঞেস করে দেখ। জয় শ্রীরাম, জয় শ্রী রাম বলে স্লোগান তুলবি, আর রামচন্দ্রের গুরু বিশ্বামিত্রর খাবার চেখে দেখবি না, তা তো হয় না।
একটু যদি মন দিয়ে ভেবে দেখিস, তাহলেই বুঝবি, ভাগাড়ের মাংস সরবরাহ কতবড় পুন্যের কাজ। এই যে সেকু–মাকুরা এতকাল ধরে প্রচার করল, সবাই সবকিছু খাবে, কোনও বাছবিচার নেই, কোনও লাভ হল? যেদিন ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে বিফ খেল, কজন লোক হল? মেরেকেটে দশজন। এখন দেখ মজা। বুকে হাত রেখে কজন বলতে পারবে আমি বিফ খাইনি? জোর গলায় কজন বলতে পারবে, আমি পর্ক খাইনি। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এতবড় উদাহরণ কোথায় পাবি করে! এই যে বিশ্বনাথ আর সওকত কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে একটা ব্যবসা চালাচ্ছিল, এর থেকে বড় ধর্ম নিরপেক্ষতা আর কী হতে পারে? কবিগুরুর ভাষায় বলতে পারি, ‘পর্ক বিফ প্রন চিকেন মটন/এক দেহে হল লীন।’
ভাগাড় কাণ্ডে সবার লাভ বুঝলি, সবার লাভ। রামভক্তদের লাভ। সেকুলারদের লাভ। যারা গরু পাচার করে, তাদেরও লাভ। কারণ, কিছুদিন পরেই মানুষ বুঝবে, গরু পাচার বন্ধ হওয়াই ভাগাড় কাণ্ডের মূল কারণ। গরু পাচার হলে সেই গরুর মাংস বাংলাদেশীরা খায়। পাচার না হলে ভারতের গরু ভারতেই মরে। আর ভায়া ভাগাড় ভারতবাসীর পাতেই আসে।
আর লাভ ভাষাতত্ত্ববিদদের। তারা এতকাল উপান্ন শব্দের মানে বুঝতে পারছিল না। আমি বুঝিয়ে দিচ্ছি। উপান্ন মানে হল অন্য অন্ন। মানে, অন্য রকমের খাবার। অর্থাৎ সাইড ডিস। সেই সাইড ডিসটা কী, নিশ্চয় তোরা বুঝতে পারছিস। যাহা আহারে বাংলা, তাহাই ভাগাড়ে বাংলা।
*****
(বিধিসম্মত সতর্কীকরণ: এটিকে নিছক রম্যরচনা হিসেবেই দেখুন। আক্ষরিক মানে না বুঝে অন্যরকম মানে খোঁজার চেষ্টা করুন। )