অভীক মজুমদার
বেঙ্গল টাইমসে বেড়ানোর নানারকম কাহিনী পড়ি। বেশ লাগে। আমার নিজের একটা বেড়ানোর গল্প শেয়ার করতে ইচ্ছে করছে।
বছর তিনেক আগেকার ঘটনা। দার্জিলিংয়ে গিয়েছিলাম। ঠিক ভাল লাগছিল না। তিনজনের টিম। দুদিনেই অনেকটা ঘোরা হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল, এবার অন্য কোথাও গেলে কেমন হয়। হাতে তখনও তিনদিন। কারণ, তিনদিন বাদে ফেরার টিকিট। এই তিনদিনে কোথাও একটা যাওয়াই যায়।
দুই বন্ধু একমত হলাম, কার্শিয়াংয়ের কাছে ডাউহিলে গেলে কেমন হয়! জায়গাটা দারুণ, কিন্তু থাকার জায়গার অভাব। একটা ফরেস্টের বাংলো আছে। কিন্তু বুকিংয়ের হাজার ঝামেলা। ডিএফও–কে ফ্যাক্স করতে হবে। তারপর কবে তার রিপ্লাই আসবে, কে জানে! উত্তর ইতিবাচক হওয়ার সম্ভাবনাও কম।
হঠাৎ, চোখে পড়ল দার্জিলিং ডিএফও–র অফিস। সাহস করে ঢুকেই পড়লাম। নিজেদের ইচ্ছের কথা জানালাম। উনি বললেন, এটা তো আমার কিছু করার নেই। ওটা কার্শিয়াং ডিএফও–র আন্ডারে পড়ছে।
তাঁকে বললাম, অতশত জানি না। আপনিই কিছু একটা ব্যবস্থা করে দিন। আমরা চেষ্টা করলে হবে না, এটুকু জানি। আপনি চেষ্টা করলে হতেও পারে। একটু চেষ্টা করে দেখুন না।
উনি বললেন, কাল আসুন। আমি দেখে রাখব। যথারীতি পরের দিন গেলাম তাঁর দপ্তরে। বললেন, ‘ওখানে এখন মেরামতি হচ্ছে। আপনারা বরং মিরিক চলে যান।’ কেন জানি না, মন সায় দিল না। আগেও মিরিক গেছি। আলাদা করে দুদিন থাকার মানে হয় না।
অগত্যা সেইদিনই একটা গাড়ি ধরে নেমে গেলাম। ঠিক করলাম, কার্শিয়াংয়ে নামব। তারপর আশেপাশের কোথাও একটা জায়গা ঠিক খুঁজে নেব। গাড়িতেই একজনের সঙ্গে গল্প হচ্ছিল। আশেপাশে কোথাও রেয়ার স্পট আছে কিনা। তিনি বললেন চিমনির কথা। কাকে একটা ফোন করে নম্বরও জেনে নিলেন।
ফোন করা হল। যিনি ধরলেন, তিনি সটান জানিয়ে দিলেন রুম খালি নেই। কী আর করা যাবে। মন মরা হয়ে বসে রইলাম। হঠাৎ, মাথায় একটা দুষ্টু বুদ্ধি চেপে গেল। মনে হল, চিমনির সেই ভদ্রলোককে আবার ফোন করি। করলাম। শুরুতেই বললাম, দেখুন, আমি জানি আপনি বলবেন রুম নেই। আপনার ‘না’ শোনার জন্য ফোন করিনি। আমরা আসছি। আপনি ব্যবস্থা করন। এটা বলার জন্য ফোন করেছি।
উনি তো ঘাবড়ে গেলেন। আমতা আমতা করে হিন্দি –নেপালি মিশিয়ে বলতে চাইলেন, রুম নেই। আমরাও নাছোড়। বললাম, শুনুন ভাইয়া, এতদূর থেকে যখন এসেছি, তখন ফিরে যাব না। আমরা থাকব, ব্যাস। কোথায় রাখবেন, সেটা আপনার ব্যাপার। আমরা রান্নাঘরেও থাকতে পারি। ডাইনিংয়েও থাকতে পারি। আপনার ঘরেও থাকতে পারি। আপনি বরং এক–দু রাতের জন্য অন্য ঠিকানা খুঁজে নিন। কোনও বন্ধু বা আত্মীয়র বাড়িতে চলে যান।
এমন আজগুবি আবদার সে নিশ্চয় এই জন্মে শোনেনি। কার্শিয়াং থেকে একটা আলাদা গাড়ি নিয়ে চলে গেলাম চিমনির দিকে। অনেকটাই ডাউহিলের রাস্তায়। ইচ্ছে ছিল একবার ডাউহিলে নামার। কিন্তু এমন বৃষ্টি, নামার সুযোগ হল না। গাড়ি চলল চিমনির দিকে। গিয়ে থামল সেই হোম স্টে–র সামনে।
চমৎকার হোম স্টে। পুরোটাই প্রায় ফাঁকা। মালিক বেরিয়ে এলেন। বললাম, এসে গেছি। এবার ব্যবস্থা করুন। উনি একটা সুন্দর ঘরে নিয়ে গিয়ে তুললেন। বললাম, ‘পুরোটাই তো ফাঁকা, তাহলে যে বললেন রুম নেই।’ উনি কিছুটা লজ্জায় পড়ে গেলেন। বললেন, আসলে এক–দুটো রুমে লোক রেখে লাভ হয় না। সেই এক–দুজনের জন্য রান্না করতে হয়। একসঙ্গে অন্তত তিন–চারটে রুমে বুকিং থাকলে সুবিধা হয়। সেই কারণেই বলেছিলাম, রুম নেই।
তাঁর সমস্যাটা বুঝলাম। তিনি যে সত্যিটা বললেন, সেটা জেনে ভালও লাগল। আমরা আপাতত দুদিনের অতিথি। কিন্তু আকাশের যা অবস্থা, সারাক্ষণ বৃষ্টি। বৃষ্টিটা দারুণভাবে উপভোগ করেছিলাম। প্রাণখুলে আড্ডা দিয়েছিলাম। কত গান গেয়েছিলাম। কত পুরানো স্মৃতি হাতড়েছিলাম। আর মাঝে মাঝেই ছাতা নিয়ে বেরিয়ে পড়ছি। এর তার সঙ্গে গল্প জুড়ে দিচ্ছি। দ্বিতীয় দিন একটা গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। আশপাশের এলাকাটা ঘুরে দেখলাম। রাস্তাটা তখন একেবারে এবড়ো খেবড়ো ছিল। শুনলাম, কয়েকদিন পরেই নাকি ঠিক হয়ে যাবে। জানি না, আজও ঠিক হয়েছে কিনা।
ওই দুর্গম পাহাড়ি পথেও ছেলে মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছে। যাওয়াটা না হয় সহজ। নেমে গেলেই হয়। কিন্তু কার্শিয়াং থেকে হেঁটে ফিরে আসছে! সত্যিই পেন্নাম করতে ইচ্ছে হল। আমরা যদি এই দুর্গম এলাকায় থাকতাম, কোনকাল লেখাপড়ার পাট চুকিয়ে দিতাম। ড্রপ আউটের তালিকায় আমাদের নামগুলো জ্বলজ্বল করত।
সবমিলিয়ে দুদিনের ট্যুরটা মন্দ হয়নি। মাঝে মাঝে রোদ। মাঝে মাঝে বৃষ্টি। গ্রাম্য কিছু দোকান। ইচ্ছেমতো মোমো, সিঙ্গাড়া খাওয়াই যায়। কতরকম ফলের গাছ। গোটা গ্রামটাই যেন নিজেদের গ্রাম। যেন যার ঘরে যখন খুশি ঢুকে পড়া যায়। ইচ্ছে হল, একজনের বাড়িতে চা খাব। এক আন্টিকে বলামাত্রই হাসিমুখে রাজি। তিনি চা করে আনলেন। চা–টা যে দারুণ এমন নয়। কিন্তু ওই আতিথেয়তা! সত্যিই তুলনা হয় না। মানুষগুলো কত সহজ–সরল। একবার ভাবুন তো বেহালায় বা বরানগরে কোনও বাড়িতে গিয়ে আপনি চা খেতে চাইছেন। ইভটিজার বা চোর ভেবে গণপিটুনিও জুটে যেতে পারে। অথচ, ওঁরা কত সহজ–সরল। কত অতিথি বৎসল। ওঁদের ওই হাসিমুখগুলো দেখে আমাদেরও যেন আবদার করতে সংকোচ হয় না।
আবার যদি কখনও সুযোগ পাই, সেই গ্রামে যাব। জানি না, কখন যাওয়া হবে। যাঁরা এই লেখা পড়ছে, তাঁরা চাইলে ঘুরে আসতে পারেন। নেটে চিমনি লিখে সার্চ মারলেই অনেক ছবি, তথ্য পেয়ে যাবেন। দুটো দিন নিরিবিলি পাহাড়ি গ্রামে ঘুরে আসতে চাইলে আপনার ঠিকানা হতেই পারে চিমনি।
(বেড়ানোর এমন নানা বিচিত্র গল্প আপনিও তুলে ধরতে পারেন। বেঙ্গল টাইমসে লিখে পাঠিয়ে দিন আপনার অভিজ্ঞতা। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)