কীভাবে সন্ত্রাসের মোকাবিলা করতে হয়, ফের দেখিয়ে দিলেন ভিক্টর। সব আসনে বিরোধীদের প্রার্থী। লাঠি হাতে ব্লক অফিস ঘিরে রইলেন বাম কর্মীরা। সুবোধ বালকের মতো মনোনয়ন দিয়ে গেল তৃণমূল। তরুণ বিধায়কের কাছে পুলিশও শিখল, আইনশৃঙ্খলা কীভাবে রক্ষা করতে হয়। লিখেছেন সরল বিশ্বাস।।
টিভি খুললেই সন্ত্রাসের ছবি। কাগজ খুললেই সেই এক ঘটনা। শাসক দলের আক্রমণ। বিরোধীদের অভিযোগ। এটাই এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। খোদ জেলাশাসকের অফিসে চলছে তাণ্ডব। আর ব্লক অফিস তো দুর্বৃত্তদের অভয়ারণ্য। নির্বাচন কমিশন থেকে ডিএম–এসপি সবার যেন হাঁটু কাঁপছে। তাঁবেদার মিডিয়াও ‘শান্তি’র ছবি তুলে ধরতেই ব্যাকূল।
কিন্তু এই আবহেও অন্যরকম ছবি উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়ায়। প্রতিরোধ কাকে বলে, আবার দেখিয়ে দিলেন আলি ইমরান (ভিক্টর)। লড়াকু এই বাম বিধায়ক ফেসবুকে ছবি দিয়ে লাইকের প্রত্যাশা করেন না। প্রেস কনফারেন্সে বা টিভি চ্যানেলেও তাঁকে তেমনভাবে দেখা যায় না।
ঠিক কী কী করলেন, তা জানানো দরকার।
এমনিতেই জেলায় এবার টার্গেট চাকুলিয়ায়। এত চেষ্টা করেও কিছুতেই বাগে আনা যায়নি এই তরুণ ফরওয়ার্ড ব্লক বিধায়ককে। যে যেমন, তাঁর সঙ্গে তেমন ভাষাতেই কথা বলতে জানেন। বিধানসভার যুক্তি তর্কে যেমন সাবলীল, মাঠ ময়দানের লড়াইয়েও তেমনই সাবলীল। তাঁকে বাগে আনতে ছুটে যেতে হয় একের পর এক নেতা, মন্ত্রীকে। এবারও চাকুলিয়াকে বিরোধীশূন্য করার চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন শাসক দলের নেতা–মন্ত্রীরা।
কিন্তু চাকুলিয়ার গ্রাম পঞ্চায়েত, পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ— তিনটি স্তরের সব আসনেই প্রার্থী দিতে পেরেছে বামেরা। শাসক দল দারুণ মহানুভবতা দেখিয়েছে বা প্রশাসন দারুণ সক্রিয় ছিল, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। হুমকির পাল্টা হুমকি ফিরিয়ে দিয়েছেন এই তরুণ বিধায়ক। শাসকের, প্রশাসনের চোখে চোখ রেখে কথা বলার হিম্মৎ দেখিয়েছেন।
প্রথম দিনই ব্লক অফিস ঘিরে ফেলেছিল তৃণমূলের দুর্বৃত্তরা। যাঁরাই ঢুকতে গেছেন, তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই রাতেই থানায় গেলেন ভিক্টর। ওসিকে জানিয়ে দিলেন, আজ যা যা হয়েছে, আপনারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। কাল কিন্তু এমনটা হবে না। আপনারা চুপ থাকলেও আমরা চুপ থাকব না। কাল আমাদের সবাই মনোনয়ন দিতে যাবে। যদি কোনওরকম সমস্যা হয়, তাহলে ওই গুন্ডাদের পরে পেটাবো। আগে থানায় এসে আপনাদের পিটিয়ে যাব। এই থানা আস্ত থাকবে না। মনে রাখবেন, গুন্ডারা একদিনের জন্য বাইরে থেকে আসবে। কিন্তু আপনাদের এখানেই থাকতে হবে। কোনও পিসি, কোনও ভাইপো, কোনও দাদা বাঁচাতে পারবে না।
শুধু কথার কথা নয়। শুধু ফাঁপা হুমকি নয়। এটা অন্তত পুলিশ খুব ভাল জানে। গত সাত বছরে নানা সময় কীভাবে হাজার হাজার মানুষকে ভিক্টর এক ঘণ্টার নোটিশে রাস্তায় নামিয়েছেন, সেটা প্রশাসনের অজানা নয়। সকাল থেকেই অন্তত পাঁচশো বাম কর্মী হাজির ব্লক অফিসে। হাতে দাস ক্যাপিটাল বা নেতাজির জীবনী নয়। হাতে বড় বড় লাঠি। যে ভাষাটা দুর্বৃত্তরা বোঝে। তৃণমূলবাবুদের তখনও ঘুমই ভাঙেনি। ব্লক অফিস তখন ঘিরে ফেলেছেন বাম কর্মীরা। নেতৃত্বে ভিক্টর।
একইসঙ্গে আশ্বাস। একইসঙ্গে হুমকি। জানিয়ে দিলেন, আজ বাংলার সব প্রান্তে তৃণমূল লাঠি ধরেছে। কিন্তু চাকুলিয়ায় আমরা লাঠি ধরেছি। ওরা লাঠি ধরেছে, যেন কেউ মনোনয়ন দিতে না পারে, সেই জন্য। আমরা লাঠি ধরেছি যেন সবাই মনোনয়ন দিতে পারে, সেই জন্য। সবাই নিশ্চিন্তে আসুন, মনোনয়ন জমা দিয়ে যান। কংগ্রেস, বিজেপি নিশ্চিন্তে মনোনয়ন দিতে পারে। এমনকী তৃণমূলের যাঁরা বিক্ষুব্ধ তাঁরাও এসে মনোনয়ন দিতে পারেন। কেউ কিচ্ছু করতে পারবে না। তৃণমূল প্রার্থীদেরও ভয় পাওয়ার কিছু নেই। ভদ্রভাবে আসুন, মনোনয়ন দিয়ে যান। কেউ বাধা দিলে আমাদের জানান। কিন্তু খবরদার, লোকজন নিয়ে বা লাঠি নিয়ে আসার চেষ্টা করবেন না। তাহলে কিন্তু বাড়ির বদলে হাসপাতাল যেতে হবে।
পুলিশ কর্তাদের উদ্দেশ্যেও হুঁশিয়ারি দিয়ে রাখলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের। কিন্তু আপনারা চূড়ান্ত ব্যর্থ। আপনারা থাকলে শুধু গুন্ডারা ভরসা পায়। কারণ, গুন্ডারা জানে, আপনাদের কিছুই করার ক্ষমতা নেই। যেটা আপনাদের করার কথা, সেটা আমরা করছি। আজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব আমাদের। কথা দিলাম, সবাই যদি সুষ্ঠুভাবে আসে, কারও গায়ে হাত পড়বে না। সবাই নিশ্চিন্তে মনোনয়ন দিতে পারবে। কাল যখন দূরে দাঁড়িয়ে দেখেছেন, তখন আজও দূরে দাঁড়িয়ে দেখুন। আইনশৃঙ্খলা কীভাবে রক্ষা করতে হয়, আমাদের কাছে শিখে নিন।
পাশাপাশি পুলিশের প্রতি হুমকিও ছিল। মনোনয়নের পরে যদি কোনও প্রার্থীর বাড়িতে হামলা হয়, কে হামলা করেছে, খুঁজতে যাব না। পাল্টা হামলা থানাতেই হবে। এবার পুলিশ ঠিক করুক তারা কী করবে। কোন ভাড়াটে গুন্ডা কী করেছে, খুঁজতে যাব না। তাদের নামে এফআইআর–ও করব না। কোন লোকটা এই ভাড়াটে গুন্ডাদের এনেছিল, সেটা জানতে সময় লাগবে না। আমরা কিন্তু সেই নেতার বাড়িতেই চড়াও হব। এবার সেই নেতা ভেবে নিক, সে ভাড়াটে গুন্ডা আনবে কিনা।
এরপর তৃণমূলের একটি মিছিল আসছিল। পুলিশ জানত কী হতে চলেছে। পুলিশই তাদের লাঠিপেটা করে ছত্রভঙ্গ করেছে। সুবোধ বালকের মতো তৃণমূলের প্রার্থীরা একে একে এসে মনোনয়ন দিয়েছেন।
কলকাতার মিডিয়ায় এসব খবর ছাপা হবে না। চ্যানেলেও দেখানো হবে না। তাঁরা অনুব্রতর মহিমা প্রচারেই ব্যস্ত থাকবে। কিন্তু একা একজন তরুণ কীভাবে শাসকের সন্ত্রাস রুখে দিয়ে সবার মনোনয়নের ব্যবস্থা করলেন, সেগুলো অজানাই থেকে যাবে।
হ্যাঁ, চাকুলিয়ার সব আসনেই বিরোধীদের প্রার্থী আছে। সব আসনেই লড়াই হবে। শাসক দল সমস্ত শক্তিই প্রয়োগ করবে। প্রশাসনকে নোঙরাভাবে কাজেও লাগাবে।
তারপরেও ফলাফল কী হবে, এখনই লিখে নিন। রাজ্যে যদি একটি পঞ্চায়েত সমিতি বামেদের দখলে আসে, সেটি হবে উত্তর দিনাজপুরের চাকুলিয়া।