(জাতীয় পুরস্কার পাচ্ছে ময়ূরাক্ষী। সৌমিত্র, প্রসেনজিতের যুগলবন্দী। অতনু ঘোষের পরিচালিত এই ছবিটি মুক্তির সময়ে বেঙ্গল টাইমসে তার রিভিউ বেরিয়েছিল। সেদিন ঠিক কী লেখা হয়েছিল? পুরোটাই তুলে দেওয়া হল। এই সুযোগে সেই স্মৃতি একটু ঝালিয়ে নেওয়া যাক।।)
কুন্তল আচার্য
ময়ূরাক্ষী আসলে কী? তিতাসের মতোই একটি নদীর নাম? নাকি একটি নারীর নাম? একটি বাংলা ছবির নাম? নাকি আগাগোড়াই একটি ধোঁয়াশা? কয়েক মাস ধরেই ছবিটি নিয়ে অনেক লেখা হয়েছে। শহর ছেয়ে গেছে পোস্টারে। ছবি দেখার জন্য যা যা হাইপ তোলার, তোলাও হয়েছে। ধোঁয়াশা কি কাটল? বরং বলা যায়, কিছুটা বাড়ল।
বাবা–ছেলে সম্পর্কের ছবি। তাই ছবিতে তিন নারী থাকলেও পোস্টারে তাঁদের জায়গা হয়নি। বাবা–ছেলের রসায়নটা ঠিক কেমন? চড়াই–উতরাই? মাঝে মাঝেই মান–অভিমান? ঠিক তেমনটাও নয়। এক সময়ের রনজি ক্রিকেটার এখন কর্মসূত্রে মার্কিন মুলুকে। এখন এসে দাঁড়িয়েছেন মাঝ বয়সে। অন্যদিকে, বাবা একসময় ইতিহাসের অধ্যাপনা করেছেন। অবসরে এসে একটু একটু করে ভুলতে শুরু করেছেন।
বয়স হওয়ার মানেই বোধ হয় স্মৃতির সঙ্গে আড্ডা দেওয়া। কিন্তু প্রাক্তন অধ্যাপক সুশোভন (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) স্মৃতির সঙ্গে তেমন আড্ডা দেন না। সাল, তারিখ, সময় সব কেমন যেন গুলিয়ে যায়। কোনটা সত্তরের দশকের, কোনটা নব্বইয়ের দশকের, সব কেমন যেন তাল কেটে যায়। ইতিহাস থেকে দর্শন, রাজনীতি থেকে ক্রিকেট, গানবাজনা থেকে সিনেমা— বিরাট এক জগতে ছিল তাঁর বিচরণ। টুকরো টুকরো ছবি ভেসে ওঠে। টিভি দেখা, কাগজ পড়ায় ঘোর বিরক্তি। তাঁর কথায়— কী হবে, এসব খোঁজ রেখে? শুধু ইনটলারেন্স, ভায়োলেন্স। ফেলে আসা সময় ঘোরাফেরা করা অধ্যাপক কি এই সময়কেও কোথাও ছুঁতে চাইলেন?
সংলাপগুলো কোথাও কোথাও খেই হারালেও সেটাই হয়ত চরিত্রের দাবি, সেটাই হয়ত চিত্রনাট্যের দাবি। আর অভিনয়? এমন একটা চরিত্রকে কীভাবে ফুটিয়ে তুলতে হয়, তার দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়। অভিনয় জীবনের প্রান্তবেলায় এসে নিজেকে যেন উজাড় করে দিচ্ছেন। এই ছবির জন্য তিনি জাতীয় পুরস্কার পেতেই পারেন। বরং একধাপ এগিয়ে বলা যায়, না পেলেই অবিচার হবে।
বারবার তিনি খুঁজতে থাকেন ময়ূরাক্ষীকে। কিন্তু কে এই ময়ূরাক্ষী? অনেক খুঁজে খুঁজে ছেলে আর্যনীল গেলেন একটি বাড়িতে। কিন্তু সেখানেও অনেক জটিল ধাঁধা। মনে হল, এই নামে কেউ একজন ছিলেন, যাঁর সঙ্গে ছেলের বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন অধ্যাপক। কিন্তু ছেলে মার্কিন প্রবাসী হলেও ভারতীয় শিকড়। দু–দুটো সম্পর্ক হারিয়েছেন। সেই সম্পর্কগুলোকে তিক্ত হতে দেননি। বিরাট কোনও আফশোস বা গ্লানি নেই। আবার অন্য কাউকে দোষারোপ করার রাস্তাতেও হাঁটেননি। আরও দুই নারীর অস্তিত্ব আছে, একজন হাউস কিপার সুদীপ্তা চক্রবর্তী, অন্যজন আর্যনীলের কলেজ জীবনের বন্ধু ইন্দ্রানী হালদার। দুজনেই নিজেদের চরিত্রে বিশ্বাসযোগ্য। স্বল্প উপস্থিতিতে গার্গি রায়চৌধুরীও বেশ বুদ্ধিদীপ্ত অভিনয়ের ছাপ রাখলেন। কিন্তু ময়ূরাক্ষী? তাঁর কোথাও উপস্থিতিই নেই। তাঁকে ঘিরে এমন আকুতি কেন? কেনই বা তাঁকে ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন কৃতী অধ্যাপক? পশ্চিম সীমান্তে এসেও কেনই বা তাঁর খোঁজ করছেন? রক্তমাংসের নারী নয়, তখন মনে হল, ময়ূরাক্ষী একটা প্রতীকের নাম।