‌ফুল ফুটুক না ফুটুক

সোমা দে

what bengal thinks today india thinks tomorrow

বটেই তো।

মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রস্তুতিই শুরু হল না, বাঙালি বাবা-মা মাঝরাতে দুশ্চিন্তায় চমকে চমকে উঠছেন, মাধ্যমিক নিয়ে নয়, মাধ্যমিকের পরের ফেজ নিয়ে। মাধ্যমিক-গুঁতোর ব্যাথা প্রশমনের জন্য যেটুকু বিরতি ছাত্রদের দেওয়া, সেটুকু ছেলে-মেয়েরা বোরোলিন-ভলিনি লাগিয়ে দিব্বি সামলে নেবে বলেই বাবা-মার বিশ্বাস। আর সামলে নিলে এই একটু স্পোকেন ইংলিশ, ওই একটু গাড়ি চালানো, সেই একটু গিটার ট্রেনিং, আর মোস্ট ইম্পোর্টেন্টলি উচ্চমাধ্যমিকের অ্যাডভান্স প্রাইভেট টুইশন নামক টুকিটাকি কাজ সমান্তরালে চালানো আর এইসব শক্তিমান বাচ্চাদের জন্য আর এমন কি। সারারাত তাই মায়ের ভুরুতে ঢেউ তোলা ভাবনা, কী নিয়ে পড়বে, কী কী পড়বে, পড়বে না পাড়বে? পারবে? ইত্যাদি। বাবার চোখে হালকা ঢুলুনি মায়ের কনুইয়ের খোঁচার কাছে তুচ্ছ। ওদিকে ছেলে-মেয়ে দের, মাধ্যমিক তাড়াতাড়ি শেষ হওয়া নিয়ে কোনও মাথাব্যথা নেই। তারা জেনে গেছে যে, তাদের নিয়ে এ বাঁদরনাচ অব্যাহত থাকবে তাই এতে আর উত্তেজনা কি! মামার বাড়ি তো আর যাওয়া হবে না। দার্জিলিংটা বোধহয় অঞ্জন দত্তের গানেই কল্পনা করতে হবে। বিকেলবেলার ক্রিকেট আর ঘুড়ি ওড়ানোর প্ল্যানগুলো সব ক্যান্সেল করতে হবে। রবিবারটাও জলে হাবু-ডুবু খাবে, সাঁতার শেখার হুড়কোতে।

এই সব ভাবনা আসছে রাতুলেরও। মাধ্যমিকটা কোনওরকমে শেষ হলে বাঁচি, এ কথা উচ্চারণ করতেও বিভীষিকা। মা রোজ সাদা কাগজে লিস্ট বানাচ্ছে, এক্টিভিটি লিস্ট আফটার মাধ্যমিক। কিছু কিছু এক্টিভিটি কাটাকুটি হয়ে কমছে, কিন্তু যোগ হচ্ছে আরও বেশি। ফ্রিজের পাশে রাখা ওই লিস্টের ভয়, ফ্রিজের মধ্যের ক্যাডবেরি-রসগোল্লাগুলোর হাতছানিকেও অস্বীকার করছে।

spoken english

যথাসময়ে মাধ্যমিক শেষ হল। পরীক্ষা মন্দ হয়নি। তবু রাতুলের মন খারাপ। একদিন তবু বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হয়েছে। এরপর তো কী সব নতুন নতুন জায়গা। ধুস। বাড়িতে এসে কিছুই করার পাচ্ছে না রাতুল। সবে জানলার ধারে পায়রার হাঁটা-ওড়ার প্যাটার্নটা বুঝবে, অমনি চকলেট বোমা। মা বললো, কাল থেকে রোজ সকালে স্পোকেন ইংলিশ আর বিকেলে ম্যাথস টুইশন। ড্যাম। হাত মুঠো করে মনে মনে রাতুল বলে, বড় হয়ে ওয়াইল্ড লাইফ ফটোগ্রাফার হয়ে সবাইকে বুঝিয়ে দেবে, তাকে জোর করে কোনও লাভ হয়নি। এখন আপাতত রাতুলের মুডের একশো সত্তর হয়ে গেছে। ভাগ্যিস রাতে মটন বিরিয়ানিটা হয়েছিল, তাতেই দিল গার্ডেন গার্ডেন। হাত মুঠো করে মনে মনে রাতুল বলে, বড় হয়ে শেফ হলেও খারাপ কি। আপাতত পরের দিন সকালের স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসের জন্য কিঞ্চিৎ অক্সিজেন বিরিয়ানি থেকেই নিয়ে নেওয়া গেল।

পরের দিন, রাতুল কিছু বোঝার আগেই নিজেকে আবিষ্কার করলো স্পোকেন ইংলিশ ক্লাসে। কেউ আসেনি তখনও। গোঁফো পরচুলো মালায়ালাম ভিলেন লুকে যিনি, উনি স্যার। শরীরের সঙ্গে বিদ্রোহ করা তাঁর মিনমিনে সুরেলা গলা, বলে ওঠে, “আরও একজন আসবে, এলেই শুরু”।

তখন তুখোড় ছয় মেরে, রাতুলের বল ওভার বাউন্ডারি, হঠাৎ যেন কানের কাছে চেঁচামেচি!

– এই হ্যালো, লিসেন। তুমি ঢুলছো কেন? সরে যাও। আমি বসবো কোথায়?

রাতুল চোখ মেলে দেখে, একটি সাদা টপ, লাল স্কার্ট তাকেই কিছু বলছে। যাহ। ওভার বাউন্ডারি স্বপ্ন! উফ। এই মেয়ে আবার কোথা থেকে …..

স্যার অমনি ঘরে ঢুকে বললেন, এই রাতুল, গিভ হার সিট্। মুভ এ সাইড।

ডেভিড ওয়ার্নার -স্পিডে রাতুল সরে গেল প্রায় দেড় ফুট। চমক, বিভ্রান্তি, বিহ্বলতা সব মিলে একেবারে নবরত্ন-কারি সিচুয়েশন। বোঝা গেল, ইনি, সাদা টপ, লাল স্কার্ট-ই আপাতত টুইশন-মেট। স্যার ওদিকে বলতে শুরু করেছেন, “এখন থেকে সব কথা আমরা ইংলিশেই বলব। ভুল হোক, ঠিক হোক। ইট হ্যাস টু বি ইন ইংলিশ।” হাত মুঠো করে মনে মনে রাতুল বলে, বড় হয়ে বাংলার টিচার হয়ে দেখিয়ে দেবে ইংলিশটা জাস্ট একটা ল্যাঙ্গুয়েজ। কাফ সিরাপ নয়। আমি বাংলায় মাতি উল্লাসে, করি বাংলায় হাহাকার, আমি সব দেখে শুনে ক্ষেপে গিয়ে করি বাংলায় চিৎকার।

স্যার বলে উঠলেন, “হেই রাতুল, টেল আস এবাউট উরসেল্ফ”।

spoken english2

“ইয়ে আই এম রাতুল রায়। আই এম মাধ্যমিক স্টুডেন্ট। আই এম পেট-লাভার। আই এম বিরিয়ানি-লাভার অল্সো। এন্ড আই এম অঞ্জন দত্ত লাভার। এন্ড …..”

“ওকে ওকে। ইউ সিম টু বি আ লাভার” ব্যাঁকা হাসি হেসে স্যার মুখ ঘুরিয়ে বললেন।

সাদা টপ, লাল স্কার্ট ফিক হাসলো।

রাতুলের কানটা লাল হয়ে উঠলো।

এইটারই ভয় ছিল। এবার পদে পদে অপমান সহ্য করতে হবে দিন রাত এই সাদা টপ, লাল স্কার্ট – এর সামনে। কেন যে টুইশন ক্লাসে মেয়েদের আলাদা ব্যাচ হয় না কে জানে। স্যারের কথা আর মাথায় ঢুকছে না। ব্যাচ চেঞ্জ করার কথা বললে হয় না? কিন্তু কখন বলবে? মেয়েটির বেরিয়ে যাওয়ার অপেক্ষা করতে হবে। মেয়েটা দিব্বি তো ইংলিশ বলছে, তাহলে আর ক্লাস করা কেন, সেটাই তো বোঝা যাচ্ছে না। স্যার গালে হাত দিয়ে দিব্বি শুনে যাচ্ছেন। মেয়েটির সাত খুন মাফ। আর লাভার বলেছি তো ব্যঙ্গ! ইয়েস, আই এম এ লাভার। কার কি তাতে হ্যা? যত্তসব।

ক্লাস শেষ হল, রাতুলের মুখে-চোখে বিরক্তি। মেয়েটি যায় না। স্যার বললেন,
রাতুল, ওকে এগিয়ে দিও তো। ওর বাড়ি তো তোমাদের পাড়াতেই।“

ড্যাম। এবার পাড়াতেও মুখ দেখানো বন্ধ। এ মেয়ে সারা পাড়া রাষ্ট্র করবে। অসহ্য। পৌঁছে দেওয়ার কি আছে? সারা রাস্তায় একে সহ্য করতে হবে!! উফফফ। ট্যাশ কোথাকার।

রাস্তা দিয়ে কিছুক্ষন চুপচাপ এগোতেই মেয়েটি হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে গেল। রাতুল তটস্থ, এই রে, আবার কি বলে বসে।

মেয়েটি বললো, “এই তুমি কি খুব শান্ত? আমি কিন্তু খুব কথা বলি। আমার সঙ্গে চলতে গেলে কথা বলে যেতে হবে”।

রাতুল ভাবে, ওহ। আমি যেন ওনার ড্রাইভার। বয়েই গেছে। কোনওরকমে আজকের দিনটা পার হোক, তারপর দেখাচ্ছি …..

মেয়েটি বলেই চলেছে, তোমাকে আগেও দেখেছি লাইব্রেরির সামনে। তুমি ক্রিকেট খেলো তাই না। আই লভ ক্রিকেট। আমাকে নেবে একদিন তোমাদের খেলাতে? আই লভ ব্যাটিং। আর আই লভ অঞ্জন দত্ত অল্সো। তুমি ওর কোন কোন গান শুনেছ?

রাতুল হাঁ করে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে। লাভ না বলে লভ বলছে কেন, জানা নেই। তবে শুনে যেতে লোভ হচ্ছে বেশ। হোক লভ হোক। শুনতে বেশ কিউটই লাগছে। মাথা চুলকোতে চুলকোতে রাতুল বললো, ওই তো ইয়ে, যেমন ধরো অঞ্জন দত্তর ওই গানটা ……..

বাড়ি ফিরে রাতুল মাকে বললো, মা, স্পোকেন ইংলিশটা স্যার ভালোই শেখাচ্ছেন গো। ক্লাসটা কদিনের যেন? ওই কদিনে কি পুরো শেখা হয়ে যাবে নাকি এক্সট্রা ক্লাস ও দিতে পারেন চাইলে?

নাহ মাধ্যমিক-এর পরের ফেজটা এতটাও বোরিং লাগছে না তো। রাতুল আজ সারারাত অঞ্জন দত্ত শুনবে, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।

 
(‌মাধ্যমিক শেষ। আমাদের অনেকের জীবনেই এই সময়টা এসেছে। কীভাবে কেটেছিল?‌ কোথায় গিয়েছিলাম?‌ কী পড়েছিলাম?‌ নতুন কোনও অনুভূতি?‌ স্মৃতির সরণি বেয়ে হাঁটলে কেমন হয়?‌ বিভিন্ন লেখায় সেই ফেলে আসা সময়টা উঠে আসুক। আপনিও লেখা পাঠান। লেখা পাঠানোর ঠিকানা:‌ bengaltimes.in@gmail.com) ‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.