দেবার্ঘ্য বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রায় বছর দশেক আগের কথা। তখনও ব্যাচেলারই ছিলাম। ছুটি পেলেই ইচ্ছেমতো এদিক–ওদিক বেরিয়ে পড়তাম। লম্বা ছুটি পেতাম না। একদিন, বড়জোর দুদিন। একদিনে কোথায় আর যাওয়া যায়! কখনও দিঘা, কখনও মন্দারমণি, কখনও পাঞ্চেত–মাইথন। এসব টুকটাক ভ্রমণ। অনেক সময় পরিকল্পনা থাকত না, হুটহাট বেরিয়ে পড়তাম। সঙ্গী কখনও জুটত, কখনও জুটত না। অগত্যা, একাই বেরিয়ে পড়তাম।
সেই দিঘা ভ্রমণের একটা অভিজ্ঞতা বেঙ্গল টাইমসের বন্ধুদের সঙ্গে শেয়ার করা যাক। সেবার এক সঙ্গীর যাওয়ার কথা। কিন্তু সে যাবে কাঁথি থেকে। সে বলল, তুই এগিয়ে যা। আমি অফিসের কাজ সামলে দুপুর নাগাদ পৌঁছে যাব। অগত্যা গেলাম। প্রথমেই সৈকতাবাসে। ঘর ফাঁকাই ছিল। স্পট বুকিংও হয়। একা কাউকে ঘর দেওয়া যাবে না। কারণ? বলা হল, একা এলে সে নাকি আত্মহত্যা করতে পারে। তাই ঘর দেওয়া যাবে না। এরকমই নাকি থানার নির্দেশ।
বিনীতভাবে বললাম, ভোটার কার্ড রাখুন, প্যান কার্ড রাখুন। কিন্তু যেখানে যাব, সেখানে কি সঙ্গী ভাড়া করে নিয়ে যাব? ধরুন যদি অফিসের কাজে আসি, তার মানে আমি দিঘায় থাকতে পারব না? কে শোনে কার কথা! বলা হল, থানায় যান। যা বলার সেখানে বলুন।
চাইলে অন্য কোনও প্রাইভেট হোটেলের ওঠাই যেত। কিছু টাকা বেশি দিলে তারা হয়ত ঘর দিয়েও দিত। কিন্তু মনে হল, সত্যিই এরকম কোনও নিয়ম আছে কিনা জানা দরকার। অগত্যা গেলাম দিঘা থানায়। বড়বাবু নেই। অন্য একজনের সঙ্গে কথা বললাম। এরকম নিয়ম আদৌ চালু করা যায় কিনা, জানতে চাইলাম। তিনি বললেন, এটা আমরা চালু করিনি। এটা দিঘা–শঙ্করপুর ডেভলপমেন্ট অথরিটি বলতে পারবে।
হাঁটতে হাঁটতে সেখানে গিয়ে পৌঁছলাম। অনেক অপেক্ষার পর এগজিকিউটিভ অফিসারের সঙ্গে দেখা। তাঁকে শুরুতেই জিজ্ঞাসা করলাম, এখানে কেউ আত্মহত্যা করলে পরের জন্মে কি সে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতি হয়? উনি তো আকাশ থেকে পড়লেন। হঠাৎ এমন প্রশ্ন? আমি আমার সৈকতাবাসের অভিজ্ঞতার কথা জানালাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ, এরকম একটা নিয়ম আছে। বিনীতভাবে বললাম, দিঘা কি ভারতবর্ষের বাইরে? দেশের কোথাও এমন নিয়ম আছে বলে শুনিনি। একা এলে থাকতে দেওয়া হবে না, এমন নিয়ম তো প্রাচীন যুগ বা মধ্যযুগেও ছিল না। ভাগ্যিস ছিল না, নইলে ফা হিয়েন বা হিউ এন সাংদের সঙ্গে লোক ভাড়া করে আনতে হত। এমন আজগুবি নিয়মের কপি দেখতে চাই।
উনি একজন ক্লার্ককে ডেকে পাঠালেন। নিয়মের কপি আনতে বললেন। জানা গেল, এমন কোনও লিখিত নিয়ম নেই। মুখে মুখেই চলছে এই নিষেধাজ্ঞা। সেই অফিসারকে বললাম, দিঘা একটি জনপ্রিয় পর্যটনকেন্দ্র। সরকার আরও জনপ্রিয় করার চেষ্টা করছে। ট্রেন চালু হয়েছে, নতুন নতুন হোটেল হচ্ছে, সরকার পর্যটকদের আহ্বান জানাচ্ছে। আর এদিকে বলছেন, একা থাকা যাবে না? কেউ যদি একা ঘুরতে আসে, সে দিঘায় থাকতে পারবে না? তালিবানদের দেশেও তো এমন নিয়ম নেই। তাছাড়া, একজন পর্যটকের খেয়ে–দেয়ে কাজ নেই? সে দিঘায় আত্মহত্যা করতে আসবে? গত কুড়ি বছরে কজন আত্মহত্যা করেছে, তারা একা এসেছিল–নাকি দোকা এসেছিল, তার কোনও তথ্য আছে? যারা মারা যায়, বেশিরভাগই সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে। এবং তাদের অনেকেই হয়ত মদ্যপান করে সমুদ্রে নামে। এর সঙ্গে একা আসা বা দোকা আসার কী সম্পর্ক? যদি দুর্ঘটনা আটকাতে হয়, মদ্যপান আটকান। আর যদি কেউ একা এসে আত্মহত্যা করেও থাকে, তার মানে কি আর কেউ একা আসতে পারবে না? একটা সভ্য সমাজে এটা কোনও যুক্তি হল?
উনি কিছুটা একমত হলেন। সেই হোটেলে ফোন করলেন, যাঁকে আপনারা ফিরিয়ে দিয়েছেন, তিনি আমার বিশেষ বন্ধু। তিনি সুইসাইড করতে আসেননি। আপনারা রুম দিতে পারেন।
তারপরই বললেন, যান, আপনার ব্যবস্থা হয়ে গেল। আর কোনও সমস্যা হবে না।
আমি বলে বসলাম, সবার তো আর আপনার ‘বন্ধু’ হওয়ার সৌভাগ্য হবে না। আমি চাই, আপনার শত্রুরাও যেন একা এলে থাকতে পারে। তাদের যেন ফিরিয়ে না দেওয়া হয়। কেউ লোকের বউ নিয়ে এলে সে থাকতে পাবে, আর কেউ একা এলে সে থাকতে পাবে না? এই জন্যই বোধ হয় লোকে এত ‘পরস্ত্রী’ নিয়ে আসে!
উনি হেসে ফেললেন। বললেন দেখছি, এই আজগুবি নিয়মটাকে কী করে বদলানো যায়। সেবারের মতো ব্যবস্থা হয়ে গেল। আমি বেরিয়ে আসার পর ফোনে উনি কী বলেছিলেন, জানি না। কিন্তু সৈকতাবাসে ঢোকার আগেই দেখি তিনজন দাঁড়িয়ে। যাওয়ার আগেই একজন ব্যাগটা কেড়ে নিলেন। বললেন, আপনি তো বলেননি, আপনি সাহেবের বন্ধু! সেটা আগে বলবেন তো!
মনে মনে বললাম, আমি তোমাদের সাহেবের নামই জানতাম না। আমি যে তাঁর ‘বন্ধু’ আমি নিজেই কি জানতাম!
সেই অফিসার এখন কোথায় আছেন, জানি না। কিন্তু দিঘার সাম্প্রতিক ফতোয়ার কথা কাগজে পড়ে সেই পুরনো গল্পটা মনে পড়ে গেল।
(আপনাদের জীবনেও বেড়াতে গিয়ে এমন অভিজ্ঞতা থাকতে পারে। লিখে পাঠাতে পারেন বেঙ্গল টাইমসে। ভ্রমণ বিভাগ মানে তো শুধু ‘কীভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন’ নয়। তার বাইরেও এমন অনেক ঘটনা, গল্প ছড়িয়ে আছে। সেগুলোও উঠে আসুক ভ্রমণ বিভাগে। )