সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
২০১৪ সালে জনাদেশ পেয়ে কেন্দ্রের শাসনক্ষমতা দখল করার পর থেকেই নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বাধীন বিজেপি গোটা দেশজুড়ে ধর্মের নামে একটা স্বৈরাচার এবং অরাজকতা চালাচ্ছে। তার প্রভাব ভারতবর্ষের প্রায় সবকটি অঙ্গরাজ্যেই অল্পবিস্তর পড়েছে। বাংলাতেও তার প্রভাব বড় কম নয়। বরং ৩৪ বছরের বাম শাসনে বাংলায় যা চিন্তাও করা যেত না, ধর্মের নামে সেই হিংসা এবং অস্থিরতা গোটা বাংলাকে ধীরে ধীরে গ্রাস করছে।
যেমন ধরা যাক পূজাপার্বণ কে কেন্দ্র করে। “বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণ”—এ কথা সর্বজনবিদিত। সেখানে দুর্গাপূজা থেকে শুরু করে লক্ষ্মীপূজা, কালীপূজ়া,জগদ্ধাত্রী পূজা যেমন আছে, তেমনি আরও অনেক পার্বণ আছে যেগুলো হিন্দুজনেরা মেনে চলেন বা পালন করেন। যেমন শিবরাত্রি। বা যেমন রামনবমী। কথা হচ্ছে, এইসব পূজা-পার্বণ কিন্তু বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনাধীনেও সাড়ম্বরেই পালিত এবং উদযাপিত হত। বাম সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বা অন্যান্য মন্ত্রীরা এসবে সামিল হতেন না। তাই বলে উৎসব-অনুষ্ঠানে সামিল হতে সাধারণ মানুষের কোনও বাধা ছিল না। কিন্তু এই পূজ়া-পার্বণ কে কেন্দ্র করে কোনও অশান্তি দেখা দিত না। কারণ, কে বেশি ধর্মপরায়ণ তা প্রমাণ দেওয়ার জন্য এক হাস্যকর এবং রুচিহীন প্রতিযোগিতায় কখনও সরকারকে বা শাসকদলকে লিপ্ত হতে হয়নি।
বিগত তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে, এই বাংলায়, কেন্দ্রের শাসকদল বিজেপি এবং বাংলার শাসক তৃণমূল কংগ্রেস পূজা-পার্বণের নামে বাংলার সাধারণ মানুষের কাছে “হিন্দুত্বের” প্রমাণ দেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেন বাংলার মানুষের আর কোনও সমস্যা নেই ! যেন প্রত্যেক ঘরে ঘরে সবাই একেবারে মাসে লাখ টাকা উপার্জন করার চাকরি করছে। যেন বাংলায় কোনও অভুক্ত, বুভুক্ষু নর-নারী নেই, সবাই একেবারে চারবেলা হাতের কব্জি ডুবিয়ে খেতে পাচ্ছে! সাধারণ মানুষের জন্য করার মতো কিছুই যেন বাকি নেই! সবকাজ যেন সারা হয়ে গিয়েছে। তাই ভগবানের কাছে “ভক্ত” দের পরীক্ষা চলছে, কে আসল ভক্ত!! বাংলায় আগে “গণেশ চতুর্থী” উদযাপনের এমন জাঁকজমক কে দেখেছিল, বলতে পারবেন? “গণেশ চতুর্থী” তো মূলতঃ পশ্চিম ভারতে অর্থাৎ মহারাষ্ট্রে বা গুজরাটে সাড়ম্বরে পালিত একটি তিথি। অথচ গত বছরে দেখতে পেলাম,এই বাংলাতেই গণেশ চতুর্থীর নামে আয়োজনের কি ঘনঘটা! কোথাও স্থানীয় তৃণমূলের নেতা কয়েক লাখ টাকা দিচ্ছেন ক্লাবগুলোকে “গণেশ চতুর্থী” পালনের জন্য, তো কোথাও আবার বিজেপির রাজ্য সম্পাদক পকেট থেকে টাকা ছড়াচ্ছেন, তৃণমূলের “গণেশ চতুর্থী” পালনকে টেক্কা দিতে। বিশ্বকর্মা পুজোর নামেও এই দুই দলের মধ্যে সেই প্রতিযোগিতার আবহ ছিল। আর বীরভূমে তৃণমূলের ডাকসাইটে নেতা অনুব্রত মণ্ডলের উদ্যোগে পুরোহিত সম্মেলন বা হাজার “ব্রাহ্মণ-ভোজ়ন” অনুষ্ঠান মূলতঃ বিজেপির উদ্দেশ্যে এই বার্তাই দেওয়ার জন্য, যে “তোমরা প্রকৃত হিন্দু প্রেমী নও, আমরাই প্রকৃত হিন্দুপ্রেমী”। বাংলায় রামনবমী পালনের নামে গত বছরে যেটা হয়েছিল, তা শুধু অপ্রত্যাশিতই নয়, এককথায় ভয়াবহ। বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের নেতৃত্বে দশ-বারো বছরে ছেলে-মেয়েদের হাতে বই, খাতা বা কলম নয়—রাম দা, ভোজালি, গদা, ত্রিশূল নিয়ে মিছিলে হাঁটা! বাংলায় এই সংস্কৃতি কি আদৌ ছিল কোনওদিন ? ৩৪ বছরের বাম শাসনাধীনে এই হিংস্রতা কখনও চিন্তা করা যেত ? অথচ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এতকিছুর পরেও না সেই মিছিল আটকাতে পারলেন, না বিজেপির রাজ্য সভাপতিকে গ্রেপ্তার করার মত সাহস দেখাতে পারলেন। এ বছরেও আসন্ন “রামনবমী” উপলক্ষ্যে ইতিমধ্যেই যুযুধান দুই শিবির জানিয়ে দিয়েছে, তারা পৃথক পৃথক ভাবে “রামনবমী” উদযাপন করবে। এবং সেখানে সশস্ত্র মিছিলও হবে। অর্থাৎ সারা ভারতে যেখানে ধর্মই মানুষের এখন প্রধান পরিচয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, সেই ধর্মের নামেই কার কত শক্তি তা প্রদর্শন করা।
আমাদের রাজ্যে বর্তমানে বেকার ছেলে-মেয়ের সংখ্যা কত, তা মনে হয় মুখ্যমন্ত্রী জানেন না। তাই যেখানেই সভা করতে যান, দৃপ্তদম্ভে ঘোষণা করে দেন, এত লাখ বেকার ছেলেমেয়েকে তিনি চাকরি দিয়েছেন। তিনি যতই শিল্পায়নের লক্ষ্যে সিঙ্গাপুরে বা ইংল্যাণ্ডে বা জার্মানিতে পাড়ি দিন আর “Bengal Means Business” লেখা বড় বড় হোর্ডিং দিয়ে শহরের অলি-গলি থেকে রাজপথ ঢেকে ফেলে শিল্পপতিদের সঙ্গে মিটিং করে নিজের কাজের প্রচার করুন না কেন, বাংলায় শিল্পায়নের বর্তমান পরিস্থিতি এবং এই সরকারের শাসনে তার ভবিষ্যত কী, তা সহজেই অনুমেয়। আর দেশের প্রধানমন্ত্রী লগ্নি আনার লক্ষ্যে যতই বিদেশ সফর করুন, আর নোটবাতিল করে কালো টাকা উদ্ধারের চেষ্টা করুন না কেন, তিনিও মনে হয় ভুলে গেছেন, ভারতবর্ষের ক্ষুধা-সূচক তাঁর “রাম-রাজত্বেই” ১০০ ছুঁয়েছে। দেশের হাজার হাজার কৃষক ফসলের দাম না পেয়ে অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে মধ্যবিত্ত এবং নিম্ন-মধ্যবিত্তের জীবনযাত্রা দুর্বিষহ। আর তিনি একদিকে ধর্মের নামে দেশের মানুষের মধ্যে বিভেদের পাঁচিল তুলে এক সম্প্রদায়কে আরেক সম্প্রদায়ের “জাতি-শত্রু” তে পরিণত করছেন, আরেক দিকে দেশের কোটিপতিদের ট্যাক্সে ছাড় দিচ্ছেন, দুর্নীতিপরায়ণ কোটিপতিদের দেশ থেকে পালানোর পথ সুগম করে দিচ্ছেন ! আর নিরন্ন মানুষদের এই বার্তাই দিচ্ছেন, যেন শুধুমাত্র ধর্মাচরণ করলেই খাদ্য-বস্ত্রের সংস্থান সহজলভ্য হবে!
কার মধ্যে বেশি হিন্দুত্ব, এই প্রতিযোগিতায় নেমে বাঙালি তথা ভারতবাসীর আদৌ কোনও উন্নতি হবে কি?