সুগত রায়মজুমদার
ভারতবর্ষে স্বাধীনতার পর থেকেই দুর্নীতি প্রবেশ করেছে। এটাই এখন পরম্পরা। কংগ্রেসের দীর্ঘদিন রাজত্বকালে কেন্দ্রীয় সরকারের অনেক নেতাই দুর্নীতিতে যুক্ত ছিলেন। আজও আছেন। তবে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এই দুর্নীতি বন্ধের কিছু ভাল পদক্ষেপ নিয়েছিলেন। তিনিই ভারতের ব্যাঙ্কগুলিকে রাষ্ট্রীয়করণ করে দুর্নীতি কিছুটা রোধ করেছিলেন। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে চেয়েছিলেন। একবার তিনি পশ্চিমবঙ্গের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে বলেছিলেন, এই দেশের অর্ধেক মানুষও যদি সৎ হতেন, তা হলে এই দেশ সোনার দেশ হত। এই আক্ষেপ তিনি করেছিলেন। সেই দুর্নীতিই এখন আমাদের দেশের দস্তুর। কংগ্রেসের পাহাড়প্রমাণ দুর্নীতির জন্যই ২০১৪ সালে বিজেপি আবার ফেরে ভারতের শাসনে। প্রধানমন্ত্রী হন নরেন্দ্র মোদি। যাঁর অতীত কখনই স্বচ্ছ ছিল না। যিনি ছিলেন গুজরাটের দাঙ্গার নায়ক। তাঁর ছায়াসঙ্গী হলেন আর এক অভিযুক্ত অমিত শাহ। এঁরা শাসনে এসে দেশের ব্যাঙ্কের টাকা কিছু দুর্নীতিবাজ লোকদের দিয়ে অপহরণ করে উত্তরপ্রদেশ ছিনিয়ে নেয়। নীরব মোদি, বিজয় মালিয়া, ললিত মোদিদের বিদেশে পালিয়ে যেতে সাহায্য করে। এতে দেশে মূল্যবৃদ্ধি আকাশছোঁয়া। হঠাৎ নোটবন্দী করে প্রচুর টাকা লুট করে বিজেপি। এই বিজেপি–কে তাড়াতেই কংগ্রেস এখন রাহুল গান্ধীর নেতৃত্বে সক্রিয়। আর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীও তৃতীয় ফ্রন্ট গঠনের জন্য ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিজেপি–কে হটাতে। মমতা ব্যানার্জি মোদিকে নিয়ে এত ব্যস্ত যে, রাজ্যে কি চলছে তা তিনি অবগত নন। মোদিজি এসেই লালকৃষ্ণ আদবানি, মুরলি মনোহর যোশি, যশবন্ত সিংদের মতো নেতাদের সাইড লাইনের বাইরে পাঠিয়ে দিলেন। আর এস এসের কিছু লোককে দলের প্রথম সারিতে নিয়ে এলেন। যাঁদের রাজ্য চালানোরও ক্ষমতাও নেই। মোদির উদ্দেশ্য, যে করে হোক, সারা দেশকে নিজেদের আয়ত্তে আনতে হবে। প্রথমে পূর্বাঞ্চলের আসাম দখল। এবার লক্ষ্য ছিল বৃহত্তম রাজ্য উত্তরপ্রদেশ। মোদিজিরা বুঝেছিলেন, উত্তরপ্রদেশকে এত সহজে আয়ত্তে আনা যাবে না। তাই সবার অগোচরে নোটবন্দী। বিরোধী দলগুলিকে অর্থশূন্য করে সমস্ত অর্থ নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে ঝড়ের বেগে উত্তরপ্রদেশ থেকে বিরোধীদের উড়িয়ে দিলেন। এর পর আরও আগ্রাসী বিজেপি। ত্রিপুরায় প্রচুর অর্থ ছড়িয়ে ২৫ বছরের শাসনাধীন সিপিএম–কে ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে বললেন, এর পর আমাদের লক্ষ্য পশ্চিমবাংলা ও ওড়িশা। কর্ণাটক, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে তো জিতবই। তবে কঠিন হবে মোদিজির। বিজেপি–র এই আগ্রাসী মনোভাবই একদিন তাদের পতনের কারণ হয়ে দাঁড়াবে।
সামনে বাংলায় পঞ্চায়েত ভোট। এই ভোটের ফল বিজেপি–র ভবিষ্যৎ অনেকটা নির্ভর করবে। যদি বিজেপি এখানে ভাল ফল করে, তা হলে পরবর্তী লোকসভা ও বিধানসভাতেও বাংলাকে সর্বশক্তি প্রয়োগ করে বাজিমাত করার চেষ্টা করবে। বিজেপি জানে, বিরোধী দলগুলির মধ্যে সঠিক ঐক্য নেই। লোভ দেখালেই তাদের পক্ষে থাকবে। যেটা নীতীশ কুমারকে নিজেদের আযত্তে এনে বিহারকে নিজেদের দখলে এনেছে।
এদিকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী সারা দেশে তৃতীয় ফ্রন্ট গড়ার স্বপ্ন দেখছেন। মুখে বলছেন, আমি প্রধানমন্ত্রী হতে চাই না। অন্য কাউকে হওয়াতে সাহায্য করব। এজন্য তিনি নিজের রাজ্যে কী ঘটছে, সেদিকে মন নেই। ক্ষমতার অহঙ্কার তাঁর মধ্যেও। যে ভুল করেছিল সিপিএম। তাঁকেও গ্রাস করেছে ক্ষমতা। সিপিএম–ই তৃণমূলকে সমস্ত আন্দোলনে বাধা দিয়ে মমতাকে ক্ষমতায় আসতে সাহায্য করেছে, সেরকমই মমতা রাজ্যে বিজেপি–র মতো দুর্বল দলকে গুরুত্ব দিয়ে, তাদের মিটিং, মিছিলে বাধা দিয়ে এবং কেওড়াতলায় পুলিসের উপস্থিতিতে বয়স্ক বিজেপি কর্মীদের পিটিয়ে সিপিএমকেই অনুসরণ করছেন। এতে সাধারণ মানুষের সহানুভূতি বিজেপি–র দিকেই যেতে বাধ্য। সেই আশঙ্কাই ডেকে আনছেন মমতা। বিজেপি–সঙ্গী দলগুলিকে একত্র করতে চাইছেন। মমতার বন্ধু শিবসেনা তো বিজেপি–র চেয়েও আরও বেশি সাম্প্রদায়িক। যারা পাকিস্তান–ভারত খেলা হলে পিচ নষ্ট করার হুমকি দিত। আর রাহুল তো ত্রিপুরায় মমতার সঙ্গে জোট করতেও অস্বীকার করেন। ত্রিপুরা জয়ের পর বিজেপি–র মদতে লেনিনের মূর্তি ভাঙা নিয়ে সারা দেশে যে আলোড়ন হয়, মমতা তার প্রতিবাদ করেন। মমতা চান, সিপিএমের ভোট যেন বিজেপি–তে না যায়। এজন্য তিনি সিপিএমকে খুশি করতে লেনিনের মূর্তি ভাঙার প্রতিবাদ করেন। যে দলের জন্য সিপিএমকে হটতে হয়েছে পশ্চিমবঙ্গ থেকে, সেই দলের কাছাকাছি কখনই তারা যাবে না। এটা কি মমতা বুঝছেন না? বরং সুযোগ পেলে বিজেপি–কে সাহায্য করবে সিপিএম। এটাই সিপিএমের দস্তুর। তাদের অবস্থান সবসময় সুযোগসন্ধানী। এক এক রাজ্যে একেকরকম। কারাট কিছুতেই বাংলার নেতাদের কংগ্রেসকে সমর্থন মেনে নেবেন না।
গুজরাটের ফল রাহুলের কংগ্রেসকে অনেকটা চাঙ্গা করে তুলেছে। রাহুলও ঝাঁপিয়ে পড়েছেন বিজেপি–কে হটাতে। তারা সব রাজ্যেই বিরোধী দলগুলির সঙ্গে সমঝোতায় আসতে চায়। তার ফলও পেয়েছে বিহার ও উত্তরপ্রদেশের উপনির্বাচনে। তবে এতেই যদি কংগ্রেস ও অন্য দলগুলি স্বস্তি পায়, তা হলে কংগ্রেসও ভুল করবে। রাহুল গান্ধীও মমতার জনপ্রিয়তাকে ভয় পান। তৃতীয় ফ্রন্টে মমতার চাহিদা আছে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে। কারণ রাহুলের ওপর দেশের অন্য দলগুলির তেমন আস্থা নেই। বিশেষ করে শিবসেনা, চন্দ্রবাবু, মায়াবতী, শারদ পাওয়ারা। বরং মমতার গ্রহণযোগ্যতা তুলনায় অনেক বেশি। সুতরাং ভবিষ্যতে কী হবে, তা সময়ই বলবে।
এ রাজ্যে মমতা যতই কেন্দ্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার হোন, তাঁকে মাথায় রাখতে হবে, তিনি নিজের রাজ্যে মানুষকে এই ৭ বছরে কোনও ব্যাপারে তেমন স্বস্তি দিতে পারেননি। শুধু কলকাতার রাস্তার উন্নতি ও আলোময় করলেই হবে না। এই রাজ্য শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থানে সারা দেশের সমীক্ষায় ক্রমশ পিছিয়ে পড়ছে। বাড়ছে শুধু গোষ্ঠীকোন্দল। সিন্ডিকেট, কয়লাখনি, পাথর খাদান, ভেড়ি, মাটি কাটা নিয়ে চলছে যথেচ্ছ খুনোখুনি। নিজের দলের মধ্যে। মমতা জেলায় জেলায় মিটিং করে সকলকে সাবধান করেই খালাস। তার ফল কী হল, তা নিয়ে ভাবার সময় নেই তাঁর। এটাই মমতা ব্যানার্জির কাল হয়ে দাঁড়াতে পারে। দলের কারও উপরই আস্থা নেই তাঁর। সেজন্যই তাঁকে সব জেলায় ঘুরে বেড়াতে হয়। তাঁর দলে কিন্তু বেশ কিছু দক্ষ নেতাও আছেন। তাঁদের কাজে লাগানো হয় না। ক্ষমতা পুরো নিজের আয়ত্তে। ক্ষমতার আত্মতুষ্টিই তাঁকে বিপদে ফেলতে পারে। সিপিএমকে দেখেও শিক্ষা নেননি তিনি। তিনি নিশ্চিত যে, মানুষ তাঁকেই ফিরিয়ে আনবে। মানুষ কী চায়, সিপিএম–ও শেষের দিকে বুঝত না। মমতাও বুঝছেন না।
এই রাজ্যে সামাজিক অবস্থা একেবারে তলানিতে। শিশুরাও যৌননিগ্রহে নিস্তার পায় না। অতীতে সিপিএম অনেক দুর্নীতি ও ঔদ্ধত্য দেখিয়েছে। কিন্তু সাধারণ মানুষ সিপিএমের সংগঠনকে ভয় পেত বলে শিশু যৌননিগ্রহের সাহস পেত না। এত ধর্ষণও ছিল না। সায়েন্স কলেজের মতো এক ঐতিহ্যপূর্ণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকের গালে ছাত্রের চড় মারা হয়নি। ছাত্রটিকে শুধু শো–কজ করে এড়িয়ে যাওয়া হল! সাধারণ মানুষ এর হিসেব রাখছে। এগুলির জবাব ভোটের বাক্সে দিতেই পারে। মমতাকে সতর্ক হতেই হবে। রাজ্যে জেলার কোনও মানুষ অসুস্থ হলে এখনও কলকাতায় চিকিৎসা ছাড়া গতি নেই। আর কলকাতায় সরকারি হাসপাতালগুলিতে জায়গা না পেয়ে সাধারণ মানুষের সাধ্যের বাইরের নার্সিংহোমগুলিতে ভর্তি হতে হচ্ছে। কেন এখনও জেলা হাসপাতালগুলিতে পরিকাঠামো তৈরি হল না? স্বাস্থ্যে রাজ্যের শাসকদল মানু্যকে কোনও ভরসা দিতে পারেনি। এর প্রভাব পঞ্চায়েত নির্বাচনে পড়বেই। এ ছাড়াও রাজ্যের যুবক–যুবতীরা বাইরের রাজ্যে চলে যাচ্ছে চাকরির সন্ধানে। আর যারা যেতে পারছে না, তারা হতাশায় আত্মঘাতী হচ্ছে। ছেলেমেয়েদের হতাশা গ্রাস করছে। রাজ্যে হতাশায় আত্মঘাতী বাড়ছে। শুধু ভাষণ দিলেই হবে না। বাস্তবে পরিণত করতে হবে। বিজেপি–র টাকা প্রচুর। তারা যদি মানুষকে এই সব করার আশ্বাস দেয়, তখন মানুষ তাদেরকেই বেছে নেওয়া অস্বাভাবিক নয়। ত্রিপুরাই সেই পথ দেখিয়েছে। কোনও দলই অপরিহার্য নয়। যারা মানু্যকে কিছু দেবে, তাদেরই ভোট দিয়ে জেতাব।
সামনের পঞ্চায়েত ভোটে খুবই জটিল অঙ্ক। রাজ্যে আছে তৃণমূল কংগ্রেস, কংগ্রেস, সিপিএম ও বিজেপি। এই ৪টি দল। মমতা ব্যানার্জি আতঙ্কে আছেন, তৃণমূল ছাড়া বাকি তিনটি দলের ভোট একই বাক্সে পড়তে পারে। এটাই স্বাভাবিক। এটা হলে হার অনিবার্য। এই কারণে তিনি সিপিএমের পাশে দাঁড়ান লেনিনের মূ্র্তি ভাঙা নিয়ে। যাতে সিপিএম খুশি হয়ে নিজেদের দলের ভোট দলকেই দেয়। সিপিএম জানে এ রাজ্যে তাদের তেমন অস্তিত্ব নেই। কংগ্রেসও তথৈবচ। থাকল বিজেপি। সিপিএম ও কংগ্রেসের সমর্থকরা জানেন, নিজেদের দলকে ভোট দিয়ে কোনও লাভ হবে না। সুতরাং এই দুই দল সুযোগটাকে সদ্ব্যবহার করে বিজেপি–কে নিজেদের ভোটটা দিয়ে তৃণমূলকে হটানোর চেষ্টা করবেই। তৃণমূলই এই দুটি দলের প্রধান শত্রু। বিজেপি নয়। এটাই ওদের প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ। সিপিএমের ভাবনা, এখন কে লেনিনের মূর্তি ভাঙল, তা নিয়ে চিন্তা করে না। ওগুলি লোকদেখানো। রাশিয়ায় তো হাজার হাজার লেনিনের মূর্তি ভাঙা হয়েছে। কী এসে গেল? এ ছাড়া তৃণমূল ক্ষমতায় আসার সময়ের কর্মীরা এখন আর দলে গুরুত্ব পান না। গুরুত্ব পায় সিপিএম থেকে আসা কিছু মস্তান ও প্রমোটররা। তাদের হাতেই ক্ষমতা। যাঁরা সাহস করে সিপিএমের হুমকিকে অগ্রাহ্য করে এগিয়ে এসেছিলেন, তাঁরা এখন ব্রাত্য। এসব নানা সমীকরণ ও চোরাস্রোত কাজ করতেই পারে। গ্রাম পঞ্চায়েত বা পঞ্চায়েত সমিতিতে এই সামান্য ভোটের এদিক–ওদিকও ফলাফল উল্টে দিতে পারে। তাই পঞ্চায়েতের লড়াইটা খুব সহজ নাও হতে পারে।