আবার বাসটা মিস হয়ে গেল, কমরেড

স্বরূপ গোস্বামী

ঠিক এই আশঙ্কাটাই করছিলাম। অহেতুক গড়িমসি করলে কী হয়, আবার হাতেনাতে তার ফল পাওয়া গেল। কিন্তু এর পরেও আত্মসমীক্ষা নয়, বরং অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা। একই ভুল আর কতবার করবেন বাম নেতৃত্ব?‌

ঠিক এক বছর আগে, রাজ্যসভা নির্বাচন নিয়ে চূড়ান্ত গড়িমসি করেছিলেন বাম নেতৃত্ব। সীতারাম ইয়েচুরি প্রার্থী হবেন না হবেন না, এই আলোচনা চলল ৬ মাস ধরে। কংগ্রেস নিজে থেকে চাইছিল সীতারাম ইয়েচুরিকে সমর্থন করতে। তাঁদের দিক থেকে বারবার এমন প্রস্তাবও ছিল। কিন্তু বামেরা ‘‌‌হ্যাঁ’ বলব নাকি ‘‌না’ বলব, এটা ভাবতেই ছ মাস লাগিয়ে দিলেন। ফল কী হল?‌ মমতার ‘‌আশীর্বাদে’ প্রদীপ ভট্টাচার্য প্রার্থী হয়ে গেলেন। বামেরা শেষদিনে প্রার্থী দিলেন। তারও মনোনয়ন বাতিল হয়ে গেল। নিজেরা হাসির খোরাক হলেন। ‌অন্তত এক্ষেত্রে রাজ্য কংগ্রেসকে দায়ী করা যাবে না। ‌‌তাদের সদিচ্ছার কোনও অভাব ছিল না।

left front12

এবারও প্রায় একই ধরনের গাফিলতি। পার্টিলাইন অনুযায়ী কংগ্রেসের সমর্থন নেওয়া যাবে না, বোঝা গেল। কংগ্রেসকে সরাসরি সমর্থন করা যাবে না, তাও না হয় বোঝা গেল। কিন্তু এর বাইরে তো একটা অন্য রাস্তা খোলা ছিল। দুই শিবিরের কাজে গ্রহণযোগ্য, এমন কোনও নামকে সামনে রেখে লড়াই হতে পারত। অন্তত এটুকু তো বলা যেত, তৃণমূলের চারজন গেলেও আমাদের প্রার্থী সেরা প্রার্থী। যতদূর জানি, আলোচনা শুরুও হয়েছিল। বেশ কয়েকটি নাম নিয়ে আলোচনা চলছিল। কিন্তু এত গড়িমসি করলে যা হয়, তাই হয়েছে। কতদিন আগে বিজ্ঞপ্তি জারি হয়ে গেছে। বিভিন্ন রাজ্যে মনোনয়ন জমা দেওয়ার প্রক্রিয়াও শুরু হয়ে গেছে। আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবেন?‌ রাজ্যে যোগ্য প্রার্থীর এতই অভাব?‌ জাস্টিস অশোক গাঙ্গুলি, মীরা পাণ্ডে, জহর সরকারের মতো আমলারা ছিলেন। নজরুল ইসলামের মতো অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ কর্তা ছিলেন। যদি আমলায় অ্যালার্জি থাকে, তবে সামাজিক ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য, মূল্যবোধ আছে, এমন অনেক মানুষ ছিলেন। এমনকী বিকাশ ভট্টাচার্যকেই যদি প্রতীক না দিয়ে দুই শিবিরের নির্দল প্রার্থী হিসেবে তুলে ধরা হত, কংগ্রেসের দিক থেকে খুব একটা আপত্তি আসত বলে মনে হয় না। একটা নাম চূড়ান্ত করতে কত সময় লাগে?‌ রাজ্য সম্মেলন পর্যন্ত অপেক্ষাই বা করতে হবে কেন?‌ যেটা এক ঘণ্টায় হয়ে যায়, সেটার জন্য এক মাস সময় নিলে যা হওয়ার, ঠিক সেটাই হয়েছে।এত গোপন মিটিংয়ের পরেও সমন্বয়ে এত ফাঁক থেকে যায় কেন ? এত বিচক্ষণ নেতৃত্ব থাকতেও দূরদর্শিতার অভাবটা বারবার এত প্রকট হয়ে ওঠে কেন ?

বিমান বসুর বিবৃতিতে বলা হয়েছে, আলোচনা চলছিল। কংগ্রেস একতরফাভাবে প্রাথী ঘোষণা করে দিয়েছে। তাই আর কোনও বিকল্প পথ না থাকায় রবীন দেবকে প্রার্থী করা হল। প্রশ্ন একটাই, কতদিন ধরে এই আলোচনা চলবে?‌ কখন আপনার রাজ্য সম্মেলন শেষ হবে, কখন আবার সম্পাদকমণ্ডলী তৈরি হবে, কখন তারা আবার নতুন নাম প্রস্তাব করবেন, কংগ্রেস হাইকমান্ড সেই অপেক্ষা করবে?‌ কংগ্রেসকে কি স্পষ্ট করে জানানো হয়েছিল, কত তারিখের মধ্যে নাম চূড়ান্ত হবে?‌ জাতীয় রাজনীতির নানা সমীকরণে কংগ্রেস হাইকমান্ড মমতার প্রতি কিছুটা দুর্বল। মমতা সেই সুযোগটা আগেরবারও নিয়েছিলেন। এবারও নেবেন, সেটা জানাই ছিল। এটা জানার পরেও এত সময় নেওয়ার মানে হয়?‌ এক সপ্তাহ আগেও অধীর চৌধুরি বলেছিলেন, দুই শিবিরের কাছে গ্রহণযোগ্য কাউকে খুঁজে বের করা হোক। এবং এই ব্যাপারে অন্তত বাংলার কংগ্রেস এবারও যথেষ্ট নমনীয় মনোভাবই দেখিয়েছিল। কিন্তু বাম নেতৃত্ব যখন ক্রমাগত গড়িমসি করেই চলেছেন, তখন তাঁদের সামনেও আর উপায় ছিল না। তাঁরা হাইকমান্ডের হাতেই ছেড়ে দিলেন। কংগ্রেসের প্রার্থী হয়ে গেলেন অভিষেক মনু সিংভি। আর সেই ঘোষণা কিনা হল মমতার মঞ্চ থেকে। যতদূর জানি, অভিষেক মনু সিংভি কখনই অধীর চৌধুরি বা আব্দুল মান্নানদের পছন্দের প্রার্থী নন। তবু তাঁদের গিলতে হচ্ছে। বামেদের গড়িমসির জন্য কতবার তাঁরা হাইকমান্ডের কাছে অপ্রিয় হবেন?‌

পরমাণু চুক্তি ইস্যুতে সমর্থন তুলে তৃণমূল আর কংগ্রেসকে কাছাকাছি এনে দিয়েছিলেন। এবারও দায়িত্ব নিয়ে দুই শিবিরকে কাছাকাছি এনে দিলেন বাম নেতৃত্ব। সেবার না হয় প্রকাশ কারাতকে দায়ী করা গিয়েছিল। কিন্তু এবার কাকে দায়ী করবেন?‌ দোহাই, এবার অন্তত কংগ্রেসের ঘাড়ে দায় চাপাবেন না?‌ সম্পূর্ণ নিজেদের গয়ংগচ্ছ মনোভাবের জন্য এই পরিণতি ডেকে এনেছেন। বাইরে স্বীকার করতে না পারুন, অন্তত মনে মনে এই সত্যিটা স্বীকার করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.