বিধানসভায় স্পিকারের বিরুদ্ধে অনাস্থার নোটিশ। যথারীতি খারিজ করে দিলেন স্বয়ং স্পিকার মশাই। আলোচনাই হল না। আলোচনা হলেই বা কী হত! বিরোধীরা যা যা যুক্তি দিত, স্পিকারের পাশে দাঁড়িয়ে সেগুলো খণ্ডন করলেন স্বরূপ গোস্বামী।।
মাননীয় স্পিকার স্যার,
বিরোধীদের আক্কেল দেখুন! আপনার বিরুদ্ধে কিনা অনাস্থা প্রস্তাব! প্রথমেই বলে রাখি, ওরা খুব অন্যায় করেছে। আলোচনা যে হবে না, এতদিনে সেই বুদ্ধিটুকুও ওদের হয়নি। আস্থা নেই, এটা বুঝতে সাত বছর লেগে গেল! সময় নেই বলে আপনি আলোচনা খারিজ করে দিয়েছেন। বেশ করেছেন স্যার। আপনার না হয় সময় নেই। আপনি চিন্তা করবেন না স্যার। আমার হাতে অনেক সময়। আপনার বিরুদ্ধে ওরা যা যা অভিযোগ তুলতে পারত, তা আপনার হয়ে আমিই খণ্ডন করছি।
১) ওরা হয়ত বলত, আপনি নিরপেক্ষ নন। ওরা নেহাত গবেট, তাই এমন অভিযোগ করে। নিরপেক্ষতার আশা ওদের কে করতে বলেছে? একজনের অনুপ্রেরণায় সারা রাজ্য চলছে। আপনি কি রাজ্যের বাইরে? আপনি যদি একটু অনুপ্রেরণায় চলেন, সেটা দোষ হয়ে গেল!
২) হিংসে, বুঝলেন স্যার, হিংসে। ওরা খুব কুচুটে। মুখ্যমন্ত্রী আপনার ওপর ভরসা করে স্পিকার করেছেন, সেটা ওদের সহ্য হচ্ছে না। আপনি ওদের কথায় একদম পাত্তা দেবেন না স্যার। যিনি ‘অনুপ্রেরণা’ তিনি যেমনটি চাইবেন, ঠিক তেমনটি করবেন। মনে রাখবেন, তিনি খুশি থাকলে আপনার চাকরি থাকবে। তিনি চটে গেলে কী কী হতে পারে, ভারতী ঘোষকে দেখে সবাই শিখছে। আপনি বিরোধীদের ফাঁদে পা দেবেন না। মনে রাখবেন, আকাশে একটাই সূর্য। তেমনি সভায় একজনই মুখ্যমন্ত্রী। তাঁর কথা শোনা মানেই আপনি একশোয় একশো।
৩) ওরা হয়ত বলত, আপনি সবসময় ডানদিকে তাকিয়ে থাকেন। সরকার পক্ষ যা চাইছে, সেই হুকুম তামিল করেন। আমি বলব, বেশ করেন। ওরা বামপন্থী, বাম দিকে তাকাক। আপনি ডানপন্থী হলে ডানদিকে তাকাবেন। এতে বিরোধীতার কী আছে? অনাস্থারই বা কী আছে? আপনি কোনদিকে তাকাবেন, সেটা কি ওরা ঠিক করে দেবে? হাউসের গার্জেন কে, আপনি না সুজন–মান্নানরা?
৪) সহজ কথা, মুখ্যমন্ত্রী যা চাইবেন, তাই হবে। এই সহজ সত্যিটা আপনি সহজেই নিজেও বুঝেছেন। অন্যদেরও বুঝিয়ে দিয়েছেন। যে সহজে বুঝতে পারে, সেই তো কৃতী ছাত্র। যে সহজে বোঝাতে পারে, সেই তো ভাল শিক্ষক। সেই মানদন্ডে আপনি সত্যিই সফল শিক্ষক। মুখ্যমন্ত্রীর বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য সিপিএমের সভা আছে। ফেসবুক আছে। বিধানসভায় ওসব চলবে না। এখানে তাঁর সমালোচনা হলে আপনি তাকে থামিয়ে দিয়ে ঠিকই করেন। মাইক বন্ধ করে দিয়ে ঠিক করেন। সভার কার্য বিবরণী থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই করেন।
৫) গিলোটিন। বাঙালি শব্দটা শুনেছিল ঠিকই। কিন্তু এর এত ভাল প্রয়োগ হয়, জানত! আপনিই দেখিয়েছেন। আপনি স্যার ইতিহাস তৈরি করেছেন। গিলোটিন মানে বিভিন্ন দপ্তরের বাজেট আলোচনা ছাড়াই পাস হয়ে যাওয়া। সত্যিই তো, এত আলোচনার কী আছে? এত বিতর্কেরই বা কী আছে? জনগণ ভোটে জিতিয়েছে। মন্ত্রীরা যা বলবেন, সেটাই ফাইনাল। এত কথা কীসের বাপু! যদি আলোচনা করতেই হয়, কুটির শিল্প, ক্ষুদ্র সেচ, উদ্যান পালন, ক্রেতাসুরক্ষা— এসব দপ্তর নিয়ে করো। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পুলিশ, ভূমি সংস্কার— এসব নিয়ে আলোচনা কেন বাপু? ওসব হবে না। এই সহজ সত্যিটা আপনি সাত বছর ধরে বুঝিয়ে দিয়েছেন। এবারও বুঝিয়ে দিলেন। দেশের কোনও স্পিকার পারেননি। কোনও স্পিকার এতগুলো বাজেট গিলোটিনে পাঠাতে পারেনি। আপনার সাফল্যে ওদের হিংসে তো হবেই।
৬) প্রশ্নোত্তর পর্ব। অর্থাৎ বিধায়করা প্রশ্ন জমা দেবেন, মন্ত্রী উত্তর দেবেন। এটা নাকি পরিষদীয় রীতি। এসবের কোনও দরকার আছে? বিধায়কদের খেয়ে দেয়ে কাজ নেই, তারা প্রশ্ন করতেই পারে। তাই বলে মন্ত্রীকেও উত্তর দিতে হবে! কর্তার ইচ্ছেয় কর্ম হবে, এর মাঝে এত প্রশ্ন–উত্তরের কী আছে? ভারী অন্যায় আবদার। ওসব না মেনে আপনি ভালই করেছেন স্যার।
৭) মুলতুবি প্রস্তাব। এটাও বিধানসভার প্রচলিত একটা প্রথা। কোনও বিষয় আলোচনা চেয়ে মুলতুবি প্রস্তাব আনা যায়। আগের স্পিকার নাকি এসব অ্যালাও করতেন। এমনকি খুব অযৌক্তিক দাবি হলেও প্রস্তাবটা পড়তে অন্তত দিতেন। সেই বিধায়ক কোন বিষয় নিয়ে আলোচনা চাইছেন, এটা অন্তত বোঝা যেত, রেকর্ড থাকত। আপনি ওসব ন্যাকামির রাস্তায় হাঁটেননি। এত ঝামেলার কী দরকার? সহজ কথা, আলোচনা হবে না। আলোচনাই যখন হবে না, তখন পড়তেই বা দেব কেন? ঠিক করেছেন স্যার।
৮) দলবদল। মোহনবাগান থেকে ইস্টবেঙ্গলে যাওয়া যায়। বিরোধী থেকে শাসক দলে এলেই দোষ? কেউ তো ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল হতে চাইতেই পারে। বাইরে যা ঘটছে ঘটুক, চোখ বুজে থাকলেই হল। আমি জানি না বললেই ল্যাঠা চুকে যায়। সময়ের পর সময় দেওয়া যায়, যেন পরের ভোট এসে যায়। আপনি তো সেটাই করেছেন। ঠিকই করেছেন স্যার। বাইরে কে কী করছে, ওসব দেখার দরকার কী? আর বিরোধী থেকে যত শাসক দলে আসবে, ততই তো ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ’ চলবে। রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করতে হলে সেই অভিযান বিধানসভা থেকে শুরু হওয়াই ভাল। ওরা চ্যাঁচাচ্ছে, চ্যাঁচাতে দিন। আপনি যা করছেন, সেটাই করুন।
৯) রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা বলেন, হাউস বিরোধীদের। এখানে বিরোধীদের অধিকার থাকবে। আগের স্পিকার কথায় কথায় জ্ঞান সিং সোহনপাল, জয়নাল আবেদিন, সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়, সৌগত রায়দের মতো বিরোধীদের পরামর্শ নিতেন। অনেক সময় তাঁদের যুক্তি ও আইনি ব্যাখ্যাই মেনে নিতেন। এত উদারতা দেখানোর কোনও দরকার ছিল? না হয়, তাঁরা লেখাপড়া করেন, আইনটা বোঝেন, তাই বলে তাঁদের পরামর্শ নিতে হবে? আপনি যেটা জানেন, সেটাই আইন। এর বাইরে অন্য ব্যাখ্যা নেওয়ার দরকার কী? শাসক দল স্পিকার করল, বিরোধীদের পরামর্শ নিতে যাবেনই বা কেন? শাসকরা চিৎকার করবে, ওয়েলে নেমে আসবে, বিরোধীদের ওপর হামলা করবে, মহিলা বিধায়কদের পেটাবে, গালাগাল দেবে, এটাই তো নিয়ম। সাত বছরেও বিরোধীরা এটা বুঝল না। বাকি কয়েক বছরে আরও ভাল করে বুঝিয়ে দিন।
১০) পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি নিয়ে কত বিতর্কই না হল। আপনি চেয়ারম্যান করলেন মানস ভুঁইয়াকে। তখন তিনি ছিলেন কংগ্রেসে। কদিন পরেই তিনি তৃণমূলের রাজ্যসভার সাংসদ হয়ে গেলেন। আপনি সত্যিই জহুরি স্যার। তখনই ঠিক চিনে নিয়েছিলেন। ঠিক ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞে’ সামিল করে নিয়েছেন। সারা ভারতে এমন নজির আছে? এখানেও আপনি ইতিহাস তৈরি করেছেন স্যার। আপনার বিরুদ্ধে কিনা অনাস্থা!
এ তো স্যার সবে দশ দফা। এমন কত দফা লেখা যায়! সুজন চক্রবর্তী বা আব্দুল মান্নানরা প্রেস কর্নারে যা বলছে, বলতে দিন স্যার। হাউসের ভেতর না বলতে পারলেই হল। স্যার, আরও একটা ভাল বুদ্ধি দিচ্ছি। ওরা একসঙ্গে প্রেস কর্নারে ভাষণ দিচ্ছে। দুপুরদিকে কোনও কোনও চ্যানেল সেগুলো লাইভ দেখিয়েও দিচ্ছে। ওই প্রেস কর্নারের ঠেকটা ভাঙতে হবে স্যার। দিন দেখি একটা তালাচাবি লাগিয়ে।