মেয়ে দুটিকে জঙ্গি বানানোর আগে সত্যিকারের তদন্ত হোক

স্বরূপ গোস্বামী

আমাদের মুখ্যমন্ত্রী নিজের নিরাপত্তা নিয়ে একেবারেই চিন্তিত নন। তিনি একেবারেই সাধারণ মানুষের সঙ্গে থাকেন। সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝতে পারেন। তাঁদের সঙ্গে মেশেন।

হামেশাই এমনটা শোনা যায়। তৃণমূলের লোকেরা বলেন। বশংবদ বুদ্ধিজীবীরা বলেন। মিডিয়ার লোকেরাও বলেন। কিন্তু দুজন মেয়ে মুখ্যমন্ত্রীর মঞ্চে উঠে যাওয়ায় কী কাণ্ডটাই না হচ্ছে!‌ পুলিশ অতিরিক্ত উৎসাহে যা যা করে চলেছে, এটা ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ ছাড়া সম্ভব?‌

কী করে মেয়েটি উঠে পড়ল মঞ্চে, এটাই যেন রাজ্যের সবথেকে বড় সমস্যা। এমন ভাব করা হচ্ছে, যেন মেয়েটি খুন করতে উঠেছিল। কোথায় গলদ ছিল, তা নিয়ে পুলিশ আত্মসমীক্ষা করতেই পারে। কিন্তু মেয়ে দুটিকে কার্যত জঙ্গি বানিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে। সেদিনই চূড়ান্ত নির্যাতন হয়েছে। পাঁচদিন পেরিয়ে যাওয়ার পরেও তাঁরা হাসপাতালে বন্দী। চূড়ান্ত মানসিক নির্যাতনের শিকার। বিধানসভায় এসব তোলা যাবে না। কোনও মিডিয়া একটু বেসুরো লিখলেই বিজ্ঞাপন বন্ধ।

hemtabad2

কিছু একটা ঘটলেই ‘‌খুনের চক্রান্ত’‌ বলে দেওয়াটা একটা মানসিক ব্যধিতে পরিণত হয়েছে। একদিন বিমান নামতে দেরি হল। অমনি পাইলটকে কার্যত জঙ্গি বানিয়ে দেওয়া হল। তাঁকে নাকি খুনের চক্রান্ত হয়েছে। অর্থাৎ, কেন্দ্রীয় সরকার পাইলটকে নির্দেশ দিয়েছে, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী যে বিমানে যাচ্ছে, সেটা যেন অ্যাক্সিডেন্ড হয়। অর্থাৎ, কেন্দ্রের নির্দেশ পালন করতে গিয়ে পাইলট নিজেও মরতে চেয়েছিলেন।

এই অভিযোগ নিয়ে চিঠি চাপাটি হয়েছে। প্রেস কনফারেন্স হয়েছে। সংসদে হইচই হয়েছে। কোনও অভিযোগ করার আগে সেটা আদৌ আষাড়ে গল্প মনে হচ্ছে কিনা, তা ভেবেও দেখা হবে না?‌ হেমতাবাদের ক্ষেত্রেও সেটাই হল। একটি মেয়ে তার বাবার খুনের বিচার চাইতে গিয়েছিল। মঞ্চে ওঠা অবশ্যই অন্যায় হয়েছে। তাই বলে এরকম হেনস্থার শিকার হতে হবে?‌ তাকে কার্যত জঙ্গি বানিয়ে দেওয়া হবে?‌ আড়ালে অন্য মাথা আছে কিনা, এসব গপ্পো ফাঁদা হবে?‌

পুলিশ যদি সত্যিই তদন্ত করতে চায়, অনেকগুলি বিষয় নিয়ে তদন্ত করতে পারে। ওই মঞ্চ ও প্যান্ডেল কারা বানিয়েছিল?‌ কোচবিহার বা পুরুলিয়া বা হেমতাবাদে প্যান্ডেল করার বরাত দক্ষিণ কলকাতার ডেকরেটর পায় কীভাবে?‌ কোনও জেলায় কেউ প্যান্ডেল বানাতে পারে না?‌ প্রতিটি সভায় দক্ষিণ কলকাতার পেটোয়া সংস্থাকে দিয়ে প্যান্ডেল বানাতে হবে?‌ কত টাকার বরাত?‌ অন্য কোনও লেনদেন নেই তো?‌ পুলিশের সৎ সাহস থাকলে একটু তদন্ত করুন তো।

ওই মঞ্চ তো সরকারি জনসভার। জেলার বিভিন্ন দলের বিধায়ক ও সাংসদদের থাকার কথা। হেমতাবাদ তো রায়গঞ্জ লোকসভার মধ্যে পড়ে। সেখানকার সাংসদ মহম্মদ সেলিম। কই, তিনি তো আমন্ত্রণ পাননি। যে এলাকায় সভা, সেই হেমতাবাদে তো সিপিএমের বিধায়ক। কই, তিনি তো আমন্ত্রণ পাননি। চাকুলিয়া, রায়গঞ্জ, কালিয়াগঞ্জেও বিরোধী বিধায়ক। কই, তারাও তো আমন্ত্রণ পাননি। নানা তকমা নিয়ে দলের লোকেদেরই ভিড়। তাহলে, এটাকে প্রশাসনিক সভা বলা যায়?‌ বিরোধী সাংসদ ও বিধায়কদের বাদ দিয়ে সরকারি বিজ্ঞাপন কারা তৈরি করলেন, কার নির্দেশে?‌ কার ‘‌অনুপ্রেরণা’‌য় ?‌ একটু তদন্ত করুন না।

hemtabad3

ওই সভায় কারা এসেছিলেন?‌ অসংখ্য স্কুলের ছাত্রী। এই চড়া রোদে কে তাঁদের ধরে আনলেন?‌ স্কুলগুলিকে ফতোয়া দেওয়া হয়েছিল কিনা, একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন তো। প্রতিটি সভায় যাঁরা আসেন, অন্তত আশি শতাংশ বেনিফিসিয়ারি। হয় কন্যাশ্রী, নয় যুবশ্রী, নয় ক্লাবের অনুদান, নইলে গীতাঞ্জলি, না হলে লোকশিল্পী ভাতা। তাঁদেরই কার্যত জোর করে ধরে আনা হয়। অফিসারদের সেই ‘‌ছেলেধরা’‌র দায়িত্ব পালন করতে হয়। গাড়ি থেকে খাওয়া দাওয়ার বন্দোবস্তও করতে হয়। আর মুখ্যমন্ত্রী সেখানে মনের সুখে সিপিএম–‌কে, বিজেপি–‌কে গালাগাল দিতে থাকেন। আশা কর্মীদের, আইসিডিএস কর্মীদের হুমকি দিতে থাকেন। পঞ্চায়েতে তাঁদের না জেতালে কাজ হবে না, কার্যত এমন বার্তা দিতে থাকেন। সরকারি টাকায় নিজের প্রচারের ঢাক পেটাতে থাকেন। টিভিতে যেন সেগুলি লাইভ দেখানো হয়, তার জন্য ‘‌বিজ্ঞাপন’‌ নামক সরকারি ঘুষ দিতে হয় (‌না দেখালে বিজ্ঞাপন বন্ধের অলিখিত ফতোয়া তো আছেই)‌। এই নির্লজ্জ সভার নাম প্রশাসনিক সভা। এসব নিয়ে কোনও তদন্ত হবে?‌

এসব সভার পেছনে, বা প্যান্ডেলের পেছনে কত খরচ হয়, সেগুলো কখনই সামনে আসবে না। বিধানসভায় প্রশ্ন করলেও উত্তর পাওয়া যাবে না। জানতে চাইতে পারত পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি। সেই কারণেই সেটা বিরোধীদের হাতে ছাড়া যায় না। সব রীতিনীতি ভেঙে নিজেদের দলে নাম লেখানো পেটোয়া লোককে চেয়ারম্যান বানাতে হয়।

অসহায় মেয়ে দুটিকে জঙ্গি তকমা দেওয়ার আগে এগুলো নিয়ে তদন্ত করুন। নিশ্চিত থাকা যায়, এসব নিয়ে কোনও তদন্তই হবে না। কারণ, কেঁচো খুঁড়তে গেলে অনেক সাপ বেরিয়ে আসবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.