বিকল্প মুখ ভাবা হোক নজরুলকে

(‌ গত বছর রাজ্যসভা নির্বাচনের ঠিক আগের লেখা। বেঙ্গল টাইমসে প্রকাশিত হয়েছিল ২৭ জুলাই (‌২০১৭)‌। বিরোধীদের সর্বসম্মত প্রার্থী কে হতে পারেন, তা নিয়েই লেখা। আবার রাজ্যসভা নির্বাচন। পরিস্থিতি কিছুটা একইরকম। সেই লেখাটি হুবহু প্রকাশ করা হল। সুস্থ আলোচনা ও বিতর্ক হোক। )‌

 

স্বরূপ গোস্বামী

হাতে আর সময় নেই। রাজ্যসভায় তৃণমূলের কারা প্রার্থী হবেন, দেড় মাস আগে ঘোষণা করে দিয়েছিলেন তৃণমূল নেত্রী। পাঁচজনই মনোনয়নপত্র জমাও দিয়ে দিলেন। অথচ, এখনও প্রার্থীই ঠিক করে উঠতে পারল না বাম শিবির। সীতারাম ইয়েচুরি প্রার্থী হবেন কিনা, সেটা সিদ্ধান্ত নিতে তিন–‌চার মাস লেগে গেল। একটা সামান্য সিদ্ধান্ত নিতে এত গড়িমসি কীসের?‌ যদি দল মনে করে, ইয়েচুরিকে প্রার্থী করা যাবে না, সেই সিদ্ধান্ত চূড়ান্তভাবে জানাতে এতদিন লেগে গেল?‌

কয়েকদিন আগেই রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কংগ্রেসের প্রস্তাবিত প্রার্থীর হয়ে ভোট দিলেন বাম বিধায়ক–‌সাংসদরা। হঠাৎ করে কংগ্রেস অস্পৃশ্য হয়ে গেল?‌ কংগ্রেসের সমর্থন নেওয়া যাবে না?‌ রাজ্যসভায় যদি কংগ্রেস প্রার্থী দেয়, সেই প্রার্থীকে সমর্থন দেওয়া যাবে না?‌ কাদের হাতকে শক্তিশালী করতে চাইছেন বাম নেতৃত্ব, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না।

২০০৮ সালে ইউপিএ ওয়ান থেকে আচমকাই সমর্থন তুলে নিয়ে কংগ্রেস আর তৃণমূলকে কাছাকাছি এনে দিয়েছিলেন প্রকাশ কারাট অ্যান্ড কোং। ফল কী হয়েছিল, সবাই জানেন। আবার সেই একই ভুল করতে চলেছেন। আবার সেই কংগ্রেস আর তৃণমূলকে কাছাকাছি এনে দিচ্ছেন। ক্ষতি যা হওয়ার হয়েই গেছে। সেসব প্রশ্ন আপাতত মুলতুবি থাক। এই পরিস্থিতিতে কী করা দরকার?‌ বল এখন রাজ্য নেতৃত্বের কোর্টে।

nazrul3

কংগ্রেস প্রার্থীকে সমর্থন করতে যদি আপত্তি থাকে, তাহলে সম্মিলিতভাবে এমন একজনকে প্রার্থী করা হোক, যিনি উভয় শিবিরের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে পারেন। এর আগে শঙ্কর রায়চৌধুরি, অর্জুন সেনগুপ্ত বা মালিয়াবাদিকে প্রার্থী করা হয়েছিল। এবারেও তেমন অরাজনৈতিক মুখকে সামনে আনা যেতেই পারে। কিন্তু আশঙ্কা হয়, ‘‌অরাজনৈতিক মুখ’ বাছতে গিয়ে আবার কোনও ভুলভাল নাম সামনে না চলে আসে। মালিয়াওয়াদিকে পাঠিয়ে কী বৃহত্তর লাভ হয়েছে, বাম নেতৃত্বই জানেন। এখানেও জাতপাত, সংখ্যালঘু— এসব বিষয় বড় না হয়ে দাঁড়ায়। রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে বিজেপি দলিত প্রার্থী দিয়েছিল। অতএব আমাদেরও দলিত তাস খেলতে হবে। সম্মিলিত বিরোধীরা প্রার্থী করে দিলেন মীরা কুমারকে। এই দেউলিয়াপনা বন্ধ হওয়া দরকার। এমন একজনকে প্রার্থী করা হোক, যিনি এই বাংলারই মানুষ। এবং অবশ্যই বাংলা ভাষায় কথা বলা মানুষ। বাংলার মানুষ যাঁকে চেনেন, জানেন। জনমানসে যাঁর স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও বিশ্বাসযোগ্যতা রয়েছে। যিনি নিজের কাজটা সৎভাবে করেছেন। সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও যিনি নানা উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে যুক্ত থেকেছেন।
এমন একজনের নাম মনে পড়ছে। নজরুল ইসলাম। হ্যাঁ, আইপিএস নজরুল। সৎ পুলিস হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করেছেন। কখনও শাসকদলের তাঁবেদারি করেননি (‌সেই কারণেই কোণঠাসা থেকে গিয়েছেন)‌। যথেষ্ট শিক্ষিত, মার্জিত রুচির মানুষ। যথার্থই ধর্মনিরপেক্ষ। একেবারে অজ পাঁড়া গাঁ থেকে উঠে আসা একজন মানুষ। আইপিএস হয়ে সেই গ্রামকে ভুলে যাননি। যে গ্রামে একটি প্রাইমারি স্কুলও ছিল না, সেই গ্রামে নিজের চেষ্টায় ডিগ্রি কলেজ থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, শিক্ষার পরিকাঠামোয় আমূল পরিবর্তন এনেছেন। পুলিশের উর্দি গায়ে দিলেও সাহিত্য–‌সংস্কৃতির সঙ্গে নিবিড় যোগ। পিএইচডি–‌র বিষয় বাংলা সাহিত্য। অসংখ্য বই লিখেছেন। যেসব বই থেকে গ্রাম বাংলা, পুলিশ প্রশাসন, ধর্মীয় কুসংস্কারের অনেক অজানা দিক জানা যায়। তৃণমূল যখন ত্বহা সিদ্দিকি, বরকতিদের তোল্লাই দেয়, তখন নজরুলই হয়ে উঠতে পারেন বিকল্প মুখ। তাছাড়া, এই সরকারের কাছে তিনিও কম নির্যাতিত হননি। চাকরি জীবনের শেষদিনেও চূড়ান্ত অপমানিত হয়ে বিদায় নিতে হয়েছে। পাছে মুখ্যমন্ত্রী রেগে যান, তাই বিদায়বেলায় কেউ একটি ফুলের তোড়াও দিতে আসেননি। একা একাই নিঃশব্দে বিদায় নিয়েছেন কর্মস্থল থেকে।
‌নজরুল মানেই সততা। নজরুল মানেই প্রগতিশীল এক কণ্ঠস্বর। এমন মানুষকে বিকল্প হিসেবে তুলে ধরা যায় না?‌ পুলিশ কমিশনার হওয়ার সমস্তরকম যোগ্যতাই তাঁর ছিল। তবু কোন দুর্বোধ্য কারণে তাঁকে ব্রাত্য রাখা হয়েছিল, আজও তা রহস্যই থেকে গিয়েছে। সময় এসেছে সেই ভুল শুধরে নেওয়ার। বাম ও কং নেতৃত্ব নতুন করে ভাবুন। এমন একজনকে এই বাংলা থেকে পাঠান, যিনি সত্যিই বিকল্প মুখ হয়ে উঠতে পারেন। তৃণমূলের পাঁচ প্রার্থীর তুলনায় যাঁকে সত্যিই অনেক উজ্জ্বল মনে হবে।

 

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *