শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের দিনেই যে নারীর জন্ম। মাতৃভাষায় কথা বলার স্বাধীনতার জন্য বাংলাদেশের মানুষ লড়াই করেছিলেন। সেই বাংলাদেশের কুমিল্লার এক কিশোরী দেশভাগের সময় কলকাতা চলে এসছিল দারিদ্রের কারণে এবং নিজের পায়ে দাঁড়ানোর স্বাধীনতার জন্য লড়াই করেছিল সে। নদীপথে কলকাতায় এসে খালি পায়ে তাকে হেটে যেতে হয়েছিল মানিকতলা থেকে বরানগর দিদির শ্বশুরবাড়ি। সেখান থেকে আবার চলে এলেন টালিগঞ্জ থানায়। জামাইবাবু সেখানকার ওসি। সেইসুত্রে থাকা। ভর্তি হলেন স্কুলে। কিন্তু ছোটো থেকেই মন সিনেমার দিকে। টালিগঞ্জ পাড়াতেই যেহেতু থাকা, তাই যেতে আসতেই চোখে পড়ত তার সিনেমার সব আর্টিস্টদের। সিনেমায় চেনা সবার নামও সে জানত না। এতই সিনেমার নেশা কোনও সিনেমার তারকাকে দেখলে ব্যস সেদিন স্কুলে না গিয়ে সোজা বাড়ি। এর জন্য দিদির কাছে মারধরও খেতেন। কিন্তু তার সিনেমার নেশার ভবি ভোলবার নয়। তার সুন্দর চোখ বলে অনেকেই বলতেন ‘কানন দেবীর মতো চোখ’। সেই শুনে চরম দারিদ্রেও সে স্বপ্ন দেখত সেও কানন দেবীর মতো হবে। একদিন আরও অভিনব ঘটনা ঘটল তার জীবনে। টালিগঞ্জ পুলিশ আপিসে কানন দেবী তাঁর স্বামীর সঙ্গে এলেন একটা চুরির ঘটনার কিনারা করতে। সেখানেই তিনি এই কিশোরীটিকে খেলতে দেখে বললেন, কাননবালা তাঁর স্বামীকে ‘দেখো মেয়েটির চোখ দুটো কী সুন্দর’। কাননবালার স্বামী বললেন ‘হ্যাঁ একদম তোমার মতো’। ব্যস আর যায় কোথায়! এতদিন লোকমুখে যা শুনত স্বয়ং কাননদেবী সেকথা বললেন। ওই শুনে ওই কিশোরী স্কুলে যাওয়াই বন্ধ করে দিলেন। ক হপ্তা পর আবার ওই স্বপ্নাবেশ কাটলে তাকে স্কুলে পাঠানো গেল। একদিন সিনেমা হলে সিনেমা দেখতে গিয়ে আরেক কান্ড। হইহই পড়ে গেছে সিনেমা হলে সন্ধ্যারানী এসছেন। ভিড়ে ভিড়। এই কিশোরী তো তখনকার টপ হিরোইন সন্ধ্যারানীকে দেখার জন্য পাগল। এতই ছোটো সে যে ভাল করে দেখতেই পাচ্ছে না। শেষমেশ সন্ধ্যারানীর মুখ দেখতে পাওয়া তো দূর, সন্ধ্যারানীর একটা কান দেখতে পেল সে ভীড়ের মধ্যে। ব্যস আবার স্বপ্নাবেশে চলে গেল সে। সে ঘোর আর কাটে না।
এভাবেই একদিন স্কুল যাবার পথে সাম্যময় বন্দ্যোপাধ্যায় ওরফে ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তাঁর দেখা। ‘নতুন ইহুদি’ নাটকে বাঙাল বলা মেয়ে দরকার। বাড়ির অনুমতি পাওয়া গেল কার ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাদের আত্মীয় হতেন। ওই শুরু। সেদিন তার পরে যাবার একটা জুতো ছিল না। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁকে বলেছিলেন ‘জুতো ছাড়া কলকাতা শহরে চলা যায় না’। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় তাকে জুতো কিনে দেন। সেই জুতো বহুযুগ সাবিত্রী যত্ন করে রেখে দেন। কারন জীবনে প্রথম পাওয়া ‘উপহার’। ‘নতুন ইহুদি’ নাটক থেকে সুযোগ এল ‘পাশের বাড়ি’ হাসির ছবিতে অভিনয় করার। সেই প্রথম ছবি জীবনে প্রবেশ। সুপারহিট করল ‘পাশের বাড়ি’। এরপরই ভাগ্য খুলে গেল। এরপরই নীরেন লাহিড়ীর ছবি ‘শুভদা’ আর ‘কাজরী’।
কার কথা বলছি?
…..ঠিক ধরেছেন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়।
‘পাশের বাড়ি’ ছিল হাসির ছবি। সেই কমেডি ছবির অভিনেত্রীকে কেউ দুঃখের গল্পে নায়িকা করতে চায়নি। একদিন সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের কাছে এলেন তখনকার নামজাদা নায়িকা সুনন্দা দেবী। পরপর দুটো ছবিতে সাইন করালেন। শুভদা’ আর ‘কাজরী’। তিনি ছিলেন ওই ছবি দুটির প্রযোজক। পরিচালক ছিলেন নীরেন লাহিড়ী। সুনন্দা দেবী ভরসা করলেন এই সাবিত্রী হাসির রোল করলেও দুঃখের ছবি দুটোর নায়িকা হতেও পারবে। শ্যুট শুরু হল।’শুভদা’ সুপারহিট করল। ওদিকে ‘কাজরী’ র শ্যুটে ঘটল আরেক যুগান্তকারী ঘটনা। সেখানেই প্রথম সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে দেখা হল সুচিত্রা সেন র। সুচিত্রা তখন ‘সাত নম্বর কয়েদী’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’ করে পরিচিত নায়িকা। তবু তাকে ‘কাজরী’র নায়িকার রোল থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়।নায়িকা করা হয় সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়কে।আর তার বোনের ভূমিকায় সুচিত্রা সেন।সুচিত্রা সেই রোল করতে বাধ্য হন আর্থিক কারণে। কিন্তু ঘটল আরও ঘটনা। ছবির প্রোমোশনাল ওয়ার্কে পোস্টারে লিড ক্যারেক্টারের ছবি আছে সাবিত্রী, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ। কিন্তু সুচিত্রা সেনের ছবি পোস্টারে নেই। সেই অপমান দীর্ঘদিন মনে রেখেছিলেন সুচিত্রা। নীরেন লাহিড়ীর ছবিতে বহুদিন কাজ করেননি নায়িকার রোল পেয়েও ।
ওই ঘটনার পর সত্যিই কী নীরেন লাহিড়ীর আর কোনো ছবিতে সুচিত্রা সেন অভিনয় করেননি রাগে অপমানে?
হুম অবশ্যই করেছেন বহু পরে, কিন্তু একজন বিশেষ মানুষের অনুরোধে সুচিত্রা সেন আবার নীরেন লাহিড়ীর ছবিতে অভিনয় করেছিলেন বটে! সেই বিশেষ মানুষের অনুরোধ সুচিত্রা সেন সাধারণত ফেলতেন না। নীরেন ম্যাডামকে রাজী করাতে অনুরোধ করেন স্বয়ং উত্তম কুমার কে।সেই ছবিতে সুচিত্রাকে অভিনয় করতে অনুরোধ করেছিলেন উত্তম কুমার। যিনি ছবিতে সুচিত্রা সেনের বিপরীতে অভিনয় করেছিলেন। আর ছবিটির নাম হল “ইন্দ্রাণী”।
ততদিনে ওদিকে উত্তমের নায়িকাও সাবিত্রী। উত্তম সুচিত্রা সেরা জুটি হলেও উত্তমের সঙ্গে সবচেয়ে ছবির সংখ্যা বেশি সাবিত্রীর। উত্তম–সুচিত্রা– সাবিত্রী ট্রায়ো কি দারুণ করেছিলেন ‘অন্নপূর্ণার মন্দির’ কিংবা ‘গৃহদাহ’।
উত্তম সাবিত্রী সুপ্রিয়ার আরেক ঐতিহাসিক ছবি ‘উত্তরায়ণ’। যে ছবির জন্য সাবিত্রী প্রথিতযশা নায়িকা হয়েও তাকে দুবার স্ক্রিনটেষ্ট দিতে হয়। সে সময় রটে গেছিল সাবিত্রী খুব মোটা হয়ে গেছেন। অবসাদ মদ্যপানের নেশাতেও ছিলেন জীবন যৌবনের বিভিন্ন ঘাত প্রতিঘাতে। যদিও এককালে মদ্যপানকে খুব ভয় পেতেন সাবিত্রী। তো মোটা হলেও ছবি করতে পারবেন না এমন নয়। ‘উত্তরায়ণ’ ছবির পরিচালক বিভূতি লাহা সাবিত্রীর আপনজন হলেও দুবার স্ক্রিনটেষ্ট নিতে বাধ্য হন প্রযোজকের চাপে। সাবিত্রী উতরে যান। এবং সেই ঐতিহাসিক রোলটি করেন।
“উত্তরায়ণ” ছবির সতী সাবুদিকে মনে পড়ে? যার ভাগ্যে ছিল বৈধব্যযোগ। তাই শিশু বয়সেই তাকে শালগ্রাম শিলার সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হয়। এবং সে চিরসতী হয়। যৌবনে মানবরূপী স্বামী এলেও সে সতীর পুণ্য গুণে বাঁচলে ভাল আর মরলে সতী কোনদিনও বিধবা হবে না। যৌবনে তার বিয়ে হল কিন্তু স্বামী রতন যুদ্ধে সেনাবাহিনীর কাজ করতে গিয়ে মারা গেল। রতনের মতই অবিকল দেখতে রতনের সহকর্মী উত্তমকুমার এসে যখন সতীর স্বামী রতনের মৃত্যু সংবাদ দেয় তখন অশীতিপর শাশুড়ির মুখ চেয়ে সাবিত্রী ওরফে সতী উত্তমকে অনুরোধ করে বৃদ্ধা শাশুড়ির মুখ চেয়ে রতন হয়ে তার স্বামী সেজে অভিনয় করতে।স্বামী মরলেও সে বিধবা হবেনা শাঁখা সিঁদুর পরলে মাছ খেলেও দোষ হবেনা কারন সেই মেয়েবেলার ভগবান পুরষোত্তমের সঙ্গে বিয়ে এবং তাই হয়।যেখানে সংসার ছিল কিন্ত কোন কায়ার সম্পর্ক ছিলনা।উত্তম হল স্বামীহারার স্বামী,পুত্রহীনার পুত্র,মানুষ ছিল হল দেবতা।মাঝে রয়ে গেল উত্তমের নিজ প্রেমিকা আরতি নামক সুপ্রিয়া।উত্তম সাবিত্রীর স্বর্গীয় প্রেম রচিত হল যেখানে কোন শরীরের চাহিদা নেই।
‘কালকেউটের ফণায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি বেহুলা কখনও বিধবা হয়না এটা বাংলার রীতি’
সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের জীবনটাও কি মিলে যায়না অনেকটা এ গল্পের সঙ্গে?
সাবিত্রী সারাজীবনে যদি কাউকে ভালোবেসে থাকেন সে উত্তম। সাবিত্রীর চোখের ভালবাসার ভাষায় ডুবে যেতেন উত্তম।”টালার ট্যাঙ্ক” বলা হত সাবিত্রীর চোখকে ব্যঙ্গ করে। কিন্তু না ওই চোখের দিকে চেয়ে উত্তম অভিনয় করতেও ভয় পেতেন। সাবিত্রীর চোখের অনবদ্য আকর্ষণের ‘কুহক’ই তো মহানায়ককে দিয়ে গাইয়ে নিয়েছে ‘আরও কাছে এসো … যায় যে বয়ে রাত৷’ সারাটি দিন ধরে চেয়ে থেকেও তাঁর মনের কথা তবু জানা যায় না৷
সুচিত্রার আভিজাত্য, চোখ ঝলসানো রূপ কিংবা সুপ্রিয়ার যৌনলাস্য সাবিত্রীর ছিল না, কিন্তু ছিল ওই দুটো চোখ।
”প্রহর শেষের আলোয় রাঙা
সেদিন চৈত্রমাস
তোমার চোখে দেখেছিলাম
আমার সর্বনাশ ! ”
একবার তো উত্তম ও সাবিত্রীকে একসঙ্গে দেখে সুচিত্রা বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ রে উতু, সেই তো ঘর ছাড়লি, সাবি (সাবিত্রী) কী দোষ করেছিল রে।ও তোকে তো খুব ভালোবাসে।’ সুচিত্রার মুখে এ কথা শুনে সেদিন লজ্জায় লাল হয়ে গিয়েছিলেন সাবিত্রী।
টলিপাড়ার সব প্রজন্ম যে নায়িকাকে নিয়ে এক বাক্যে প্রশংসায় মেতে ওঠে তিনি সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়। উত্তম কুমার, ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, পাহাড়ি সান্যাল, ছবি বিশ্বাস কমল মিত্র সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের কাছে তিনি যেমন প্রিয় ‘সাবু’, ঠিক তেমনই নতুন প্রজন্মের কাছেও সমান জনপ্রিয় সাবিত্রী। আজ ২১ ফেব্রুয়ারী বাংলা ভাষাদিবসেই জন্মদিন এই অশীতিপর নায়িকার। জন্মদিনে শ্রদ্ধা ও প্রণাম।