ঠিক এক বছর আগে, এই দিনেই চলে গিয়েছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেল। গানের কিছু অজানা গল্প নিয়ে ফিরে দেখা প্রয়াত শিল্পীকে। মর্মস্পর্শী লেখা শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের।
“বনশ্রী মানেই তো বনের শ্রী। ফরেস্ট বিউটি। নির্মলাদি (নির্মলা মিশ্র), আমাকে ফরেস্ট বিউটি বলে ডাকেন। আসলে তখন সকলেই সকলের দিদি, বোন, বন্ধু।” – বনশ্রী
ফরেস্ট বিউটি নামেই শিল্পীমহলে জনপ্রিয় হয়ে গেছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। দেখতে দেখতে এক বছর হয়ে গেল তাঁর প্রয়াণ দিবস। আজকের দিনেই গতবছর জীবনাবসান হয় সঙ্গীতশিল্পী বনশ্রী সেনগুপ্ত-র।
তাঁর গানের গুরু ছিলেন প্রখ্যাত সুরকার সুধীন দাশগুপ্ত। বনশ্রীর অজস্র গানের সৃষ্টিকর্তা যিনি এবং প্রতিটি গানের পিছনে আছে এক একটি ঘটনা। যা ঘটেছিল বনশ্রীর জীবনে। সেই ঘটনাপ্রেক্ষিতে গান তৈরি করেন সুধীন দাশগুপ্ত।

যেমন বনশ্রী সেনগুপ্ত-র হিট গান।
‘অন্ধকারকে ভয় করি, এসো না তোমার হাত ধরি।’
কীভাবে এই গান সৃষ্টি হল জানেন?
দুর্গাপুরে গানের অনুষ্ঠান করতে গেছিলেন বনশ্রী সেনগুপ্ত। সঙ্গে গেছিলেন কর্তা শান্তি সেনগুপ্ত। বনশ্রীর গানে যাঁর অবদান বলে শেষ করা যাবে না। কলকাতায় সমস্ত বড়মাপের সঙ্গীত শিক্ষক সুরকারের কাছে স্ত্রীকে সঠিক তালিমে গান শেখার ব্যবস্থা করে দেন তিনি। বনশ্রী যে সংসার করেও শিল্পী হতে পেরেছেন তার পেছনে মূল কারিগর তাঁর স্বামী শান্তিবাবু। বড্ড মাটির মানুষ। শান্তি বাবুর প্রয়াণের পর খুব একাকিত্বে ভুগতেন বনশ্রী। হয়তো তাই আরও তাড়াতাড়ি নিজেও চলে গেলেন এই শিল্পী।
হ্যাঁ যে ঘটনার কথা বলছিলাম, দুর্গাপুরে গানের অনুষ্ঠানে গান গাওয়া শেষ করে উঠতে যাবেন বনশ্রী, হঠাত্ লোডশেডিং৷ সে সময় জেনারেটরের ব্যবস্থা থাকত না৷ তাও আবার কলকাতা নয়। মঞ্চ থেকে কী করে উঠবেন বনশ্রী? সব ঘুটঘুটে অন্ধকার। তখন হঠাৎ এক ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে দিলেন বনশ্রীর দিকে।
বনশ্রী অন্ধকারে ভাবলেন তাঁর কর্তা শান্তি সেনগুপ্ত-র হাত। খুব পরম ভরসায় সে হাত ধরে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে এলেন বনশ্রী। আলোয় এসে দেখেন বনশ্রী, অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখানো সেই সখা তাঁর জীবনসখা নয়। ওই দুর্গাপুর অঞ্চলেরই অন্য এক ভদ্রলোক। বনশ্রী বেশ লজ্জাই পেয়ে যান। পরের দিন সুধীন দাশগুপ্ত র কাছে গানের ক্লাসে গিয়ে সুধীনবাবু বনশ্রীকে জিজ্ঞেস করেন কাল কোথায় গানের অনুষ্ঠান করতে গেছিলে! বনশ্রী দুর্গাপুরের সেই লোডশেডিং থেকে উদ্ধারকারী ভদ্রলোকের কথা সেই ঘটনা বলেন গুরু সুধীন দাশগুপ্তকে।
সুধীনবাবু সব শুনে বলেন, ‘এবার তোমার পুজোর গান পেয়ে গিয়েছি৷’
কী গান,
গান ঝরঝর করে লিখে তাতে সুর দিয়ে দিলেন গুরু,
‘অন্ধকারকে ভয় করি এসো না তোমার হাত ধরি
দুজনে যাবো না হয় হারাবো
দুচোখে রেখে আলোর প্রহরী
অন্ধকারকে ভয় করি।
রাত যেন কোন দুঃসাহসে এগিয়ে যেতে চায়
কোন রহস্যের আলো দেখিয়ে অন্ধকার না চায়
চমকে দিয়ে যায় আতঙ্কে ছায়ার সহচরী।’
সুধীন দাশগুপ্ত বনশ্রীকে দিয়ে ছায়াছবির গানের চেয়ে বেশি আধুনিক গান গাইয়েছেন। আবার অনেক ছবির গান বনশ্রী ছেড়েছেন কিংবা ভাগ্যফেরে গাওয়া হয়নি।
দীনৈন গুপ্তর ‘বসন্তবিলাপ’ ছবিতে দোলের দৃশ্যে সুপারহিট দোলের গান ‘ও শ্যাম যখন তখন’ ডুয়েট গানটা গাইতে চাননি বনশ্রী। আরতির সঙ্গে ডুয়েট। বনশ্রী না করায় আরতির সঙ্গে গানটা গেয়েছিলেন সুধীন দাশগুপ্ত-র আর এক ছাত্রী, সুজাতা মুখোপাধ্যায়৷
গানটা যখন হিট করে অপর্না সেন কাজল গুপ্ত সুমিত্রা মুখোপাধ্যায়ের দৃশ্যায়নে প্রতিবার দোলে আজও বাজে চারদিকে তখন বনশ্রী আফশোস করেন গানটা ডুয়েট গাইতে না করার জন্য। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মান্না দে কেউ সেভাবে তাকে দিয়ে গান করাননি। দু একটা হিট গান বাদে।
বনশ্রী আরেক গুরুমা ছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। যার কাছে গান না শিখলেও সন্ধ্যাকন্ঠী হিসেবেই ক্যারিয়ারের শুরুর দিকে ফাংশান করে বেরোতেন তিনি। হাউসফুল সেসব ফাংশান। সুধীন দাশগুপ্তকে বলেছিলেন তিনি সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় হতে চান।গুরু সুধীন বাবু বলেন ‘নিজের স্টাইল নিজস্বতা তৈরী কর।’
সেই কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন তারপর থেকে বনশ্রী।তবু তাঁর প্রথম ভালোবাসা সন্ধ্যাদি।
সারাজীবনে আরেকটা বড় আফশোস রয়ে গেছিল বনশ্রীর।তাঁর গুরুমা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় মানেই সুচিত্রা সেনের লিপে গান।যেসব গান সব অনুষ্ঠানে গেয়ে গেয়েই নাম করেন বনশ্রী শুরুর দিকে।বনশ্রীর খুব ইচ্ছে ছিল সুচিত্রা সেনের লিপে নিজের একটা গানও যেন থাকে তাঁর সঙ্গীতজীবনগ্রাফিতে।
বলেছিলেন ‘”সুচিত্রা সেনের লিপে আমার গান নেই। এটা আমার একটা দুঃখের জায়গা। সন্ধ্যাদি আর আরতিদিরা এক্ষেত্রে সত্যি লাকি। নায়িকার লিপে সত্যি তেমন ক্যাচি গান কিন্তু আমি পাইনি…
আসলে শিল্পী তো! মন ভরে না কিছুতেই…” –
বনশ্রী আজ হয়তো কোথাও কর্তা জীবনসঙ্গী শান্তি বাবুর সঙ্গে আবার গুরু সুধীনদার গানের ক্লাসে গিয়ে কোন সরগমের তালিম নিচ্ছেন রেওয়াজ করছেন।


