কোথায় হারিয়ে গেলে বনলতা সেন .‌.‌.‌

শোভন চন্দ

অক্টোবর মাস, বাঙালি সাধারণত আনন্দ উৎসবে মেতে থাকে, এমনই এক সময়ে আজ থেকে ৬০ বছর আগে তিনি বিদায় নিয়েছিলেন তাঁর “রূপসী বাংলা “ থেকে। কেউ বলেন আত্মহত্যা কেউ বলেন পরলোক গমন, কিন্তু আসল বিষয়টি হল আমরা হারিয়েছিলাম বাংলা কাব্য জগতের অন্যতম আধুনিক পুরুষটিকে, রবীন্দ্রনাথের বাংলা কাব্য জগতে যিনি চিরদিনই অন্য পথের পথিক ছিলেন। বাংলা কাব্য জগত যখন রবীন্দ্রনাথের রোম্যান্টিকতায় মজে, যখন নজরুল আপন বিদ্রোহের ছন্দে বাংলার সাহিত্যাকাশে ঝড় তুলছেন, তখন কোন এক সন্ধ্যায় তাঁর ক্লান্ত প্রাণ গড়ে তুলছে নাটোরের বনলতা সেনকে যা আজও কোনও প্রেমিকের উষ্ণ ঠোঁটে তার প্রেমিকার সৌন্দর্যের বর্ণনা করে চলে।
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশ। এরা রবীন্দ্র-পরবর্তী কাব্য জগতে পঞ্চপাণ্ডবের আবির্ভাব ঘটে –বুদ্ধদেব বসু, অমিয় চক্রবর্তী, বিষ্ণু দে, সুধীন্দ্রনাথ দত্ত এবং জীবনানন্দ দাশ। আপন লেখনীগুণে বাংলা কাব্যজগতকে এক অনন্য আধুনিকতা দান করেন, তবে এঁদের মধ্যে জীবনানন্দ যেন এক ভিন্ন প্রতিভা ছিলেন, এ বিষয়ে জীবনানন্দ সম্পর্কে জয় গোস্বামী এক দারুণ উক্তি করেছেন- “আমি যখনই জীবনানন্দ পড়ি তখনই চেনা কবিতাকেও নতুন আলোকে দেখতে পাই”।

jibananda1
কুসুমকুমারী দেবীর “মিলু” শৈশব থেকেই একটু আলাদা ছিলেন, তাঁর এই ভাবনার ভিন্নতাই হয়ত কাব্য-সমুদ্রে সৃষ্টি করেছিল সেই দিশেহারা হাল ভাঙা নাবিককে। কুড়ি বছর বয়সেই ব্রহ্মবাদী পত্রিকার বৈশাখ সংখ্যায় তাঁর প্রথম কবিতার প্রকাশ – “বর্ষ আবাহন”। তারপর তৎকালীন কলকাতার ‘‌কল্লোল’‌,‘‌কালিকলম’‌, ‘‌প্রগতি’‌ প্রভৃতি বিখ্যাত পত্রিকায় তাঁর নানান কবিতা প্রকাশিত হতে থাকল, সেই অল্প সময়ের মধ্যেই নিজের জায়গা করে নিয়েছিলেন কাব্যলক্ষীর এই ব্যতিক্রমী সন্তান। ১৯২৭খ্রিঃ তাঁর প্রথম কবিতা গুচ্ছ “ঝরাপালক” প্রকাশিত হয়, তারপর একে একে সৃষ্টি হল “রূপসী বাংলা”, সাতটি তারার তিমির, বেলা অবেলা কালবেলা, নগ্ন নির্জন হাত । প্রেম প্রকৃতি মানুষ এই তিন নিয়ে তিনি কী সৃষ্টি করলেন, কী দিয়ে গেলেন আমাদের, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তবে কবি জীবনানন্দের আড়ালে একটা একটা মানুষ, একটা প্রেমিক জীবনানন্দ ছিল যার প্রত্যক্ষ প্রভাব দেখা যায় তাঁর কবিতায়। সত্যি বলতে কি কবিতা জুড়ে এই সৌন্দর্য, প্রেম, এত না বলা কথা, অপেক্ষা সবই কি শুধু কল্পনা মাত্র! নাকি কোথাও জীবনের অনেক হিসেব নিকেশ লেন-দেনও ছড়িয়ে রয়েছে তাঁর সৃষ্টি জুড়ে। একটা সময় ছিল তরুণ জীবনানন্দ তখন পদ্মাপারে বসে আপন সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে। তখন কবি হৃদয় জুড়ে ছিল তাঁর লেখা কবিতা আর”শোভনা”-কবির বনলতা সেন। বাংলাদেশে প্রতিবেশী কাকু অতুলচন্দ্র দাশের মেয়ে শোভনাকে ভালোবাসতেন জীবনানন্দ কিন্তু সমাজ তাঁর বনলতাকে তাঁর কাছে থাকতে দেয়নি, তিনি শোভনাকে বিয়ে করতে পারেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি কলকাতায় চলে আসেন, এখানে তিনি বিয়ে করেন লাবণ্যপ্রভা দেবীকে। কিন্তু কবির কথায় তিনি কোনদিনই শোভনাকে ভুলতে পারেননি। তাই হয়তো কবি হৃদয়ের স্বীকারোক্তি -“আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন /আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।“ স্বভাবতই কবির বিবাহিত জীবন তেমন সুখী ছিল না। স্ত্রী লাবণ্যপ্রভা সবসময়ই ব্যস্ত থাকতেন সিনেমার কাজ নিয়ে। আর কবি তাঁর প্রেমকে নিত্য নতুন ভাবে ভেঙে গড়ে জীবনের হিসেব-নিকেশেই ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। এই নীরব দূরত্বই হয়তো একের পর এক সৃষ্টিকে দিয়েছিল তার কাঙ্খিত রূপ। হয়তো অনেক না বলা কথা, না পাওয়ার হিসেব তিনি তুলে ধরেছিলেন তাঁর “ধূসর পান্ডূলিপি”তে। আশ্চর্যের বিষয় ছিল ১৯৫৪ খ্রিঃ১৪ই অক্টোবর তিনি যখন ট্রাম দুর্ঘটনার পর হাসপাতালে ভর্তি, তখন তাঁর স্ত্রী মাত্র একবার তাকে দেখতে এসেছিলেন। দুই হৃদয়ের মাঝে কোথাও যেন এক অন্ধকার ছিল কবির কথায় –“থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন”।

২২ শে অক্টোবর তারিখে তিনি আমাদের ছেড়ে চলে যান কিন্তু আজও বোধ হয় তিনি হেঁটে চলেছেন সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে, আর আমরা রয়েছি কোন ধান সিঁড়িটির তীরে তাকে শালিক কিংবা শঙ্খচিলের বেশে দেখবার অপেক্ষায়……….. ।

book-banner-strip

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.