সুনীপা দত্ত
জন্মেছিলাম উত্তরে, কার্সিয়াং শহরে, বাবার চাকরির সূত্রে থাকতাম তখন। হিমালয়ের কোলই তো বলব তাকে, তাই-না? তাই বোধহয় উত্তরের হাওয়া আমাকে এত টানে। পরের দিকে, এমনিতেই আমার চাকরি ও অন্যান্য পেশাদারী সূত্রে উত্তরে আনাগোনা বেড়েছে। এখন নিজেকে ‘আমি উত্তরের মেয়ে’ বলে ভাবতে ভালই লাগে। উত্তর-বঙ্গের সঙ্গে প্রাণের যোগ এখন পরিণত হয়েছে অভ্যাসে। প্রতিবারই ট্রেন যখন কিষাণগঞ্জ পেরোয়, তখন মনের মধ্যে বোধ হয়, আমার ‘নিজের’ কিছু যেন আবার আমার নিজের করে পাওয়ার সময় এসেছে।
বিন্দুর কথা বলতে গেলে সেই নিজের কিছু সম্বন্ধেই তো বলা। প্রথম যে-বার যাই, সেবার সামসিং গেস্টহাউসে উঠেছিলাম। সেখান থেকে বিন্দুর পথে রওনা দেওয়া, মনে পড়ে। মাল-বাজার থেকে যখন বিন্দুর পথে, তখন আগাম ভাবনায় ‘বিশেষ’ কিছু ছবি ছিল-না বলেই মনে পড়ছে। কী-আর এমন জায়গা! মংপঙের আদলই তো চাদ্দিকে। খানিক যাবার পর মনের মধ্যে পাহাড়ি-দৃশ্য যখন মনে বিছিয়ে গেছে, কোনো নরম-হাতে বোনা চাদরের মতন, মনে পড়ে তখনকার অনুভূতি হৃদয়কে এক মোহময় আবেশে আচ্ছন্ন করে দিয়েছিল। রাস্তা দিয়ে যেতে-যেতে দেখছিলাম পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে আসা ঝরনার ধারাগুলো পাহাড়ি পথকে ভিজিয়ে দিয়ে চলেছে। প্রতিবারই মনে হচ্ছিল গাড়ি থেকে নেমে, নিজেও ভিজে নিই। কিন্তু উত্তেজনাকে দমন করতে হয়েছিল আমার ছোট্ট মেয়ের কথা ভেবে। কারণ ওর বেশ কষ্টই হচ্ছিল, পাক খেয়ে-খেয়ে গাড়ির ডিজেলের গন্ধে পথ চলতে। কিন্তু ওই-টুকু বয়সেই মায়ের চোখে-মুখে উত্তেজনার ও কী বুঝেছিল কে জানে! অনুভব করতে পেরেছিল কিছু, ওই বয়সে? কিছুক্ষণ পর ঘুমিয়ে পড়েছিল তাও মনে আছে।
পাহড়ের ঘন সবুজ বনের মাঝে চোখ আটকে যাচ্ছিল রঙ-বেরঙের ফুলের দিকে। ভালো লাগছিল, খুব নিচ-দিয়ে বয়ে যাওয়া জলঢাকা নদীর আঁকা-বাঁকা গতিপথ। যে পথ, আমাদের সঙ্গে-সঙ্গেই এগিয়ে চলেছে বিন্দু দিকে। একটা সময় যখন ঝালঙে পৌঁছলাম – সেখানকার জলঢাকা যেন দুরন্ত গতিতে উপচে পড়ছিল। আমি নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারছিলাম, আমার পা ওখানেই আটকে গেছে। জলের ওই তীব্র স্রোত এ-পর্যন্ত আমার দেখা সমস্ত অনুভূতিকে ছাপিয়ে গেছিল। এরপর যখন বিন্দুর উদ্দেশ্যে আবার এগোতে লাগলাম তখন, মনের মধ্যে আরো চমক তৈরি হতে লাগল, সেই সঙ্গে দ্বন্দ্ব: আকীর্ণ অরণ্য, পাহাড়ি বসতি, জীবন ও ফেলে দেওয়া বিয়ার ও মদের বোতল – সবকিছুর সঙ্গে ফুলের মতন শিশু ও নানা-রঙের ফুল। সামনেই দেখলাম বিন্দু নদীর ওপর ব্যারেজ, অনিবার্য। এই সেতু দিয়েই ভূটানে যাওয়া। যদিও সে-অনুমতি সাপেক্ষ। আমাদের ছিল না। যাই হোক, বড়-বড় পাথর, ব্যারেজ থেকে জল মাটিতে আছড়ে পড়ার প্রচন্ড উচ্ছ্বাসে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল তাতে – তখনকার মত সেটা ছিল আমার দেখা সেরা পাহাড়ি নদীর রূপ। মনের মধ্যে অনেক কিছুই ছিল ইচ্ছে হয়ে, সব ইচ্ছেকে প্রকাশ করা যায়-কি? তাই আপাতত জলে পা-ডুবিয়ে থাকার ইচ্ছেটাকে তখনকার মতো প্রশ্রয় না-দিয়ে আর পারি না। মনে পড়ে, জলে পা-দিতেই ঠাণ্ডা জলের স্পর্শে মনে হল আমার কত গ্লানি, কত না-মেলানো হিসেব সব যেন জলের তোড়ে ভাসিয়ে দিলাম। মুক্তি পেলাম।