খুব পরিচিত জায়গা নয়। তবে মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই ঠিকানা লেপচাজগত। পাইন বনে মেঘের আনাগোনা। আকাশ একটু পরিষ্কার থাকলেও ডানা মেলবে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। সেখান থেকে ফিরে এসে দু–চার কথা। ভাগ করে নিলেন সন্দীপ লায়েক।
১)
দার্জিলিং জেলায় অবস্থিত ঘুম স্টেশন থেকে মাত্র নয় কিলোমিটারের মধ্যে শান্ত নির্জন স্নিগ্ধ একটি পাহাড়ি গ্রাম লেপচাজগত। হোটেল বলতে একমাত্র WBFDC ফরেস্ট বাংলো। কিন্তু তাতে কী? মাত্র গোটা দশেক বাড়ি, যেগুলোযে সবই এক একটি হোমস্টে।
সর্বসাকুল্যে দুটো দোকান। পাবেন বলতে চা কফি মোমো ম্যাগি সিগারেট আর পানীয় জল। ট্রেকিং না করে এত পরিষ্কারভাবে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার এরকম জায়গা পাওয়া দুষ্কর।
গ্রামের চারিদিক মুড়ে রেখেছে পাইন গাছের ঘন জঙ্গল। প্রায় সারা বছর কুয়াশায় মোড়া থাকে এই গ্রাম। মেঘেরা এখানে গাভীর মত চরে। হাত দিয়ে ছোঁয়া যায় তাদের, ভিজে ওঠে হাত। দিকে দিকে শোনা যায় ফুরুত ফুরুত করে উড়তে থাকা নাম না জানা হরেক পাখির ডাক। বুনো ফুল উঁকি মারে যেখানে সেখানে। প্রকৃতি প্রেমিক ও পক্ষী প্রেমিকদের জন্য এক্কেবারে আদর্শ জায়গা। গ্রামের নিচে দেখা যায় দার্জিলিং শহরকে, যার রূপ রাত্রিতে অনন্য।
২)
একদিন হেঁটে বেড়ানোর জন্য এই গ্রামে আপনাকে সময় দিতেই হবে। বড়ই অদ্ভুত এখানকার মানুষজন। যেন জন্মলগ্ন থেকে সবাই চেনা। হেঁটে হেঁটে গহন জঙ্গলের মধ্যে দেখে নেয়া যায় ঘুম রক। পাহাড়ের মাথায় এক বিশাল প্রস্তরখন্ড- প্রায় একশ মিটার উঁচু। রকের প্রান্ত দেখতে মাথা ঘুরে যাওয়ার জোগাড়। হাল্কা ট্রেকিং এর স্বাদও মিটবে এখানে।
লেপচাজগত ভিউ পয়েন্টটিও বড়ই মনোরম। গ্রামের মধ্যস্থিত পাহাড়ের টিলায় পরিছন্ন এক উপত্যকা। বাঁধানো সিঁড়ি বেয়ে দিব্যি সেখানে উঠে পড়া যায়। আপনাকে আহ্বান জানাবে ধাতব চেয়ার ও শূন্য দোলনা। দুর্দান্ত ভিউ দেখে মন ভরে যেতে বাধ্য।
হোমেস্টে গুলো সবই রাস্তার দু’পাশে। প্রত্যেকটিই অত্যন্ত সুন্দর। দুর্দান্ত তাদের আতিথেয়তা ও খাবার দাবার। এখানে থাকলে হোটেলে ওঠার ইচ্ছে আপনার সারাজীবনের জন্য উবে যেতে পারে। হোমেস্টের ট্যারিফ খাওয়া থাকা নিয়ে হয়-ধরে নিন জন প্রতি প্রায় হাজার টাকা।
৩)
আমরা উঠেছিলাম পাখরিন হোমেস্টেতে। দুইতলা বিশিষ্ট এই হোমেস্টে এককথায় অসাধারন। প্রতি রুমে রয়েছে জল গরমের গিজার, আধুনিক টয়লেট। ডানদিকের জানালা খুললেই উঁকি মারে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। নিচের খাদে WBFDC র ফরেস্ট বাংলো। সামনের দরজা অবরুদ্ধ করে দাঁড়িয়ে বিশালাকার এক পাহাড়।
রবিন তামাং এর পরিবার এই হোমেস্টে চালান। তাঁর বৃদ্ধ বাবা মা সবকিছু দেখা শোনা করেন। তাঁদের আচরন আপনার মনে দাগ কেটে যাবেই। যখন তখন কিচেনে গিয়ে আড্ডা দেয়া যায়। ভাগ করে নেওয়া যায় ফায়ার প্লেসের উত্তাপ। ডাক দিলেই মিলে যায় গরম পানীয় জল। ভাবার আগেই হাজির হয় অতীব সুস্বাদু দার্জিলিং চা।
৪)
এখান থেকে মিরিক বা মিরিক থেকে এখানে আসার সাইটসিন মিস করলে জীবন বুঝি ব্যর্থ। অসাধারণ সুন্দর কুয়াশামাখা এই পথ আজীবন আপনার মনে দাগ কেটে থাকবে। খাদের তলা থেকে উঁকি মারে পাইনের সারি। নিচে গভীর অরণ্য যেখানে সূর্যদেবের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ে। এ সত্যি অন্য এক জগত।
সাইট সিনে জোড়পোখরি, সুখিয়াপোখরি ভিউ পয়েন্ট, গোপালধারা টি গার্ডেন ও মিরিক লেক — মিস করা ঠিক হবে না। মিরিক থেকে লেপচাজগতের পথটি স্বপ্নের মত..আমার বর্ণনার অতীত। কাছেই নেপালের পশুপতি মন্দির ও মার্কেট। পায়ে হেঁটে সীমান্ত পেরিয়ে সহজেই ভিনদেশে। পাসপোর্ট, ভিসা কিছুই লাগবে না। যাঁরা কখনও বিদেশ যাননি, তাঁদের জন্য এ এক সুবর্ণ হাতছানি।
৫)
রিজার্ভ গাড়ি এখানে সহজলভ্য। দার্জিলিং ও এনজেপি যাওয়ার শেয়ার গাড়িও প্রচুর। শেয়ারে দার্জিলিং যেতে জন প্রতি ৪০ টাকা ও এনজেপি যেতে ২০০ টাকা।
মিরিক হয়ে দার্জিলিং-এর পথে সাইট সিন সেরে দুই রাত্রির যাপনের জন্য একেবারে আদর্শ এই স্থান। আপনি অবশ্য উল্টো রুটেও কভার করতে পারেন।
তিন ভাবে এখানে পৌঁছানো যায়।
এক): ২০০ টাকা দিয়ে এনজেপি বা শিলিগুড়ি জংশন থেকে শেয়ার গাড়িতে ঘুম স্টেশনে নেমে আরও একটা শেয়ার গাড়িতে ৩০ টাকা দিয়ে আসতে পারেন এখানে।
দুই): এনজেপি থেকে টোটো বা অটোয় শিলিগুড়ি বাসস্টান্ড (জংশন)। শেয়ার গাড়িতে মিরিক, জন প্রতি ১০০ টাকা। ওখান থেকে শেয়ারে লেপচাজগত মাত্র ২০০ টাকা (শেয়ারে সাইট সিন করতে পারবেন না)। মিরিক থেকে রিজার্ভ গাড়িতে সাইট সিন সেরে লেপচাজগত দু হাজার টাকার মতো।
তিন): এনজেপি বা মিরিক ছুঁয়ে রিজার্ভ কার সাড়ে তিন হাজারের এর মতো, ঘুম হয়ে গেলে আড়াই হাজারের আশেপাশে।
৬)
হাতে তিনদিন সময় থাকলেই দিব্যি মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়া যায় লেপচাজগতের কোলে। মিরিক হয়ে সাইটসিন সেরে লেপচাজগতে দুই রাত্রি যাপন। শেষ দিন দার্জিলিং ম্যালে কাটিয়ে নিউ জলপাইগুড়ি ফেরা..যেটা আমি করলাম। আপনি অবশ্য উল্টোপথেও সেটা করতে পারেন।
শেষদিনে মনখারাপ হওয়া খুবই স্বাভাবিক। তবে মনে মনে আপনাকে প্রার্থনা করতেই হবে –ভাল থাকুক লেপচাজগত, ভাল থাকুক এখানকার মানুষজন। সময় হলে আবার ফিরে আসব এই স্বপ্নের জগতে..বারবার।