শুধু আবৃত্তিকে ঘিরে উৎসব! তাও টানা তিনদিন! তাও আবার হাওড়ার মফস্বলে! এমনটাই করে দেখাল কথাসরিৎ। সেই উৎসবের নানা বর্ণনা উঠে এল সংহিতা বারুইয়ের লেখায়।
মাঝে কাঁটাতারের বেড়া। তারই পোশাকি নাম সীমান্ত। দুই পারে দুটো ভিন্ন দেশ। এপার থেকে ওপারে যেতে লাগে পাসপোর্ট, ভিসা। কিন্তু ভাষার কোনও সীমান্ত নেই। এই বাংলার কবিতা ছড়িয়ে পড়ে ওই বাংলায়। ওই বাংলার কবিতাও ছড়িয়ে পড়ে এই বাংলায়। শুধু শহরের সঙ্গে শহরের মেলবন্ধন নয়। শুধু কলকাতা আর ঢাকার বন্ধুত্ব নয়। বন্ধুত্ব ছড়িয়ে পড়ে প্রত্যন্ত মফস্বলেও। হাওড়ার ছোট্ট শহর আন্দুল। সেখানেও দিব্যি হয়ে গেল দুই বাংলা আবৃত্তি উৎসব। আবৃত্তির আঙিনায় ফের মিলে গেল দুই বাংলা। গ্রাম থেকে শহর, জেলা থেকে রাজ্য, এক দেশ থেকে ভিন্ন দেশ। কতকিছুই নিঃশব্দে মিলে গেল!
আবৃত্তির হাত ধরে পথ চলার শুরু সেই ১৯৭১ এ। কী কাকতালীয়। সেই সময়েই কিনা মুক্তিযুদ্ধের আবহ। এক বাংলার জন্য ঝাপিয়ে পড়ছে আরেক বাংলা। এক দেশের পাশে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে আরেকটা দেশ। তখন নাম ছিল আবৃত্তি বলয়। ইন্টারনেট তো দূর অস্ত। টেলিভিশন নামক বস্তুটিও তখন বাঙালির ঘরে ঢোকেনি। সেই সময় মফসসলের বুকে আবৃত্তির সংগঠন! কিছুদিন চলার পর বাধ্য হয়েই কিছুটা জিরিয়ে নেওয়া। আবার নতুন করে ফিরে এল ১৯৮১ তে। এবার নাম কথাসরিৎ। স্মৃতির সরণি বেয়ে যেন হেঁটে যাচ্ছিলেন সংস্থার কর্ণধার রবীন ভট্টাচার্য। টুকরো টুকরো কত স্মৃতি জড়িয়ে আছে কথাসরিতের সঙ্গে।
এবারও বেশ আবৃত্তিকে ঘিরে যেন উৎসবের চেহারা নিল আন্দুলমৌড়ি গ্রাম্য হিতকরী বালিকা বিদ্যালয়ে। তিন দিনের অনুষ্ঠান। শুধু আবৃত্তির জন্যই তিনটে দিন। শুরু হল বর্ষীয়াণ আবৃত্তিকার প্রদীপ ঘোষের হাত ধরে। শ্রুতি নাটকের উত্তম–সুচিত্রা হলেন জগন্নাথ বসু–উর্মিমালা বসু। এই জুটির শ্রুতিনাটক ছিল বাড়তি এক পাওনা। আর ‘যাঁরা বৃষ্টিতে ভিজেছিল’ যিনি একাই মঞ্চস্থ করে সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন, সেই বিজয়লক্ষ্মী বর্মণও ছিলেন অন্যতম আকর্ষণ। চিত্র পরিচালক ও কবি শতরূপা সান্যালের উপস্থিতিও আনল অন্য এক মাত্রা।
মফস্বলের একটি ছোট্ট স্কুলে আবৃত্তির এত তারকা! ওঁরা এসেছিলেন আবৃত্তির টানে। কথাসরিতের টানে। বাংলা আবৃত্তির বিকাশে কথাসরিতের ভূমিকাটা ঠিক কোথায়, ওঁদের অন্তত অজানা নয়। তাই কলকাতা ছেড়ে আন্দুলে ছুটে আসতে কোনও দ্বিধা হয়নি। বরং ষোল আনা আবৃত্তির আবহে ওঁরাও যেন অন্যরকম একটা দিন কাটানোর সুযোগ পেলেন। ‘নারী প্রতিবাদী’, ‘এ কেমন অন্ধকার’ যেন নতুন মাত্রা আনল। মেয়েদের প্রতি বঞ্চনা ও তাঁদের পাল্টা প্রতিবাদ যেন আরও বর্ণময় হয়ে উঠল উপস্থাপনায়। ছন্দা রায়, শতরূপা সান্যাল, রতনতনু ঘাটি, অংশুমান চক্রবর্তী, কৃষ্ণপদ দাস, সুস্মিতা দাসদের আবৃত্তিও মন কেড়ে নিল।
শুধু আবৃত্তি শোনা নয়। ছিল এক মনোজ্ঞ সেমিনারও। আবৃত্তি করতে গিয়ে কোথায় কোথায় ভুল হয়ে যায়, কবিতার ভাব বুঝে কীভাবে নিজেকে মেলে ধরতে হয়, কোন কোন শব্দ কীভাবে উচ্চারণ করতে হয়, অতি নাটকীয়তা কীভাবে এড়াতে হয়। এমন নানা বিষয় উঠে এল সেমিনারে। সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন ভাস্করজ্যোতি সেনগুপ্ত, উত্তম বসু, অরিন্দম পালিত, সুমিত মিত্ররা।