সম্রাট চক্রবর্তী
খবরটা প্রথম পেলাম বেঙ্গল টাইমস থেকেই। মন খারাপ হয়ে গেল। আর সান্ধ্য আজকাল বেরোবে না! এমন কোনও পূর্বাভাস তো পাইনি। তাই এটা অনেকটা বিনা মেঘে বজ্রাঘাতের মতোই।
আমার সঙ্গে সান্ধ্য আজকালের সম্পর্কটা অনেকটাই পুরনো। মূলত পাঠক হিসেবে। তারপর টুকটাক ফিচার লেখক হিসেবে। তখন নব্বইয়ের দশক। রবীন্দ্র ভারতীতে পড়তাম। বেলঘরিয়ার একটি মেসে থাকতাম।
মফসসলের ছেলে। বাড়িতে বাম আবহ। নিজেও কিছুটা বাম ঘেঁসা। স্বাভাবিকভাবেই বাড়িতে আজকাল নেওয়া হত। আমি ছিলাম খেলাপাগল। স্বভাবতই আমারও প্রিয় কাগজ হয়ে উঠেছিল আজকাল। জেলায় থাকাকালীনই জানতাম, কলকাতায় আজকালের একটা সান্ধ্য দৈনিকও বেরোয়। তার নাম সান্ধ্য আজকাল। মনে মনে কলকাতার লোকদের খুব হিংসেই হত। পরে করিমপুর থেকে কলকাতায় এলাম। সুযোগ পেলেই বেলঘরিয়া স্টেশনে বা দমদম স্টেশনে সান্ধ্য আজকাল কিনতাম। রোজ কিনতাম, এমনটা বলব না। তবে সপ্তাহে চার–পাঁচদিন তো হতই। একটু একটু করে ভাল লাগতে শুরু করল। এমন অনেককিছুই পেতাম, যা দৈনিক কাগজে পাওয়া যেত না। পাশাপাশি, চটকদারি খবর ছিল না। অন্যান্য সান্ধ্য দৈনিক যেভাবে অশ্লীল ছবি ছেপে বা সুড়সুড়ি দেওয়া গল্প ছেপে সস্তায় জনপ্রিয় হতে চেয়েছিল, সান্ধ্য আজকালকে কখনই সেই পথে হাঁটতে দেখা যায়নি। সে কখনই সুস্থ রুচিকে বিসর্জন দেয়নি।
এক সময় মনে হল, আমিও তো লিখতে পারি। কিন্তু আমার লেখা কি ছাপা হবে? আমার তো কোনও চেনাজানাও নেই। আজকালে চিঠি লিখতাম। ছাপাও হত। পরে মনে হল, ফিচার পাঠিয়েই দেখা যাক। না ছাপলে, না ছাপবে। সান্ধ্য আজকালের ঠিকানায় পাঠিয়েও দিলাম। প্রথম তিনটে লেখা দিনের আলো দেখেনি। তারপর হঠাৎ একদিন দেখলাম, আমার লেখা ছাপা হয়েছে। সে যে কী আনন্দ, কী শিহরণ বলে বোঝাতে পারব না। তারপর আরও কিছু লেখা ছাপা হয়েছিল। স্নাতকোত্তর সেরে কোচিং নেওয়ার কাজেও কলকাতায় থেকেছিলাম। একটা ছোটখাটো চাকরিও করেছিলাম কিছুদিন। ফলে, আরও কিছুদিন কলকাতায় থাকার সুযোগ হয়েছিল। সান্ধ্য পড়ার সুযোগও হয়েছিল। তারপর এসএসসি–র সুবাদে আবার জেলায় ফিরে আসা। কলকাতার সঙ্গে যোগাযোগটা ক্রমশ কমে আসা।
তবুও যখনই কলকাতা যেতাম, শিয়ালদা স্টেশন থেকে সান্ধ্য আজকাল কিনতাম। ফেরার ট্রেনে পড়তে পড়তে আসতাম। পুরানো দিনগুলোতে ফিরে যেতাম। এই তো মাস দেড়ের আগেও সান্ধ্য পড়তে পড়তেই এলাম। হকার ভাইয়ের কাছ থেকে পুরানো দুদিনের সান্ধ্য ছিল। সেগুলোও কিনে নিলাম। প্রথম দুটো পাতা কিছুটা ম্যাড়মেড়ে। কিন্তু শেষ দুটো পাতা তো বেশ আকর্ষণীয়ই ছিল। তাহলে বন্ধ করে দিতে হল কেন?
আসলে, মানুষের পড়ার অভ্যেসটাও চলে যাচ্ছে। আগে লোকাল ট্রেনে উঠলে বিনোদনের সেরা মাধ্যমই ছিল সান্ধ্য কাগজ। এখন হাতে এসে গেছে মোবাইল। সবার চোখ মোবাইলে। পাশের লোকটার দিকে তাকানোরও সময় নেই। সব কাগজেরই সার্কুলেশন কমে যাচ্ছে। কাগজ পড়া যেভাবে মানু,এর দৈনন্দিন অভ।এস ছিল, সেই অভ্যেসে যেন ভাটা পড়ছে। শিক্ষকতার সূত্রে জানি, কমন রুমের পরিবেশটাই কেমন যেন বদলে গেছে। কেউ কারও সঙ্গে কোনও কথা বলে না। সবাই মোবাইলে মগ্ন। একই কমন রুমে বসে দুই সহকর্মী কিনা হোয়াটসঅ্যাপে কথা বলছে। এই যখন আবহ, তখন সব কাগজের কাছেই এটা একটা অশনি সংকেত। জানি না, আর কোনওদিন সান্ধ্য আজকাল চালু হবে কিনা। তবে আমার তারুণ্যের স্মৃতিগুলো তো মিথ্যে নয়। বেঙ্গল টাইমসে খবরটা পড়েই মন খারাপ হয়ে গেল। একটা স্বজনহারানোর বেদনা অনুভব করছি। আমার মতো অনেকেই বোধ হয় একইরকম শূন্যতা অনুভব করছেন।
(ওপেন ফোরাম। ব্যক্তিগত অনুভূতি মেলে ধরেছেন শিক্ষক সম্রাট চক্রবর্তী। চাইলে আপনিও আপনার অনুভূতি মেলে ধরতে পারেন। চিঠি লিখুন বেঙ্গল টাইমসে। )