কেন পিছিয়ে পড়ছে ইস্টবেঙ্গল? মোহনবাগানের বাতিল খেলোয়াড়দের কেন নিতে হচ্ছে? মাঠের বাইরেও কেন দিশাহীন? সত্যিই কি এঁরা আত্মসমীক্ষা করেন? প্রশ্ন তুললেন ধীমান সাহা।।
দিল্লিতে ওএনজিসি–র সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের খেলা। সে বছর একটি নতুন বিদেশি বেশ আলোড়ন ফেলেছে আই লিগে, নাম কাটসুমি। দ্বিতীয়ার্ধের মাঝামাঝি একটা বল ধরে ইস্টবেঙ্গলের জালে পাঠালো কাটসুমি, ভাসুমের ওপর সাহেব কোচ প্রচন্ড রেগে গেলেন। কারণ, ওর উচিত ছিল কাটসুমিকে মার্ক করা যেটা ও করেনি। এই খেলার পর থেকে ভাসুমকে প্রায় বসিয়েই দিয়েছিলেন ট্রেভর মরগ্যান। উল্টোদিকে কাটসুমিকে পছন্দ হল ইস্টবেঙ্গল ক্লাবের। কথাবার্তা এগিয়ে প্রায় সবকিছু ফাইনাল করেও ফেলে রাখা হল। আর সেই ফাঁকে মোহনবাগান তুলে নিল কাটসুমিকে।
এইরকমভাবে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা গেছে খেলোয়াড়দের নেওয়ার ব্যাপারে গড়িমসি বা ভুল সিদ্ধান্ত ভুগিয়েছে ইস্টবেঙ্গল ক্লাবকে। চেঞ্চর ব্যাপারটা যেমন। শ্যাম থাপা নিতে বলেছিলেন, অনেক কম টাকায় পাওয়া যাচ্ছিল। কিন্তু কাটসুমিকে নেওয়া হয়ে গেছে এদিকে কোচের ইচ্ছেতে প্লাজাও চূড়ান্ত, তাই নেওয়া হল না। ফলাফল সবাই দেখছে। একটা ব্যাপার কিন্তু খুব ভাবায়। র্যান্টি মার্টিন্স, ডুডু এরা কেউ টপ ফর্মে ইস্টবেঙ্গলে আসেনি বা ইস্টবেঙ্গল কর্তারা আনতে পারেননি। ওডাফাকে টপ ফর্মে সই করিয়েছে মোহনবাগান, ওরা চেয়েছে, তাই সনি নর্দেকেও পেয়েছে এবং সেই বছরই আই লিগটাও পেয়েছে। ইস্টবেঙ্গল এক সময়ে খেলোয়াড়দের ছিনিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে সেরা ছিল। জীবন-পল্টু, সুপ্রকাশ গড়গড়ি, পল্টু দাস বা স্বপন বল এদের জমানার অনেক ঘটনা ছাপার অক্ষরে এখনও ইস্টবেঙ্গল সমর্থকদের আনন্দ দেয়। কিন্তু গত ১৪ বছর না হোক, গত ৫ বছরে আমরা কি দেখছি ? ডু ডং ছাড়া সেই হিসেবে একটাও কি মানের বিদেশি তুলতে পেরেছে ইস্টবেঙ্গল ? গত ৫ বছরে কটা নতুন স্বদেশি খেলোয়াড় উঠেছে ইস্টবেঙ্গল থেকে? উল্টে কী দেখছি আমরা? যে দলগঠনে আগে বুদ্ধির বা চিন্তার ছাপ থাকতো, সেখানেই এখন সবথেকে বেশি গলদ। উল্টে ইস্টবেঙ্গল কোন কোন খেলোয়াড়ের সঙ্গে কথা বলছে সেই খবর আজকাল টিভির পর্দায় বা খবরের কাগজে সবথেকে আগে চলে আসে। এক প্রখ্যাত সাংবাদিক গর্ব করে বলেন যে ইস্টবেঙ্গলের খবরের জন্য আমাকে ক্লাবে যেতে হয় না, খবর আমার কাছে আসে।
ক্লাব তো এমনিতেই পারিবারিক সংস্থায় পরিণত হয়েছে। মামা, কাকা, ভাগ্নে, ভাগ্নি দিয়ে ক্লাব চলছে। সেখানে নিজের পরিবারের সদস্য যখন কোনও দোষ করছে তখন বাধ্য হয়েই চোখ বন্ধ করে থাকতে হচ্ছে, তার ফায়দা তুলছে অন্যরা। মোহনবাগান সঞ্জয় সেনকে এনে সাফল্য পেল। তো আমাদের বাঙালি কোচ চাই, অতএব বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য্যকে নেওয়া হল। ওদের থেকে বেলো রাজ্জাককে ছিনিয়ে নেওয়া হল। দেখা হল না তার কতটা ক্ষমতা, ওদের আসল খেলাটা যে পিয়েরবোয়া খেলেছিল সেটা বোঝার মতন ফুটবল–বোধ তো আর এই কর্মকর্তাদের নেই। গত ৫ বছরে আমরা ৮ জন কোচকে দেখেছি (এর মধ্যে ১ দিনের কোচ মৃদুল ব্যানার্জি নেই), ২৫ জন বিদেশি দেখেছি। কিন্তু ম্যানেজমেন্ট কিন্তু সেই একই রয়ে গেছে। আর আই লিগ ? শূন্য। নির্ভরযোগ্য সূত্রের খবর, ক্লাব থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কাছে ৫০ লক্ষ্য টাকা গ্রান্ট চাওয়া হয়েছিল, তাদের বলা হয়েছে আগে নিজের ঘর (পড়ুন আলভিটো ) সামলাও, তারপর টাকা চাইবে। এখন সমর্থকদের ধৈর্য্যের বাঁধ ভাঙতে তারা যখন স্পনসরদের বলছে ক্লাবের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতে তখন কর্তাদের টনক নড়েছে। একদিকে তারা নতুন করে অডিট করার কথা ভাবছেন। আলভিটোকে বলছেন ইংল্যান্ড যাওয়ার টাকা দিয়ে দিতে যাতে করে এটা প্রমাণ হয় যে সে ক্লাবের টাকা নয়ছয় করেনি, প্রাক্তনদের (যার অধিকাংশ ক্লাবেই বাচ্চাদের কোচিং করান বা ক্লাবের জন্য চাকরি পেয়েছেন) কে দিয়ে নিজেদের সুবিধা মতন কথা বলানো হয়। আর যারা আওয়াজ তুলছে তাদের প্রত্যক্ষ আর পরোক্ষভাবে হুমকি দেওয়া হয়, মারধর করার, ক্লাবের মেম্বারশিপ বাতিল করার। দিল্লির এক সমর্থক যখন এক শীর্ষ কর্তাকে ফোন করে অনুরোধ করে ক্লাবের এই ব্যর্থতার দায় নিয়ে পদত্যাগ করতে তখন তার খুব রাগ হয়ে যায়। রেগে গিয়ে চিৎকার চেঁচামেচি করে ফোন কেটে দেন তিনি। তিনি বা তাঁর চেলা কিন্তু উত্তর দিতে পারেন না কেন তাঁরা এখন মোহনবাগানের উচ্ছিষ্ট দিয়ে দল গঠন করছেন। কেন সদস্য সমর্থকেরা তাঁদের কাটমানি খাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন, বেঙ্গালুরু এফসির মতন কেন ক্লাব আই এস এল খেলল না সেই নিয়ে প্রশ্ন করছেন এবং এতদিনের সঙ্গী ইউ বি কেন তাদের স্পনসরশিপ কমিয়ে দিল সেই বিষয়ে প্রশ্ন করছেন। প্রশ্ন অনেক কিন্তু উত্তর দেওয়ার মতো কেউ নেই ক্লাবে। কারণ ক্ষমতার দখল ছাড়তে এঁরা কেউ রাজি নন। ১৪র পর ১৫হলেও এদের কিছু এসে যায় না।
যারা মাঠে আসে ক্লাবের ব্যানার নিয়ে, যারা বাড়ি যাবার পথে মার খায়, যারা অফিসে, কলেজে, পাড়ায় কটূক্তি শোনে আর মনে মনে ভাবে কবে এই অপমানের জবাব দেবো, তারাই শুধু শুধু কষ্ট পায়। একদিকে মোহনবাগানের টুটু বোস অন্যদিকে মিনার্ভার রঞ্জিত বাজাজ বলে দিয়েছেন, আসছে বছর ১৫ কোটি দিতে হলেও দিয়ে আইএসএল খেলবে, অন্যদিকে ইস্টবেঙ্গলের কর্তারা স্পিকটি নট। তাঁরা আবার কোনও একটা গল্প ফাঁদবেন, চেষ্টা করবেন কোনও মতে ব্যাপারটা ঠেকিয়ে চেষ্টা চরিত্র করে খেপ খেলাখেলোয়াড় ধরে দল গড়ে চালিয়ে যেতে। কিন্তু সমর্থকেরা যে অশনি সংকেত দেখতে পাচ্ছেন। তাঁরা শঙ্কিত, কতদিন এইভাবে তাঁদের প্রিয় ক্লাব বেঁচে থাকবে। আপাততঃ তাদের কাছে কোনও আশার দিশা নেই।