ভাগ্যিস ওই ফোনটা বেজে উঠেছিল। ভাগ্যিস, মুম্বইয়ে দাঁড়িয়েও বাংলায় কথা বলেছিলেন নজরুল। তাই গোটা ছবিটাই বদলে গেল। হারানো এক তরুণ খুঁজে পেল নিজের পরিবার। সন্তান–হারা এক মা খুঁজে পেলেন এগারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে। সুমিত চক্রবর্তীর লেখায় সেই ফিরে পাওয়ার উপাখ্যান।
ভাগ্যিস ওই ফোনটা বেজে উঠেছিল। ভাগ্যিস, মুম্বইয়ে দাঁড়িয়েও বাংলায় কথা বলেছিলেন নজরুল। তাই গোটা ছবিটাই বদলে গেল। হারানো এক তরুণ খুঁজে পেল নিজের পরিবার। সন্তান–হারা এক মা খুঁজে পেলেন এগারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে।
সিনেমাতেই বোধ হয় এমনটা দেখা যায়। কিন্তু বাস্তব জীবনেও এমন চিত্রনাট্য লেখা হয়, কে ভেবেছিল। হারিয়ে যাওয়া সেই কিশোরের কথাই আগে শোনা যাক। নাম তাপস মাইতি। জন্ম, বেড়ে ওঠা চণ্ডীপুরের সাতরাবাড় এলাকায়। ছোটবেলাতেই বাবাকে হারিয়েছে। লেখাপড়াও শেখা হয়নি। মা অন্যের বাড়িতে পরিচারিকা। খুবই কষ্টের জীবন। একা মায়ের পক্ষে সংসারের বোঝা টানা মুশকিল। ওড়িশায় একটি মিষ্টির দোকানে কাজ নেয় কিশোর তাপস। কিন্তু আর দশজনের থেকে এই ছেলে একটু অন্যরকমের। নিজের ঠিকানা কী, জানে না। ওড়িশা থেকে হাতবদল হয়ে মুম্বই। কারা কীভাবে ওকে মুম্বই পাঠাল, সে নিজেও জানে না। কীভাবে বাড়ি ফিরবে, তাও জানে না। বাংলা–হিন্দি সবমিশিয়ে কেমন একটা ভাষা বলে। যেখানে কাজ করে, সেখানেও নানা নির্যাতন। কিন্তু পালাবে কোথায়? এরই মাঝে পেরিয়ে গেছে এগারোটা বছর। স্মৃতি থেকে একটু একটু করে অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে।
এবার সৈয়দ নজরুলের কথায় আসা যাক। নইলে, চিত্রনাট্য অসমাপ্ত থেকে যাবে। তাঁর বাড়ি বাগনানের কাচারিপাড়ায়। পেশা বাতানুকূল যন্ত্রের ঠিকাদারি। ডাক আসে বিভিন্ন শহর থেকে। কাজের সূত্রে গিয়েছিলেন মুম্বই। ঠিক তখনই বাড়ি থেকে ফোন আসে। বাড়ির ফোন, তাই বাংলাতেই গড়গড় করে কথা বলে চলেন নজরুল। সেই বাংলা শুনে হাউ হাউ করে কাঁদতে থাকে তাপস। বুঝতে পারে, এ তার চেনা ভাষা। এই লোকটা নিশ্চয় খুব কাছের একজন। সে নজরুলকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে। একটু একটু করে তাপসের বৃত্তান্ত জানতে পারে নজরুল। তাপস জানায়, সে বাড়ি ফিরতে চায়। কিন্তু এই ছেলেকে তার মালিকের কাছ থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাওয়াও মুশকিল। ঠিকঠাক বাড়ির কথা বলতেই পারছে না। তবু কিছুটা ঝুঁকি নিলেন নজরুল। ট্রেন ধরে নিয়ে এলেন বাগনানে, নিজের বাড়িতে। কিন্তু কোথায় সেই সাতরাবাড়। বাইক নিয়ে খুঁজতে বেরোলেন। সঙ্গে জেদ, যেভাবেই হোক, এই ছেলেকে তার হারানো মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতেই হবে। বাইক নিয়ে গোটা এলাকা চষে ফেললেন। একটু একটু করে জট খুলতে লাগল। একে–তাকে জিজ্ঞেস করে, সন্ধান পাওয়া গেল সেই গ্রামের। এগারো বছর আগে কে হারিয়ে গেছে, এসব খুঁজতে খুঁজতে পাওয়া গেল মায়ের হদিশ। তাঁকে নিয়ে এলেন নিজের বাড়িতে। এগারো বছর আগে হারিয়ে যাওয়া ছেলেকে খুঁজে নিতে ভুল হল না মায়ের। মাকেও চিনতে ভুল হল না তাপসের।
এভাবেও ফিরে পাওয়া যায়! হ্যাঁ, নজরুলের মতো মানুষেরা এখনও আছেন। ছেলেকে মায়ের কোলে ফিরিয়ে দেওয়ার অদম্য লড়াই এখনও দেখা যায়। তাই এগারো বছর পরেও ভুলে যাওয়া ঠিকানায় পৌঁছে যায় হারিয়ে যাওয়া ছেলে। অনেকটা সিনেমার মতোই। কিন্তু বাস্তবে তো এমনটাই ঘটল।