খটকা আছে, তবে হতাশ করেনি শবর

যাঁরা গোয়েন্দা ছবি দেখতে যান, তাঁদের ভেতরেও কিন্তু গোয়েন্দা বাস করে। ছোট ছোট অসঙ্গতিগুলো সেই আতসকাচে ধরা পড়ে যায়। তবে মোটের ওপর হতাশ করেনি শবর। ফিল্ম রিভিউ। লিখলেন অন্তরা চৌধুরি।।

এবারের শবর নিয়ে প্রত্যাশার পারদ ছিল বেশ তুঙ্গে। থাকবে নাই বা কেন! দিনের পর দিন খবরের কাগজে অরিন্দম শীলের একের পর এক ইন্টারভিউ। টিভিতেও শবর টিমের অভিজ্ঞতা গোগ্রাসে গেলা। সবমিলিয়েই ভেতরে ভেতরে একটা অপেক্ষা জমেছিল। এর আগে অরিন্দমবাবু আমাদের একেবারেই নিরাশ করেননি। ‘ব্যোমকেশ পর্ব’, ‘দুর্গা সহায়’, ‘ধনঞ্জয়’ একের পর এক আসাধারণ সিনেমা উপহার দিয়েছেন। পরিচালক হিসেবে একটা আস্থা অর্জন করেছেন। এবারের শবরও তার ব্যতিক্রম নয়। তবু ভাল কাজ করলে যেমন নিন্দুকের অভাব থাকে না, তেমন ভাল সিনেমা করলেও সমালোচকের অভাব থাকে না। তারা ঠিক আতস কাঁচ নিয়ে খুঁজে খুঁজে ছিদ্র বার করবেই।

shabar2
আমি অবশ্য অরিন্দমবাবুর সিনেমার একনিষ্ঠ দর্শক। এর আগে বেশ কিছু বাংলা সিনেমা দেখে অস্বাভাবিক রকম মুরগি হয়েছি। তাই আমার এক ছোট্ট বন্ধু উপদেশ দিয়েছে যে, ‘আগ বাড়িয়ে সিনেমা দেখতে যেও না। কাগজের কথায় প্রভাবিত হয়ো না। সিনেমাটা আগে সবাই দেখে ভাল বলবে, তারপর যাবে।’ এবারে আমিও সেই সবাইয়ের দলে নাম লিখিয়েছি। কিন্তু আমার চোখেও এবারে বেশ কিছু অসঙ্গতি ধরা পড়ল।
শুনেছিলাম এবারের শবর যেন আরও বেশি ক্ষিপ্র।… কিন্তু একেবারে শেষ দৃশ্যে ছোটা ছাড়া শবরবাবুর আর কোনও গতিময়তার প্রমাণ পেলাম না। সেই ছোটার দৃশ্যটাও যেন একটু বাড়াবাড়ি। এত দীর্ঘায়িত না করলেও চলত। এতক্ষণ ছুটতে গেলে উসাইন বোল্টও হাঁপিয়ে যেত।
সিনেমার শুরু থেকেই সবাই বিজয়কে (‌ইন্দ্রনীল সেনগুপ্ত)‌ কালপ্রিট বলে চিহ্নিত করতে থাকে। যত দোষ বিজয় (ঘোষ)। কিন্তু কেন তার ওপর সবার এত রাগ, তা পরিষ্কার হল না। অনেকটা জায়গা জুড়ে তার বাড়ি, গ্যারেজ। প্রমোটারদের লোলুপ দৃষ্টি সেদিকে থাকতেই পারে। তাদের এজেন্ট হিসেবে কাউন্সিলরের মাথা ব্যথাও না হয় বোঝা গেল। কিন্তু বাকিদের রাগের তো তেমন যুৎসই কারণ নেই। রিঙ্কুর বাবা বা রিঙ্কুর বন্ধুদের তো রাগ হওয়ার কথা নয়। রিঙ্কুর জন্মদিন থেকে ফেরার পথে কারা বা কেন বিজয়ের ওপর চড়াও হয়, তাও বোঝা যায় না। রাত্রিবেলায় বিজয়কে কেন বন্দুক নিয়ে শুতে হয়, সেটাও ধোঁয়াশা। সিনেমার শুরু থেকে বিজয়কে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় সেখানে একবারও তাকে ‘খারাপ লোক’ বলে মনে হয় না। বরং তার মধ্যে একটা স্নেহপরায়ণতা যেমন আছে, তেমনই আছে মূল্যবোধ। অন্তত বাকি চরিত্রগুলোর থেকে অনেক বেশি স্বচ্ছ। তবু তাকে ঘিরে কেন এমন ঘৃণার আবহ, ব্যাখ্যা নেই।
শবর দাশগুপ্তের ভূমিকায় শাশ্বত যে আবার ছক্কা মারলেন সেকথা বলাই বাহুল্য। শবর সে, যার গ্ল্যামার নেই, রোমান্টিকতা নেই, আবেগও নেই বললেই চলে। দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন শাশ্বত। কিন্তু এহেন পুলিশ অফিসারের এতগুলো খুনের মোটিভ বার করতে এত সময় লাগল! কেউ যখন সন্দেহের উর্ধ্বে নয়, তখন রিঙ্কু খুনের পর তার বন্ধুদের ফিঙ্গার প্রিন্ট নেওয়ার কথা মনে এল না কেন? সহকারী নন্দনের (‌শুভ্রজিৎ দত্ত)‌ বডি ল্যাঙ্গুয়েজের সঙ্গে তার কমিক রিলিফ অসাধারণ। গৌরবও যথেষ্ট স্মার্ট। বেশ মানানসই। গ্ল্যামার আর স্বল্পবসনার চরিত্র থেকে বেরিয়ে এসে বহুদিন পর অরুণিমার স্নিগ্ধ অভিনয় মন ছুঁয়ে যাওয়ার মতোই।

shabar
আরেকটা প্রশ্ন থেকেই যায়। যে ছেলেটি খুনি, তার কথা অনুসারে সে তো বেশ গরিব। তাহলে এত দামী বাইক নিয়ে ঘুরত কীভাবে?‌ তাকে যে মেয়েটি ব্ল্যাকমেল করে তাকে দশলক্ষ টাকাই বা দিল কীভাবে! কে জোগালো সেই টাকা?‌ খুনগুলো নাকি মদের নেশায়, অর্থাৎ পরিকল্পনা করে নয়। তাহলে, প্যাটার্নগুলো একইরকম কী করে হল?‌ শবর দাশগুপ্তের সঙ্গে দর্শকও যে গোয়েন্দা হয়ে উঠছে সেকথা ভুলে গেলে চলবে কেন!

‘প্রজাপতির মৃত্যু’ এবং ‘পুনর্জন্ম’ এর আদলে চিত্রনাট্য রচিত হলেও এবারের শবর কাহিনি যেন একটু বেশিই প্রাপ্তবয়স্ক। শরীরকেন্দ্রীক এই সংলাপ শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের লেখা, এটা ভাবতে একটু হোঁচট খেতে হয় বৈকি। অবশ্য অরিন্দমবাবুর লেখা শবর কাহিনির জন্য আমাদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে। গোয়েন্দা কাহিনির শুরুতেই একটা খুন হবে। সেই খুনি চোখের সামনেই থাকবে। এবং তাকে ধরি ধরি করেও ধরা যাবে না। নানা লোককে ঘিরে সন্দেহের বাতাবরণ তৈরি হবে। শেষমেষ যাকে কেউ ধর্তব্যের মধ্যেই আনছে না, দেখা যাবে সে আসল আসামী। গোয়েন্দা গল্পের সেই চিরাচরিত প্যাটার্ন এক্ষেত্রেও একইরকম। কে খুনি, এখানেও শেষ পর্যন্ত সাসপেন্স ধরে রাখা গেছে। এটা অবশ্যই পরিচালকের কৃতিত্ব।
গোয়েন্দার বুদ্ধির মারপ্যাঁচ দর্শককে মনে মনে উত্তেজিত করে তোলে। যার জন্য ব্যোমকেশ, ফেলুদা আমাদের কাছে আজও এত জনপ্রিয়। সিনেমায় যৌনতা আসতেই পারে। কিন্তু তরকারিতে অতিরিক্ত নুন পড়ে গেলে সেটা আবার তেতো হয়ে যায়। কথায় বলে না অতিরিক্ত লাবণ্যের লবণ থাকে না। তাই অধিক সুড়সুড়িও অনেকটা মদ্যপানের মত। মানসিক স্বাস্থ্যের পক্ষে খুউউব বিপজ্জনক।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.