খাজনা না বাজনা, কোনটা বেশি?

সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি

আবার একটা বাণিজ্য সম্মেলন। আবার দেশের প্রথম সারির কিছু শিল্পপতিদের নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কিছু “উন্নয়ন” এর ফিরিস্তি ঘোষণা করা। আর তাঁদের সামনে দাবি করা, বাংলায় শিল্পস্থাপনের জন্য অনুকূল পরিবেশ তো আছেই, এমনকি জমি অধিগ্রহণেও কোনও সমস্যা নেই। তাঁরা যেন অতি সত্বর বাংলায় এসে বিনিয়োগ করেন, নতুন শিল্প স্থাপন করেন। ইত্যাদি ইত্যাদি। আর সেই বাণিজ্য সম্মেলন সারা বাংলাজুড়ে অলিগলি থেকে রাজপথ বড় বড় ফ্লেক্স, ব্যানার, হোর্ডিং লাগিয়ে সেই সম্মেলনের প্রচার করা। তাতে একটাই কথা লেখা। সেই “অনুপ্রেরণায়” আর “অনুপ্রেরণায়”।
বস্তুতঃ এই চটকদারি আর দেখনদারির একটা মস্ত সুবিধে হচ্ছে বাংলায় (বা দেশের অন্যান্য রাজ্যেও) এমন কিছু মানুষ থাকেন (হয়তো তাঁদের সংখ্যাটাই বেশি) যাঁরা আদৌ রাজনৈতিক সচেতন তো ননই, উপরন্তু রাজনীতি বিষয়টাকেই অত্যন্ত অবহেলার চোখে দেখেন। সেইসব মানুষদের চোখ যে এই রঙবাহারি আয়োজনে আর গলি থেকে রাজপথে লাইটপোষ্টের গায়ে বা বাড়ির দেওয়ালে সাঁটা ফ্লেক্স বা ব্যানারে আকৃষ্ট হবে, সেটাই স্বাভাবিক। তাঁরা ভাববেন, বিশাল উন্নয়ন হচ্ছে রাজ্যের ! এত ঘটা করে, জাঁকজমক করে শিল্পপতিদের নিয়ে বাণিজ্য সম্মেলন ঘটছে, নিশ্চয় এবার আমাদের পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে শিল্পের বিচারে শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপা অর্জন করবে। আর মনে হয় বাংলার ছেলেমেয়েদের ভিনরাজ্যে পাড়ি দিতে হবে না জীবিকার সন্ধানে!

jindal3

কিন্তু বাস্তবটা কী? বাংলার বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী ২০১১ সালে বাংলার ক্ষমতা দখলের পরেই একটা জিনিস বেশ বুঝেছিলেন। তা হল, ‘‌কাজ হোক আর না হোক, প্রচারটা কিন্তু করে যেতে হবে’‌। একদিকে মুখে বলে বেড়াতে হবে, ‘‌রাজ্যের ভাঁড়ারে মা-ভবানীর দশা, বিগত বাম সরকার কয়েক লক্ষ কোটি টাকার ঋণ চাপিয়ে গেছে’‌। আর জনগণের করের টাকায় দার্জিলিং থেকে দক্ষিণ ২৪ পরগণার গলি থেকে রাজপথ, “উন্নয়ন” এর প্রচারে ভাসিয়ে দিতে হবে। তবেই তিনি এবং তাঁর সরকার ভোটের নিরিখে বিপদমুক্ত। শুধু “উন্নয়ন” এর প্রচারেই যথেষ্ট নয়, তার সঙ্গে প্রতিটি ব্যানারে বা হোর্ডিংয়ে ‘‌অনুপ্রেরণা’‌ শব্দটি থাকা বাধ্যতামূলক। তবেই তিনি খুশি। রাজ্যের প্রায় সর্বত্র সুপার স্পেসালিটি হাসপাতালের বিজ্ঞাপন চোখে পড়ে। বাস্তবে কী অবস্থা সেইসব তথাকথিত ‘‌সুপার স্পেশালিটি’‌ সরকারি হাসপাতালের? বিগত দু’বছর ধরে বাংলাতে ডেঙ্গু যখন মহামারীর আকারে আবির্ভূত হল, তখন তাঁর সাধের সুপার-স্পেশালিটি হাসপাতাল কী পরিষেবা দিল সাধারণ মানুষকে? কয়েকশো ডেঙ্গু আক্রান্ত হতভাগ্যের মৃত্যু হয়েছিল আর তিনি অলিখিতভাবে নিদান দিলেন ডেথ-রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ডেঙ্গু লেখা চলবে না। কখনও “ডেঙ্গু” কে “অজানা জ্বর” বলে চালিয়ে দিলেন, কখনও আবার দাবি করলেন ডেঙ্গু আক্রান্তেরা ভিনরাজ্যে বেড়াতে দিয়ে “ডেঙ্গু” তে আক্রান্ত হয়ে বাংলায় ফিরে এসেছে! অথচ সরকারি হাসপাতালের সামনে দাঁড়ালেই দেখা যায় নীল-সাদা রঙে সাজানো দেওয়াল আর এই কোণে ওই কোণে ঝোলানো হোর্ডিংয়ের গায়ে তাঁর ছবি আর জ্বলজ্বলে নাম। সবই তার “অনুপ্রেরণায়”। আচ্ছা তিনি তো আগেও শিল্প আনতে সিঙ্গাপুরে পাড়ি দিয়েছিলেন। কী কী শিল্প এসেছিল ? তার তালিকা দিতে পারবেন? জার্মানির মিউনিখ শহরেও গিয়েছিলেন শিল্প আনতে? লন্ডন, নেদারল্যান্ডেও গিয়েছিলেন। কী কী শিল্প এল আর তার মধ্যে কতগুলোর কাজ শুরু হল, তার একটা তালিকা দিন তো দেখি সৎসাহস থাকলে। মুম্বইতে গিয়ে রিলায়েন্সের কর্ণধার মুকেশ আম্বানির সঙ্গে মিটিং করে এসেছিলেন মাসকয়েক আগে। তার ফলস্বরূপ কী হলো আজ পর্যন্ত ? অথচ বড় বড় করে শিল্প সম্মেলনের প্রচার ঠিক চলছে। কিছু ‘তাঁবেদার’ সংবাদমাধ্যমও “শিল্পবন্ধু” বলে তাঁর সুখ্যাতি করছে । তারা যেন সিঙ্গুরের টাটা মোটর্সের ঘটনা ভুলে গেছে ! ভুলে গেছে ইনফোসিস এর ঘটনাও! শালবনিতে জিন্দাল গোষ্ঠীর স্টিল প্ল্যান্টের কথাও মনে হয় এই “তাঁবেদার” দের স্মরণে নেই।
সুতরাং প্রশ্ন একটাই। এই জাঁকজমক, ধুমধামের ফলাফল কী? মনে রাখতে হবে, বাংলার বর্তমান শাসক দল এমন একটা দল, যারা বাংলার গদি দখল করেছিল বাংলায় শিল্পায়নের বিরোধিতা করে। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রীর শিল্পায়নের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে রাস্তায় মিছিল করে আর বাংলার মানুষের মনে এই বিষ ঢুকিয়ে যে, বাম সরকার কৃষকদের জমি কেড়ে নিয়ে শিল্পপতিদের বিক্রি করে দিচ্ছে চড়া দামে! যে শিল্প স্থাপনের জন্য বাংলার পূর্ববর্তী মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন, টাটা গোষ্ঠীর সঙ্গে একাধিক আলোচনা করে সিঙ্গুরে তাদের হাতে জমি তুলে দিয়েছিলেন, শালবনিতে জ়িন্দাল গোষ্ঠীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ইস্পাত প্রকল্পের জমি, ইনফোসিস-উইপ্রোকে জমি দিয়েছিলেন, এই বর্তমান সরকার সককটি প্রকল্পই হয় বাতিল করেছে, নয়তো জমিজটে আটকে রেখেছে। তাই আজকে এদের আয়োজিত শিল্পসম্মেলনে দেশ-বিদেশের শিল্পপতিদের উপস্থিতিতে বিলাসিতা ও চটকদারির হয়তো অভাব নেই, তবু এই সাড়ম্বরে উদযাপিত সম্মেলনের ফলাফল এবং শিল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে একটা বিরাট সংশয় থেকেই যায়।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.