সরল বিশ্বাস
‘অনুপ্রেরণা’ বড় সাংঘাতিক জিনিস। শালবনিতে হওয়ার কথা ছিল ইস্পাত কারখানা, হচ্ছে সিমেন্ট কারখানা। জিন্দালদের এই প্রকল্পে বিনিয়োগ হওয়ার কথা ছিল ৩৫ হাজার কোটি, তার বদলে হচ্ছে মেরেকেটে ৮০০ কোটি (এটা কোম্পানির দাবি, বাস্তবে নিশ্চিতভাবেই অনেক কম)। কর্মসংস্থান হওয়ার কথা ছিল অন্তত পাঁচ হাজার মানুষের। তার বদলে হয়েছে মাত্র দেড়শো জনের। আরও হয়ত দেড়শো জনের হবে।
এরপরেও ঘটা করে উদ্বোধন হবে। বলতে হবে, মুখ্যমন্ত্রীর অনুপ্রেরণায় শিল্পে বাংলার দারুণ উন্নতি হয়েছে। এই নিয়ে ঘটা করে বেশ কয়েকটি শিল্প সম্মেলন হয়েছে। পারিষদবর্গকে নিয়ে বিদেশ সফরও কম হয়নি। ওই শিল্প আসছে, ওই শিল্প আসছে, বলে চিৎকার হয়েছে। সিপিএমের আমলে বাংলা খুব খারাপ ছিল, এখন সুজলা–সুফলা, প্রচারের এমন ঢক্কানিনাদও কম শোনা যায়নি। এবারও শিল্প সম্মেলন উপলক্ষে সারা বাংলায় যত হোর্ডিং টাঙানো হয়েছে, শুধু সেই টাকা দিয়েই অন্তত দশটি সুপার স্পেশালিটি হসপিটাল তৈরি হয়ে যেত। শিল্পপতিদের আসা–যাওয়া ও আপ্যায়নে যে খরচ হবে, তা দিয়ে অন্তত পঁচিশটি কলেজ হয়ে যেত। এত প্রচার, এত ঢক্কা নিনাদ। কিন্তু কী কী শিল্প হল, তার ফিরিস্তি নেই। বিধানসভার বাজেট বইয়েও কী চালাকি। কোথায় কত বিনিয়োগ, কোনও পরিসংখ্যান নেই। কোথায় কত কর্ম সংস্থান, তার কোনও স্পষ্ট ছবি নেই। হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া— দশ লাখ চাকরি।
মানুষের স্মৃতি বড়ই দুর্বল। শালবনিতে যে সিমেন্ট কারখানার আজ ঘটা করে উদ্বোধন, সেখানে ২০০৭ সালের ৮ নভেম্বর ইস্পাত কারখানার শিলান্যাস হয়েছিল। ফেরার পথে মাইন বিস্ফোরণ। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। সেদিন কী বিকৃত উল্লাস! মাওবাদীদের নিশানা লক্ষ্যভ্রষ্ট হল বলে চাপা আফশোসও শোনা গেছে অনেকের কণ্ঠে। সেই বিদ্বজ্জনরা নানা কমিটির ললিপপ মুখে দিয়ে আপাতত শীতঘুমে।
সে বড় সুখের সময় নয়। কোনও কারখানা হবে না শুনলে মিষ্টিমুখ হয়, বিজয়োৎসব হয়। ৩৫ হাজার কোটির বিনিয়োগ ৫০০ কোটিতে নেমে এলেও উৎসব হয়। অনেকের হয়ত মনে আছে, ২ বছর আগে ঘটা করে এই প্রকল্পেরই শিলান্যাস করেছিলেন সব ‘অনুপ্রেরণার উৎস’। কেন ৩৫ হাজার কোটি শেষমেষ ৫০০ কোটিতে নেমে এল, সেই প্রশ্ন উঠবে না। বুদ্ধিজীবীরা তো আগেই শীতঘুমে। মিডিয়াও নীরব থাকবে। পাতাজোড়া বিজ্ঞাপন বড়ই মহার্ঘ্য। কে আর তা হাতছাড়া করতে চায়! অতএব, গলা ফুলিয়ে বলুন, উন্নয়ন চলছে। আর হ্যাঁ, সঙ্গে ওই ‘অনুপ্রেরণা’ শব্দটা জুড়তে ভুলবেন না।