(আজ এক মহান কবি ডিলিট পেলেন। ঠিক দু’বছর আগে। এক বঙ্গীয় কবিকে ডিলিট দিয়েছিল উত্তরবঙ্গের এক বিশ্ববিদ্যালয়। সেদিন তাঁকে একটি মানপত্র দেওয়া হয়েছিল বেঙ্গল টাইমসের পক্ষ থেকে। পাঠকদের দাবিতে তা পুনরায় প্রকাশ করা হল। দেখুন তো, সেই কবিকে চিনতে পারেন কিনা। )
কোনও এক রাজ্যের কোনও কবি কোনও এক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট পাচ্ছেন। সরকার তাঁর নামের সঙ্গেই জড়িয়ে আছে। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী সেই কবিকে বেঙ্গল টাইমসের পক্ষ থেকে অগ্রিম মানপত্র। লিখেছেন রবি কর।
হে মহাকবি, তোমাকে প্রণাম।
‘শিক্ষঙ্গনে শাসকের হস্তক্ষেপ চলিবে না।’- এই নীতিবাক্যকে delete করিয়া মন্ত্রীর সুপারিশে তুমি ডিলিট লাভ করিয়াছো। এই সংবাদ শ্রবণে আমরা পুলকিত হইলেও চমকিত হই নাই। কারণ, তোমার নিকট হইতে, তোমার পৃষ্ঠপোষক সরকারের নিকট হইতে, তোমাকে ডিলিট প্রদানকারী সরকারি অনুদানপুষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের নিকট হইতে ইহাই প্রত্যাশিত। তাই, হে ডিলিটেন্দ্র, তোমাকে, শিক্ষামন্ত্রীকে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ও সরকারকে আমরা প্রণাম জানাই।
বাংলা সাহিত্যের মহাকাশে ক্ষুদ্র-বৃহৎ-জানা-অজানা অগণিত তারকার মধ্যে তোমার আসন ধ্রুবতারার ন্যায় অবিচল। তুমি ধন্য। অপরাপর সকল নক্ষত্রকে ছাড়িয়া ধ্রুবতারার সহিত তোমার তুলনা করিলাম। কারণ, ধ্রুবতারা যেমন উত্তর আকাশে নিজস্থানে অনড় থাকে, তুমিও তেমনি সরকারের পার্শ্বে অনড় থাকো। আগামীদিনে যদি কোনও উদীয়মান কবি, শাসকের পুচ্ছ ধরিয়া দ্রুত উন্নতি করিতে চাহে, তবে সে তোমাকেই জীবনের ধ্রুবতারা করিবে, সন্দেহ নাই। হে স্তাবকচূড়ামণি, তোমাকে আমরা প্রণাম জানাই।
আমরা শুনিয়াছি, ‘রতনে রতন চেনে, শাসকে চেনে স্তাবক’। সঠিকই শুনিযাছি। শুধু যে শাসকরা স্তাবককে চেনে, তা নহে। স্তাবকরাও স্বততই শাসকদের চিনিয়া লয়। জগতের ইহাই বিধি। কালীদাস, ভানভট্ট, হলায়ুধ, ভারতচন্দ্র, আবুল ফজল সকলেই শাসকের নিতম্বে নিতম্বে ঘুরিয়াছে। কিন্তু ইহাদের্ ছাপাইয়া গিয়াছো। শাসকের উক্ত অঙ্গ যে চেয়ারে স্থাপিত হইবে, তাহা নিজ রুমাল দিয়া মুছিয়া তুমি রুমালকে ধন্য করিয়াছো। হে চেয়ার-বান্ধব, তোমাকে প্রণাম।
আমরা বাঙালিরা জাতি হিসাবে নিতান্তই বেওকুফ। তাই আমরা সাহিত্যিক দেখিলেই তাঁহাকে রবীন্দ্র, নজরুলের উত্তরসূরী জ্ঞান করিয়া থাকি। আমাদের নিকট রবীন্দ্রনাথ মানে নাইটহুড ত্যাগ, নজরুল মানে রাজদ্রোহ, শরৎচন্দ্র মানে পথের দাবি। আমরা জানিতাম না, শাসকের চেয়ার মুছিয়া দেওয়া তাঁহার সমর্থনে মিছিল করা, তাঁহার হইয়া ভোট ভিক্ষা করা সাহিত্যিকের কর্ম হইতে পারে। তুমি আমাদের সেই জ্ঞান দিয়াছো। তুমি আমাদের নব্য কবিগুরু। হে গুরু, তোমাকে প্রণাম করি।
তুমি জানো কোন দেবতা কোন পুষ্পে সন্তুষ্ট হয়। কোন শাসক কোন ভাবনায় প্রসন্ন হয়। নামের সঙ্গে সরকার, তুমি তাই সরকারের সঙ্গে জুড়িয়া থাকো। অতীতে নন্দীগ্রাম পর্বে তুমি নিহত গ্রামবাসীদের রক্তকে শ্রেণিশত্রুর রক্ত ভাবিতে। কারণ, অতীতের শাসক তাহাই ভাবিত। বর্তমানে তুমি কামদুনির ধর্ষিতা তরুণীর রক্তকে সাজানো রক্ত বলিয়া মনে করো। কারণ, বর্তমানের শাসক তাহাই মনে করে। হে শাসকের স্নেহধন্য, তোমাকে প্রণাম।
তোমার মেরুদন্ডের নমনীয়তা দেখিলে রবার লজ্জা পায়। তাহা যখন যেদিকে, তখন সেদিকে হেলিয়া পড়ে। তোমার চিত্ত শিশুদের ন্যায় তরল। তাহা যে পাত্রে থাকে, তাহার আকার ধারণ করে। তোমার ত্বক দেখিয়া গিরগিটি বিস্মিত হয়। তাহা কখনও লাল, কখনও নীল সাদা, প্রয়োজন বুঝিলেই গেরুয়া হইবে। তুমি শাসক ভিন্ন কাহারও পক্ষে থাকো না। তাই তুমি নিরপেক্ষ। হে নিরপেক্ষ, হে মেরুদন্ডহীন, হে তরলমতি, হে বহুরূপী, তোমাকে আমাদের শত শত প্রণাম।
তুমি অপরের কীর্তিতে বাঁশ দিয়া নিজ কীর্তি স্থাপন করিতে চাহ। তাই তুমি নতুন কৃত্তিবাস নামক পত্রিকা প্রকাশ করো। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় তোমার তুলনায় নিতান্তই তুচ্ছ। তাঁহার পত্রিকার যশোভাগ গ্রহণ করিতে তোমার এত লোলুপতা কেন, আমরা বুঝিতে পারিতেছি না। আমাদের বুঝাইয়া দাও। লোকে বলে, অবোধের গো বধে আনন্দ। তোমার ন্যায় সুবোধের কীসে আনন্দ, আমাদের বুঝাইয়া দাও।
তুমি শুধু কবি নও, তুমি সাধক। প্রকৃত সাধকের ন্যায় তুমি সুখে, দুঃখে নিরুদ্বিগ্ন। তাই স্ত্রীর প্রয়াণের পর তুমি শোক না করিয়া হিসাব করো কাহারা কাহারা আসিয়াছে। লাল পন্থীরা রোগশয্যায় তোমার স্ত্রীর পার্শ্বে ছিল। অপর কেহ ছিল না। কিন্তু শবযাত্রার সময় তোমার মনে হইল, লালপন্থীরা যথেষ্ট সংখ্যায় আসে নাই। তখনই তুমি নীল-সাদা দলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত লইলে। ঘোষণা করিলে, তুমি আর লাল পন্থী নাই। অর্থাৎ তোমার আদর্শবাদ কোনও নীতি নয়, কেবল নিজ ধান্দার উপরে প্রতিষ্ঠিত। হে বাস্তববাদী, তোমাকে প্রণাম।
তোমাকে প্রণাম। কারণ, তুমি কবিতা লেখো। কারণ, তোমার দাড়ি আছে। কারণ, রবীন্দ্রনাথও কবিতা লিখতেন। কারণ, রবীন্দ্রনাথেরও দাড়ি ছিল। এবং তর্কশাস্ত্রের নিয়ম অনুযায়ী, আর্ একটি প্রাণীর দাঁড়ি আছে। হে দাঁড়ীশ্বর, তোমাকে প্রণাম।
তোমাকে প্রণাম। কারণ, তুমি হয়ত রাজ্যসভায় যাইবে্, হয়ত সাহিত্য আকাদেমির প্রধান হইবে। হয়ত তোমার রচনা সিলেবাসের অন্তর্গত হইবে। তোমাকে দেখিয়া চন্ডি-মধু- রবীন্দ্রের গর্বিতা জননী বঙ্গ সরস্বতী ‘ধরনী দ্বিধা হও’ বলিয়া ক্রন্দন করিবেন। হে সরস্বতীর বর(x ২) পুত্র, তোমাকে প্রণাম। তোমাকে প্রণাম। তোমাকে প্রণাম।