অম্লান রায়চৌধুরী
সব ব্যাথারই উপসম আছে হয় ওষুধে না হয় উপড়ে দিয়ে। হাতে ফোঁড়া যখন যন্ত্রনা দেয় ফাটিয়ে ফেলতে হয়, রেখে দিলে হয়ত হাতটাই বাদ দিতে হয় – পচে যায়। জানি যার হাত তার তো কষ্ট হবেই, আরও জানি সেই হাতের ভরসায় যারা আছে তাদেরও কষ্ট হবে। আরও জানি, ওই ফোঁড়াটা বহুদিন যত্নে লালিত হয়েছে, ফলে বেশ তেজ, তাই কাটার যন্ত্রটাও বেশ ধারালো হতে হবে। এই যে লালন, যাকে রাখা যাবে না জেনেও, বড়ই সমস্যা তাকে ওপড়ানো। হ্যাঁ এই লালনের অবশ্য প্রয়োজন ছিল। উদ্ধার কর্তা ভাবারও কারণ ছিল। লালিত যে, সে তো আমোদ চাইবেই, উড়তে চাইবেই, নিয়ম নীতির কড়াকড়ি তো মানবেই না, নিজের বক্তব্য রাখবেই, বিরোধী কথাবার্তা বলবেই, – এতদিনের মান্যতা পাওয়া যে সব আচার আচরন, একদিনে কী করে উড়ে যাবে– এটা তো মানতে হবে। সেই চেষ্টা করাটাই বৃথা, তার থেকে সম্পর্ক ত্যাগ করো। সেটাই ভাল। শুদ্ধি করণ না কি যেন বলে, ওসব হবে না — দর্শন, সংস্কৃতি – শিক্ষা – মনন সব গিয়ে ঠেকেছে – হয় প্রোমোটারিতে না হয় দালালিতে। সব ঘেঁটে গেছে — শত গঙ্গাজলেও স্বচ্ছতা আসবে না- এখন কী উপায়। ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছি পাড়ার মোড়ে। দেখা ভূতোদার সঙ্গে,
আমি- কি ভূতো দা, কেমন আছো
ভূ – আর কেমন আছো, একটা বন্ধ দরজা খুলতে এত দিন লাগলো।
আমি – এতো যে সে দরজা নয়, অনেক দেশের পতাকায় সজ্জিত, কোনও পতাকার দর্শন, কোনও পতাকার আক্রমন, কোনও পতাকার পতন – সবই তো লটকে আছে। নিজের পতাকাটা যত মলিন হচ্ছে, ততই অন্য পতাকারা জ্বল জ্বল করছে, দেখছো না। তাই এত ভার – অত সহজে খুলবে কী করে।
ভূ——- থাক না ভার, আমি ভাবছি দরজা কি আর বন্ধ রাখার দরকার আছে, সবই তো খোলামেলা হয়ে গেছে। মানুষকে চেনা, মানুষের চেনা– দুটোই শেষ – সিদ্ধান্তও নেওয়া হয়ে গেছে ।
আমি— না না দরকার আছে এখনও বন্ধ রাখার, বেশ কিছু তালা বড়ই জংধরা, ওগুলোকেও তো খুলতে হবে। ওই কিছু লালন করা ফোঁড়া। বেশ কিছুদিন ধরেই পেকে রয়েছে। ওপড়াতে গেলে যে বাড়ি সুদ্ধ সকলেরই ব্যাথা লাগবে। তাই একটু ধীরে ।
ভূ —– এতদিন ধরে কী করল তাহলে, যেখানে মানুষও চেনা – ফোঁড়াও জানা –
আমি– এতদিন তো আশায় থাকা, মানুষই আসবে কাছে—— এই ভাবনায়, শুধু ভুল খুঁজে বেড়ানোর খেলায় – নিজের সঠিক রাস্তাটাই হারিয়ে ফেলল যখন – তখন বুঝল। জানি না এখনও বোঝা হল কিনা।

ভূ —– আরে না না, ওটা একটা খেলা, কালক্ষেপন খেলা, চাকরিতে দেখিসনা – সকাল দশটায় অফিস যাওয়া আর বিকাল পাঁচটায় বাড়ি ফেরা – ওই ছন্দ থেকে তো সরে আসা যাবে না । সংসারটা তো দেখতে হবে। সম্পদ যা আছে, চলে যাবে এভাবেই বেশ কিছু কাল, আর যদি বিড়ালের ভাগ্যে শিকা ছেড়ে তো কথাই নেই । দিশা ঠিশা এখন আর ভেবে লাভ নেই।
আমি – তাহলে ওই যে ওরা যারা বিপথে গেল, মরে গেল, দর্শন আঁকড়ে থেকে, আজকের যুগে অকেজো প্রতিপন্ন হল, তাদের কী হবে ।
ভূ — আরে দুর , আপনি বাঁচলে বাপের নাম, দেখিসনা কেমন মাঝে মাঝেই একটা ইস্যু , কিছু মিছিল, কিছু আমদানি, — চলছে তো বেশ। আমিও জানি ওরাও জানে এটা চলা নয় , দেখান চলা।
আমি— মানলাম, কিন্তু যারা এখন জীবনের শেষ প্রান্তে, বহুদিনের বুদ্ধিবেচা মানুষ, পাকা মাথা , নিজের কোন সমস্যা আর নেই , সবাই স্থিতু , গোছান শেষ , বাকি কিছু সময় কাটানো – এদেরি তো ভীড় বেশী , এদেরই ত আস্তানা এখন — সামনে সি আর পি ও নেই , পাড়ায় পাড়ায় হুমকিও নেই , বাড়ী থেকে চলে যেতে বলাও নেই , হ্যাঁ একটু চুপচাপ থাকলেই হলো – ঝামেলায় না জড়ালেই হলো – বেশ চলবে – যেমন চলছে।
ভূ— এরা তা হলে বৃদ্ধাশ্রমে যায় না কেন, ওখানে তো বেশ আরামে থাকবে ।
আমি – না না তাকি হয় , বাড়ির ভাত খেতে হবে, অভাব যখন নেই স্বভাবটাকে বজায় রাখতে হবে, একটু জটলা, কিম্বা কিছু মন্তব্য, জমায়েতে গা মেলান – এগুলো ছাড়া বাঁচবে কীভাবে। এরা সমাজ চায় –যে সমাজে রাজ করা যায়। রাজ করাটা এখন পারা যায় না বলে কি সমাজ ছেড়ে চলে যাবে নাকি। আর যাদের বলবার তারা তো নিজেদের মধ্যেই ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত, কেউ কেউ আবার ওই ঝামেলায় নিজেকে সামিল করে কিছু গুছিয়ে নিচ্ছে। মোটের উপর আছে ভাল ।
ভূ — তাহলে আন্দোলন প্রতিবাদ – এগুলোর কী হবে।
আমি—ওগুলো আপনা আপনিই হবে , কিছু মানুষ তো আছে , যাদের আর কিছুই করবার নেই, হয় সে অবসর প্রাপ্ত, অথবা এমনি গভীর ছাপ যে পাল্টানোর উপায় নেই, তাদেরও তো একটা বিনোদন দরকার, এটা তো বিনোদনের মতই – হঠাৎ করে সংস্কৃতির গতি প্রকৃতির উপর দৃষ্টি পড়ল, কিছু নাটক, কিছু ডিবেট – লোকের সমাগমে কিছু বলা – যেটা না বললেও লোকে বোঝে – অথবা যে টা বলা আর মানায় না – এরকম করে কাটে ভাল, তাই আর যাব কেন বানপ্রস্থে , এখানেই তো আছে অনেক শ্বাস ।
ভূ — অনেকে যে এখন স্বপ্ন দেখে , জনগনতান্ত্রিক বিপ্লবের , সাম্রজ্যবাদীর ছায়ার
আমি- ওগুলো দেখে বা পড়ে, নিজের সোফায় বসে হুইস্কি খাওয়ার সময়। কিছু কঠিন তাত্ত্বিক বইও পড়ে। এগুলোই তো শ্বাস – চলছেই – নিজের অবস্থানের ভাবনা নেই –দৈনন্দিন চাহিদার টানা পোড়েন নেই। নিজেকে সমৃদ্ধ করার চেষ্টা খাতায় কলমে – এটাই তো চায়, পাচ্ছেও। বাধা নেই কোনও। যারা বাধা দেবে তারাও শিখছে, অনুকরণ করছে, তাদেরও তো ভাবতে হবে ভবিষ্যৎ।
কিছু বোকা মানুষ এখনো স্মৃতি , নীতি আঁকড়ে শুধু শুধু মার খাচ্ছে – আসলে ওরা বোকা এক গুঁয়ে – কিংবা স্থিতু হওয়ার দৌড়ে হেরে যাওয়া –
এগুলোই তো বেঁচে থাকার রসদ , চলে যাবে কেন ।
ভূ – তাহলে বল , ওরা মোটের উপর আছে ভাল ।
ভূতোদাকে ছেড়ে চলে এলাম, ভাবছিলাম পাশের বাড়ির সবিতা মাসির কথা। স্বামীর কারখানা উঠে যাওয়ায়, চাকরি খুইয়ে কেমনভাবে গলায় দড়ি দিয়ে মরে গেল, তিনটে বাচ্চাকে অনাথ করে দিয়ে।
সবিতা মাসি কিন্তু কোনও সমঝোতা করেনি, এখনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করে মাথা উঁচু করে।
