নীল নির্জনে মুকুটমণিপুর

সন্দীপ লায়েক
————————
এক
——-
নীল নির্জনে সিনেমাটা দেখেছেন? হয়ত অনেকেই দেখে থাকবেন। যারা দেখেননি তাদের বলব, একবার অন্তত দেখে নিন। চমৎকার সিনেমা, দারুণ লোকেশন, সঙ্গে উপরি পাওনা হিসেবে ক্যাকটাসের ফাটাফাটি গানগুলো। তবে আমি এখানে যেটা নিয়ে বলতে চাইছি সেটা হল ছবির লোকেশন- বাঁকুড়ার মুকুটমণিপুর, সঙ্গে অবশ্যই দোসর হোটেল পিয়ারলেস ইন।

অবশ্যি যে সময় সুব্রতবাবু সিনেমাটা বানিয়েছিলেন সে সময় মুকুটমণিপুরে সেভাবে প্রচারের আলোয় পৌঁছয়নি। স্বাভাবিক ভাবেই জায়গাটা তাই হোটেলে-মানুষে ছয়লাপ হয়নি, বলতে গেলে বছরভর নীল নির্জনেই ছিল।

mukut monipur2

দুই
—–
মুকুটমনিপুর মূলত একটি জলাধার বা ড্যাম, যেটি কংসাবতি ও কুমারী নদীর মোহনায় অবস্থিতl যার একদিকে বাঁকুড়া অন্যদিকে ঝাড়খন্ডl এটিই হল পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মনুষ্য সৃস্ট জলাধারl তার গা ঘেঁষে উঠেছে ছোট্ট একটি টিলা- পাহাড়।

পাহাড়ের ওপরে জাগ্রত শিব মন্দির, যেখান থেকে আপনার দৃষ্টি আপনার মনকে নাড়া দিয়ে ছুটে যাবে বহুদূর। নীচে ভেসে উঠবে ধানখেত, তালগাছ, গ্রামের দৃশ্যপট। যদিও এ টিলা-পাহাড়ে উঠতে আপনার ট্রেকিং জানার মোটেই প্রয়োজন নেই, শুধু একটু ইচ্ছে আর পায়ের সামান্য জোরই যথেষ্ট।

ড্যামের ওপর দিয়ে চলে যাওয়া বাঁধানো রাস্তাটা (প্রায় ১৪ কিমি) আপনাকে হাতছানি দেবেই দেবে। ড্যামের সৌন্দর্য উপভোগ করতে বা নিজেকে খুঁজে পেতে ভ্যান বা টোটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়লেই হল। সেখানে আজ নতুন সংযোজন মুসাফিরানা পার্ক।

বাঁকুড়া শহর থেকে মুকুটমণিপুরের দূরত্ব প্রায় ৫৫ কিমি এবং খাতড়া শহর থেকে মাত্র ১২ কিমি। কলকাতা বা বাঁকুড়া থেকে সরাসরি বাসে দিব্যি চলে যাওয়া যায় মুকুটমণিপুর। এছাড়া ট্রেনে বা বাসে বাঁকুড়া বা খাতড়া পৌঁছে গাড়ি ভাড়া করেও চলে যেতে পারেন। বাঁকুড়া থেকে প্রায় ঘন্টা দেড়েকের পথ। গ্রাম বাংলার আদি রূপ দেখতে দেখতে আর সারি সারি গাছের মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া রাস্তার রূপ সময়টাকে আরও কম মনে হতেই পারে। বাঁকুড়া থেকে ট্যাক্সির আনুমানিক খরচ হাজারের মধ্যে।

ড্যামের চার কিলোমিটারের মধ্যেই পড়বে জৈনদের পুরাতন শহর অম্বিকানগর। দু কিলোমিটারের মধ্যেই পড়বে বনগোপালপুর রিজার্ভ ফরেস্ট, যেখানে দৃষ্টি নন্দনের খোরাক হিসেবে আপনি পাবেন হরেক রকম পাখি ও নানান বুনো ফুল। ডিয়ার পার্ক তো আছেই, কপাল ভাল থাকলে দেখা মিলতে পারে পাতার নীচে হুস করে মাথা লুকিয়ে পড়া খরগোশ বা সজারুদের।

তাই ক্যমেরার সঙ্গে নিজেদের বয়ে নিয়ে উইক এন্ডে আরামসে ঘুরে আসতে পারেন এই সুন্দর ডেস্টিনেশন। আর মাওবাদী? হা হা হা! ..দুই হাতে দুই কান চাপা দিয়ে মা–‌কালী হয়ে পড়ুন।

mukut monipur3

তিন
——-
আমার বাড়ি বাঁকুড়ায়। তাই প্রায় প্রতিবছরই নিয়ম করে পঁচিশে ডিসেম্বর থেকে পয়লা জানুয়রির মধ্যে বন্ধুদের নিয়ে একবার সেখানে পা ছুঁইয়ে নিজেকে কৃতার্থ বোধ করি। অফিস ট্যুরেও একবার কলকাতা থেকে মুকুটমণিপুর গেছি। পিয়ারলেস ইনের যে ঘরগুলোতে সিনেমাটির শুটিং হয়েছিল সেখানেই থেকেছি। সত্যি বলতে কী, পিয়ারলেস ইনের আতিথ্য, বাফেট ও বন ফায়ার আজও মনে ভাসে। বাজেট একটু বেশি হলে বলব, ওখানেই উঠুন। যদিও সরকারি বনবিভাগের বাংলো থেকে শুরু করে অনেক রেঞ্জের হোটেলেই আজ সেখানে তৈরি হয়েছে।

তাই যখনই সেখনে যাই পিয়ারলেস ইনের ধার দিয়ে লেকের গা ছুঁয়ে হেঁটে বেড়াই। ফুটন্ত হলুদ সরিষার ক্ষেত থেকে পাহাড়টাকে দেখি, কখনও বা আদর করে তার পিঠে চড়ি, নৌকো ভিড়িয়ে ডিয়ার পার্কে গিয়ে বসে থাকতে থাকতে অস্তাচলগামী সূর্যের সুধা পান করি। মনটা তখন এক অনাবিল আনন্দে ভরে ওঠে।

চার
——
আর ওই নীল-নির্জনতা?
মেখলা বা কুয়াশা না থাকলে ঘন নীল আকাশ তো আপনার সঙ্গী হবেই। ডিসেম্বরের শনি-রবি বা পিক সিজন ছেড়ে গেলে, নির্জনতাটাও পাবেন।

কটা দিন হাইজিনকে পাত্তা না দিয়ে পাশাপাশি গ্রামের প্রাণবন্ত লোকগুলোর সঙ্গে মিশুন, দেশি মুরগীর ডিম মাংস খান, দু টাকার ঝাল চপ খান, কাঁচের গ্লাসে নির্ভেজাল দুধের চা খান, নৌকো নিয়ে ডিয়ার পার্কে পৌঁছান, পার্কে আপনারই প্রতীক্ষায় থাকা হরিণ গুলোকে নিজের হাতে খাওয়ানl তারপর নিজেকে শুধান এই নির্জনতা আপনার ভাল লাগলো কি না?

আর শীত নামলে, তাড়ি খাবেন না? সেটা অবশ্য আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তবে খেলে গিন্নির চিল চিত্কারটাও মধুর মনে হবে! জেনে রাখুন, ভোর বেলায় সহজেই সেখানে মিলতে পারে পছন্দের খেজুর রস বা মাতাল করা তাড়ি ও গুড়। একটু খোঁজ নিলে পেয়ে যেতে পারেন দেশি মহুয়ার রসও। বাড়ি বা শখের জন্য কিনে নিতে পারেন নানান সৌখিন বাঁশের কাজ।

হাতে সময় থাকলে আরও দুটো দিনে ঘুরে নেওয়া যায় জয়পুর ফরেস্ট ও মন্দির নগরী বিষ্ণুপুর।

আপাতত যতদিন না সেখানে যেতে পারছেন youtube-এ দেখে ফেলুন সিনেমাটা। নিদেনপক্ষে mp3 তে শুনতে থাকুন Nilnirjone গানটা, আর গুনগুনাতে থাকুন:

দিনে রাতে চলে শুধু একঘেয়ে মন্তাজ,
ক্রমে ক্রমে স্নায়ু শিথিল,
মুখোসে হারায় চেনা চেনা সেই মুখটা,
স্বপ্ন হারায় ক্লোরোফিল।
তাই, নীলনির্জনে..নীলনির্জনে..

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.