সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি
ধর্মতলায় বিজেপির সভায় মুকুল রায়ের বক্তব্য ও পুরোনো দল তৃণমূলের বিরুদ্ধে অভিযোগ তথা বিষোদগার টিভি চ্যানেলে দেখে এবং শুনে আজ এই কথাটাই সবার আগে মনে পড়ে যাচ্ছিল। আজ আর মুকুলবাবুকে পায় কে? তাঁর এতদিনের সুপ্ত ও গুপ্ত প্রয়াস সার্থক হয়েছে আজকে! স্বভাবতই তাঁর প্রশান্ত, প্রসন্ন মুখ ও অভিব্যক্তি এবং তাঁর মুখনিঃসৃত বচন শুনে মঞ্চে উপবিষ্ট বিজেপি নেতাদের করতালি দেখে মনে হচ্ছিল যেন, বাংলায় বিজেপির কোনও নেতা মুখ্যমন্ত্রী পদে শপথ নিচ্ছেন !!
আসলে এই দৃশ্যের “চিত্রনাট্য” বিগত কয়েক বছর ধরেই দেশের নানা স্থানে লেখা হচ্ছিল। ভারতীয় রাজনীতিতে এমন দৃশ্য আগেও বহুবার দেখা গেছে। বিশেষতঃ বামবিরোধী বা দক্ষিণপন্থী দলের নেতাদের মধ্যে। বামবিরোধী সত্তাটিকে জিইয়ে রাখাই এই রাজনৈতিক রঙবদলের প্রধান উদ্দেশ্য। আর এখানে শুধু বামবিরোধী সত্তা নয়, সেই রঙবদলকারী “বহুরূপী” ব্যক্তিটি এমন একজন যে, বাংলা তথা ভারতীয় রাজনীতিতে তাঁর মতো আকণ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্ত খুব কম নেতাই এসেছেন। যদিও তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির পাহাড়প্রমাণ অভিযোগ অদূর ভবিষ্যতে প্রমাণ হবে কিনা, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন!
আর নিজেকে স্বচ্ছ, সৎ প্রতিপন্ন করতেই তাঁর এই রঙবদল। তবু তাঁর বিরুদ্ধে ২০১১ সালে বাংলায় রাজনৈতিক পালাবদলের আগেই সিপিআইএম নেতা তথা রাজ্যের তদানীন্তন আবাসন মন্ত্রী গৌতম দেব যে আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলেছিলেন, তা আজ বহুলাংশেই সত্যি একথা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেদিন গৌতম বাবুর অভিযোগ শুনে বাংলার সিংহভাগ মানুষ শুধু তাঁকে অবিশ্বাসই করেনি, তাঁর মানসিক সুস্থতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছিল। ২০১১ সালে রাজ্যে রাজনৈতিক পালাবদলের পরেও গৌতম দেব এই অভিযোগ একাধিকবার করেছেন মুকুল রায়ের নামে। তাঁর বিরুদ্ধে সারদা চিটফাণ্ড কেলেঙ্কারিরও অভিযোগ উঠেছিল। মুকুল রায় সেদিন গৌতমবাবুর নামে মানহানির মামলাও করেছিলেন। যদিও কুড়িবারেরও বেশি নানা বাহানায় আদালতের হাজিরা এড়িয়ে গেছেন। বরং গৌতমবাবু একাধিকবার বিধাননগর থানাতে তথা আদালতে গিয়ে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন। সারদা মামলাতে সিবিআই এর হস্তক্ষেপও বামপন্থীদের লড়াই এরই ফসল। মুকুল রায় তখন তৃণমূলের সাংসদই শুধু নন, তিনি দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদকও বটে। সারদা কেলেঙ্কারিতে সিবিআই এর হস্তক্ষেপের নির্দেশ শুনে তার প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিলো, “সারদা মামলার উদ্দেশ্য রাজনৈতিক। রাজনৈতিক স্বার্থেই সিবিআইকে ব্যবহার করছে কেন্দ্রের শাসকদল”। তারপর থেকেই তিনি নিজের মান বাঁচাতে কেন্দ্রের শাসকদল তথা বিজেপির সর্বভারতীয় নেতা ও মন্ত্রীদের শরণাপন্ন হন। “দলের কাজে দিল্লিতে আছি” বলে বারবার তিনি দলীয় সভাতে অনুপস্থিত থাকলেও এর নেপথ্যের গূঢ় রহস্যটা যে কী ছিল, তা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। তখন থেকেই গোপনে গোপনে বিজেপির সঙ্গে তাঁর সখ্যতা শুরু। পরে নারদ কান্ডে ক্যামেরার সামনে টাকা লেনদেনের বিষয়টি সর্বসমক্ষে আসতেই মুকুল রায় বুঝেছিলেন “আর উপায় নেই”। যে সিবিআই এর নামে তিনি দলের কাজে ব্যস্ত আছি বলে বারবার হাজিরা এড়াতেন, তার রক্তচাপ দ্বিগুণ হয়ে উঠতো যে সিবিআই এর নামে, বিজেপির সঙ্গে গোপনে সেটিং হয়ে যাওয়ার পর থেকেই তিনি ছিলেন ফুরফুরে মেজাজে। আর আজকে ধর্মতলার সভা থেকে তিনি কার্যত কেন্দ্রের গোয়েন্দা সংস্থা সিবিআই ও ইডির প্রশংসাই করলেন। সত্যি সরীসৃপ প্রজাতির “গিরগিটি” বা “বহুরুপী” রাও এই ভোলবদল দেখে হয়তো লজ্জা পেত! দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ খোয়াবার পরে পৃথক রাজনৈতিক দল গঠন করে যিনি সংখ্যালঘুদের কাছে টানতে বারবার ফুরফুরা শরিফে যেতেন বা ইমামদের পেছনে ঘুরতেন ইসলাম ধর্মীয় বেশভূষা পরিধান করে আর বিজেপি কে “সাম্প্রদায়িক” দল বলে তুলোধনা করতেন, আবার বর্তমান বাংলার শাসকদলকেও সংখ্যালঘু উন্নয়নে অপারগ বলেছিলেন সেই তিনিই কিনা সেদিন বিজেপিতে যোগদান করেই বলে দিলেন,“বিজেপি মোটেই সাম্প্রদায়িক দল নয়”। আর আজকে তাঁর উপলব্ধি, “বাংলার তৃণমূল সরকার সংখ্যালঘুদের তোষণ করছে”! যে সিদিকুল্লা চৌধুরি কিছুদিন আগেই সুপ্রিম কোর্টের তিন তালাক রায়ের চূড়ান্ত বিরোধিতা করেছিলেন, সেই তিনি ছিলেন মুকুল রায়ের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। আর আজকে ? তিনি সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অধিষ্ঠিত, শুধু নিজের রাজনৈতিক সত্তাটিকে সৎ এবং স্বচ্ছ প্রমাণ করতে। আজকের সভা তিনি মুখ্যমন্ত্রীর ভাইপো অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের নামে কেচ্ছা কেলেঙ্কারির অভিযোগ করছেন। কিন্তু এতদিন তো সেই দলে থেকেই নিজের আখের গুছিয়েছেন। তিনি কি জানতেন না তৃণমূল কংগ্রেস দলটি আপাদমস্তক দূর্নীতিগ্রস্ত দের দল ? সমাজবিরোধীদের আখড়া ! বুঝতে এত বছর লেগে গেল? তিনি তো তৃণমুলের জন্মলগ্ন থেকেই তৃণমুলের সঙ্গে ছিলেন। তিনি জানতেন না খুন, ধর্ষণ, জালিয়াতি, তোলাবাজি, আর্থিক তছরুপ, ঘুষ খাওয়া থেকে শিক্ষা, কৃষি, শিল্প, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য,পরিবহন—সর্বস্তরে দুর্নীতি এবং নৈরাজ্য এই দলটির প্রধান বৈশিষ্ট্য? আজ তিনি মুখ্যমন্ত্রী ও তার ভাইপোর বিরুদ্ধে বিষোদগার করে নিজের পাপস্খলনের প্রয়াস চালাচ্ছেন, অথচ দলের গুরত্বপূর্ণ পদ অলঙ্কৃত করে দিনের পর দিন আর্থিক তছরুপের সাহায্যে বিরোধী দলের বিধায়ক, কাউন্সিলর, নেতা-কর্মীদের দল ভাঙিয়ে তৃণমূলে যোগদান করাতেন অর্থ ও পদের লোভ দেখিয়ে। যে ডেলো পাহাড়ে সারদা চিটফাণ্ড সংস্থার কর্ণধার সুদীপ্ত সেনের সঙ্গে মিটিংয়ের কথা তিনি আজকে স্বীকার করে নিলেন, সেই একই অভিযোগ যখন সি.পি.আই.এম নেতা গৌতম দেব করেছিলেন, সেদিন তিনি সবকিছু ফুৎকারে উড়িয়ে দিয়ে গৌতমবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলা করেছিলেন। সেদিন কোথায় ছিল তাঁর এই “সততা”, তাঁর এই “স্বচ্ছতা”?
মুকুলবাবু,আজ আপনি “সাধু” সাজছেন। পুরনো দলের একদা সহকর্মীদের বিরুদ্ধে কেলেঙ্কারির অভিযোগ তুলছেন। কিন্তু সেই দলে থেকেই আপনি এতদিন ক্ষমতা উপভোগ করেছিলেন, আর সেই ক্ষমতা এবং নিজের পদের গুণেই একের পর এক আর্থিক দুর্নীতিতে আকণ্ঠ নিমজ্জিত হয়েছেন। সত্যি আপনি বাহাদুর বটে !