তৎকাল তৃণমূল কে তৈরি করল?‌

স্বরূপ গোস্বামী

অনেকদিন আগেই কথাটা শোনা গিয়েছিল। আবার উঠে এল, দলের মহাসচিবের কণ্ঠে। তৎকাল তৃণমূল। এতদিন নিচুতলার লোকেরা বলছিলেন। দল মানতে চাইত না। যাক, এখন দলের মহাসচিবও বলতে শুরু করেছেন।
হ্যাঁ, তৃণমূল এমন একটা দল, যেখানে হঠাৎ এসে দলীয় ও সরকারি পদ পাওয়া যায়। অন্য দল থেকে অপকর্ম করে এলে, আরও দ্রুত পদোন্নতি হয়। এই রাস্তায় তৃণমূল সুপ্রিমোই দেখিয়েছেন। পুরনো তৃণমূলিদের থেকে পরে আসা তৃণমূলিদের কদর বেশি। টাটকা তৃণমূলিদের কদর আরও বেশি। লোকসভা থেকে রাজ্যসভা, বিধানসভা থেকে জেলা পরিষদ, বিভিন্ন কমিশনের চেয়ারম্যান থেকে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি— সব জায়গাতেই ভুরি ভুরি উদাহরণ। প্রায় সব জায়গাতেই তৎকাল তৃণমূলের ছড়াছড়ি।
একেবারে সাম্প্রতিক একটি উদাহরণ তুলে ধরা যাক। কে আদি, কে নব, কে তৎকাল, একটু যাচাই করা যাক। রাজ্যসভা নির্বাচনে শপথ নেওয়া এখনও একমাসও হয়নি। এই রাজ্য থেকে রাজ্যসভায় পাঁচজনকে পাঠাল তৃণমূল। নামগুলো অনেকের মনে আছে। তবু আরও একবার বলা যাক। ডেরেক ও ব্রায়েন, সুখেন্দুশেখর রায়, দোলা সেন, মানস ভুঁইয়া, শান্তা ছেত্রী। এঁদের একজনকেও আদি তৃণমূল বলা যায়?‌ একেকজনের প্রোফাইলে চোখ বোলানো যাক।

rajyasabha2

ডেরেক:‌ তিনি যে তৃণমূল করেন, ২০০৬ এর আগে কেউ জানতেন?‌ তৃণমূলের কোনও সভায়, কোনও অনুষ্ঠানে দেখা গিয়েছিল?‌ তিনি কেন তৃণমূলে এলেন?‌ বিধানসভায় রাজ্যপাল মনোনীত একজন অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সদস্য থাকেন। আগে ছিলেন ডেরেকের বাবা নীল ও ব্রায়েন। মাঝে ছিলেন গিলিয়ান রোজমেরি ডিকোস্ট্রা হার্ট। ২০০৬ এ কে হবেন, তাই নিয়ে দুই ভাই ডেরেক ও ব্রায়েন এবং ব্যারি ও ব্রায়েনের চাপানোতর শুরু হয়ে গেল। সেবার ব্যারি ও ব্রায়েনকেই মনোনীত করা হয়েছিল। সেই রাগে ডেরেক হয়ে গেলেন তৃণমূল। ইংরাজিটা ভাল বলতে পারেন, ফলে নেত্রীর বিশেষ স্নেহও পেলেন। রাজ্যসভাতেও পাঠিয়ে দেওয়া হল ২০১২তে। এবার দ্বিতীয়বার।

সুখেন্দুশেখর রায়: ছিলেন‌ কংগ্রেসের আইনজীবী নেতা। প্রণব মুখার্জির বিশেষ ঘনিষ্ঠ। কংগ্রেসের ইতিহাস নিয়ে বইও লিখেছেন। মমতা সরকারে আসার পরেও তিনি ছিলেন কংগ্রেস। সময়টা ২০১২। ইচ্ছে ছিল, রাজ্যসভায় যাবেন। সেবার কংগ্রেসের যা আসন, একজনকেই পাঠানো যাবে। কংগ্রেসের টিকিট পাওয়ার জন্য নানা জায়গায় নানা তদ্বির করলেন। সেই সময়ের কাগজ পড়লেই জানতে পারবেন। কংগ্রেস টিকিট দিল প্রদীর ভট্টাচার্যকে। সেই রাগে তিনি হাজির কালীঘাটে। ব্যাস, সেই বিকেলেই তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে তাঁর নাম ঘোষণা হয়ে গেল। সকালেও ছিলেন কংগ্রেসে। বিকেলে নাম ঘোষিত হল তৃণমূল প্রার্থী হিসেবে। তৎকাল তৃণমূলের আদর্শ উদাহরণ। কোনও সন্দেহ নেই, তিনি একজন যোগ্য সাংসদ। রাজ্যসভায় বাংলার যে কয়েকজন সাংসদ কিছুটা হলেও ছাপ ফেলতে পেরেছেন, তাঁদের মধ্যে সামনের সারিতেই থাকবেন সুখেন্দুশেখর। কিন্তু তৎকালের উদাহরণ খুঁজতে গেলে, তাঁর নামটা উঠে আসবেই।

দোলা সেন:‌ তৃণমূল ক্ষমতায় আসার আগে থেকেই তিনি তৃণমূলে। তবে খুব আগেও নয়। ২০০৬ এর আগে পর্যন্ত দোলা সেন যে তৃণমূল, কেউ জানতেন? একটু একটু করে নেত্রীর বিশ্বাসভাজন হলেন। ততদিনে নেত্রীর ছায়াসঙ্গীর ঠিকানা বদলে গেছে। সোনালী গুহর জায়গা নিয়ে ফেলেছেন এই শ্রমিক নেত্রী। আগের লোকসভায় টিকিট দেওয়া হয়েছিল। আসানসোলে হেরেছিলেন বাবুল সুপ্রিয়র কাছে। তার আগেই টোল প্লাজায় পুলিসকে চড় মেরে আরও বেশি করে স্বনামধন্য হয়েছেন। সারদা মামলায় সৃঞ্জয় বসু গ্রেপ্তার হয়েই আচমকা পদত্যাগ করলেন। সেই শূন্য আসনে দিল্লি যাওয়ার সুযোগ এসে যায় দোলার। নামটাই বদলে গেছে। দ এর বদলে কেউ কেউ ত উচ্চারণ করেন। আবার তিনি রাজ্যসভায় মনোনীত।

rajyasbha3

শান্তা ছেত্রী:‌ পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ পর্যন্ত তিনি কার্শিয়াংয়ের বিধায়ক ছিলেন। না, তৃণমূলের নয়, জিএনএলএফের। মমতা ক্ষমতায় আসার পর পাহাড়ে মোর্চার দাপট আরও বাড়ল। ক্রমশ কোণঠাসা শান্তা আশ্রয় নিলেন তৃণমূল শিবিরে। যদি হরকা বাহাদুর ছেত্রি মমতার কথা শুনে চলতেন, রাজ্যসভায় হয়ত তিনিই যেতেন। কিন্তু পুরভোটের আগে হরকার সঙ্গে দূরত্ব তৈরি হল। তখন মনে পড়ল শান্তা ছেত্রীর কথা। কলেজের লেকচারার, বেশ লড়াকু নেত্রী। রাজ্যসভায় যাওয়ার যোগ্য নেত্রী। কিন্তু তাঁকেও আদি তৃণমূল বলা যায় না।

মানস ভুঁইয়া:‌ আগের চারজন ততটা পরিচিত নন। তাই মনে করিয়ে দিতে হল। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে মনে করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। কারণ, গত একবছর ধরে নানা কারণে শিরোনামে সবংয়ের এই নেতা। বামেদের সমর্থনে জিতলেন কংগ্রেসের হয়ে। বিরোধী দলনেতা হতে পারলেন না। ভেতরে ভেতরে ফুঁসছিলেন। এবার পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি। এই সামান্য একটা পদের জন্য এমন লালায়িত হয়ে উঠলেন, দলের সঙ্গে বিরোধ তুঙ্গে উঠল। যে শিবিরে নৌকো ভেড়ার কথা, সেই শিবিরেই ভিড়ল। পুত্রসম অভিষেকের হাত থেকে পতাকা তুলে নিলেন। একদিকে কংগ্রেসের বিধায়ক, অন্যদিকে তৃণমূলের মুখপাত্র। দ্বৈতসত্ত্বায় চলল কিছুদিন। অবশেষে দ্বৈতসত্ত্বা থেকে নিষ্কৃতি। রাজ্যসভায় তাঁর নাম ঘোষণার অনেকদিন পর ছাড়লেন বিধায়ক পদ। অর্থাৎ, যখন নাম ঘোষণা হল, তখনও কং বিধায়ক। তাঁকে তো তৎকালও নয়, বরং প্রি–‌তৎকাল বলতে হয়।‌

তাহলে, মোদ্দা কথাটা কী দাঁড়াল?‌ রাজ্যসভায় যে পাঁচজন গেলেন, কেউ আদি তৃণমূল নন। দুজন এসেছেন ক্ষমতায় আসার আগে। তিনজন এসেছেন পরে। তার মধ্যে দুজনকে তো তৎকাল তৃণমূল বলাই যায়। প্রশ্ন হল, এই তৎকালদের রাজ্যসভার টিকিট কে দিল?‌ তৎকাল হলে বাড়তি গুরুত্ব, এই বার্তাটা কে দিয়েছেন?‌ নিচুতলার কর্মীদের না দুষে পার্থবাবু বরং আসল জায়গায় প্রশ্নটা করুন।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.