বিজেপি–‌ই একদিন নোটবন্দীকে ‘‌ঐতিহাসিক ভুল’‌ বলবে

সুগত রায়মজুমদার
‌‌২০১৬–‌১৭ সালের দেশে চরম দুর্ভোগের মধ্যে অন্যতম সেরা নোটবন্দী। গত বছরের ৮ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী সকলের অজ্ঞাতে আচমকা ঘোষণা করলেন, দেশে এতদিন যে ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের প্রচলন ছিল, তা আজ থেকে বাতিল বলে গণ্য করা হল। পরিবর্তে চালু হল ২০০০ টাকার নোট। কেন ২০০০ টাকার নোট!‌ কেন ৫০০ টাকা ও ১০০০ টাকা বাতিল?‌ বিজেপি–‌র উদ্দেশ্য ছিল একবারে অনেক টাকা নিজেদের দলের হস্তগত করা। আর বিরোধীদের অর্থশূন্য করে দিয়ে দুর্বল করে দেওয়া।
হঠাৎ এই ঘোষণায় বহু মানুষ দুর্ভোগের চরমে পৌঁছলেন। পরের দিন থেকেই ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে ভোরবেলা থেকে লাইন পড়ল সাধারণ মানুষের। টাকা তোলার সীমা এতই নগণ্য ছিল যে, মানুষ ক্রমাগত হতাশ ও নাজেহাল হতে লাগল। প্রত্যেক বাড়ির প্রবীণ মানুষরাও এই লাইনে দাঁড়াতে লাগলেন। এই চরম দুর্ভোগ চোখে যেত না। অনেক প্রবীণ মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে মারাও গেছেন। সেটা নিয়ে কেন্দ্রের সরকারের মাথাব্যথাও ছিল না। একবিংশ শতাব্দীতে এটাই সেরা চমক কেন্দ্রের। বহু ছোট ব্যবসায়ীরা নিজেদের ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হযেছেন। কত মানুষ নাজেহাল, তার কোনও হিসেব নেই। রিয়েলটি ব্যবসাগুলিও প্রচণ্ডভাবে মার খেয়েছে। কারও মেয়ের বিয়ে বা ছেলের বিয়েতে টাকাপয়সা জোগাড় করতে হিমশিম খেয়েছেন। রাজ্য সরকারগুলিও এই চমকে কাত হয়ে পড়েছিল। এখনও সেই রাজ্য সরকারগুলি এই নোটবন্দীর প্রভাব থেকে বের হতে পারেনি। বহু ব্যবসা রাজ্যগুলি থেকে উঠে গেছে। তৈরি হয়েছে কর্মসংস্থানের অভাব। রাজ্যের ছেলেরা তুলনামূলকভাবে ভাল অবস্থাপন্ন ভিন রাজ্যে চলে গেছে কর্মসংস্থানের খোঁজে। কম টাকা পেয়েও তারা বাইরের রাজ্যে চলে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার, উচ্চশিক্ষিতরাও ভিন রাজ্যে চলে গেছে চাকরির সন্ধানে।
দেশবাসীর মধ্যে প্রশ্ন উঠেছে, হঠাৎ কেন এই সিদ্ধান্ত। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করল, এই নোটবন্দীর প্রয়োজন ছিল অবধারিত। তাঁরা বলতে লাগলেন, তাঁদের মূল উদ্দেশ্য, জঙ্গিদের অর্থহীন করে দিতে হবে। এ ছাড়াও যে সব ব্যক্তির হাতে প্রচুর টাকা আছে, কিন্তু আয়কর হিসেব বহির্ভূত করে রেখেছেন, তাঁদের টাকা উদ্ধার করা। এই নোটবন্দী করে সরকার ১৫ লক্ষ কোটি টাকা দেশ থেকে তুলতে সক্ষম হয়েছে। তাঁদের মত অনুযায়ী প্রায় ৯৯ শতাংশ হিসেব বহির্ভূত টাকা উদ্ধার হয়েছে। ১ শতাংশ উদ্ধার করা যায়নি। সরকারের আর একটা উদ্দেশ্য ছিল, জাল টাকা অচল করা এবং আয়কর উদ্ধার করা। দেশের সিংহভাগ মানুষই প্রথমে এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন ঠিকই। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত নিতে গেলে আমাদের মতো গরিব দেশে কিছুটা স্বস্তি দেওয়া উচিত ছিল। আর বি আই স্বীকার করেছে, দেশে বর্তমানে আর্থিক বৃদ্ধির হার শোচনীয়। কবে এই ধাক্কা সামলে উঠতে পারবে, সেটা কেউ জানেন না।

note batil4
সারা দেশে মমতা ব্যানার্জিই এর বিরুদ্ধে সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়েছিলেন। এতে বিজেপি–‌র অনেক নেতাই মমতাকে কটূক্তি করেছেন। তাঁরা উক্তি করেছেন, মমতার সারদা ও নারদার টাকা মার খেতেই প্রতিবাদ। দেশে আর কোনও রাজনীতিবিদ তো সাহসই পাননি নরেন্দ্র মোদির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানোর। কারণ, দেশের বেশিরভাগ নেতার বিরুদ্ধে আর্থিক কেলেঙ্কারির দায় আছে। সেজন্যই তাঁরা এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছেন। কিন্তু মমতা জানেন, তাঁকে রাজ্যের মানুষের পাশে থেকেই কাজ করতে হবে। তা হলেই মানুষ তাঁকে ভোট দেবেন। সেজন্যই তিনি এই নোটবন্দীর প্রতিবাদ করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, সিদ্ধান্তটা ঠিক। কিন্তু এর প্রক্রিয়ায় ভুল আছে। সাধারণ মানুষই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই দুরবস্থা থেকে কবে মানুষ বেরিয়ে আসতে পারবেন, কেউ জানেন না।
দেশের কিছু বিশেষজ্ঞ এই নোটবন্দীর সিদ্ধান্তকে সমর্থন না করে রীতিমতো প্রতিবাদ করেছেন। অনেকে বলেছেন, এই নোটবন্দীর কারণ, সামনেই ছিল উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন। বিজেপি চেয়েছিল, নির্বাচন প্রাক্কালে নোটবন্দী করলে এবং হঠাৎ রহস্যজনকভাবে ২০০০ টাকার নোট ছাপিয়ে সেই টাকা নিজ দলের অন্দরে প্রচুর পরিমাণে তুলে নিয়ে বিরোধীদের প্রায় অর্থশূন্য করে দেওয়াই ছিল তাঁদের উদ্দেশ্য। ফলও হাতেনাতে পেয়েছে। বিজেপি এই তাস খেলে উত্তরপ্রদেশে বিরোধীশূন্য করে তুলতে পেরে নিজেদের অনেক বেশি শক্তিশালী করে তুলতে পেরেছে। যাতে আগামী নির্বাচনগুলিতে বিরোধীরা মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে। এই সিদ্ধান্ত তাঁদের দলের পক্ষে খুবই ভাল হয়েছে। কিন্তু বিজেপি–‌র কালো টাকা উদ্ধারের ব্যাপারটা অস্বচ্ছই থেকে গেল। আর দেশের মানুষ ক্রমশ আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়তে লাগল। এই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানো কবে সম্ভব হবে, তা কেন্দ্রের সরকারও জানাতে পারছে না। এ ছাড়াও মানুষের সঞ্চিত টাকার ওপরও কোপ মেরে সাধারণ মানুষকে অস্থিরতার মধ্যে রেখে গেছে। পেনশনার টাকার ওপরও কোপ মেরে চরম অন্যায় করেছে। যা কোনও দিন কোনও সরকার নেয়নি।

note batil2
নরেন্দ্র মোদি জানেন, সারা দেশে তাঁর সবচেয়ে বড় শক্তিশালী প্রতিপক্ষ মমতা ব্যানার্জি। তাঁকে উচ্ছেদের জন্যই দার্জিলিং সমস্যা তৈরি করা। বিজেপি নানাভাবে বাংলাকে অস্থির রেখে পরবর্তীকালে বাংলাকে দখল করে দেশের পূর্বাঞ্চলকে আয়ত্তে আনতে চায়। সেজন্যই বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমারকে নিজেদের দিকে নিয়ে গেছে।
তবে মমতা ৩৪ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে যেভাবে বাংলাকে উন্নয়নের পথে ফিরিয়েছেন, তাতে সাধারণ মানুষ ব্যাপকভাবে মমতার পক্ষেই থাকবেন। বিরোধীরা সত্যিই দিশাহীন। মানুষের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা দিন দিন কমছে। বিজেপি–‌র পক্ষে কখনও বাংলাকে ভাগ করা বা বাংলাকে দখল করা সম্ভব নয়। জঙ্গলমহলের মতো দার্জিলিংয়ের সমস্যাও মমতা ব্যানার্জি খুব শীঘ্রই নিজেদের আয়ত্তে আনতে পারবেন, এটাই সকলের বিশ্বাস। নোটবন্দী প্রথমে মানুষ অনুমান করতে না পারলেও, এখন মানুষ বুঝছেন, তাঁরা কতখানি পিছিয়ে পড়েছেন আর্থিকভাবে। পরবর্তীকালে এটাই বিজেপি–‌র ঐতিহাসিক ভুল বলে প্রমাণিত হবে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.