একটি আদর্শ স্কুলের কাহিনী

দিব্যেন্দু দে

প্রত্যন্ত গ্রামের একটি স্কুল। খুব উঁচু সম্প্রদায়ের ছেলেরা পড়ে, এমনও নয়। তথাকথিত ইংলিশ মিডিয়াম নয়। একেবারে পাতি বাংলা মিডিয়াম। কিন্তু সেই স্কুল টেক্কা দিতে পারে একটি কলেজ, এমনকী বিশ্ববিদ্যালয়কেও। তেমনই একটি স্কুল দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন ব্লকের চেঁচাই প্রাথমিক বিদ্যালয়। একেবারে শূন্য থেকে শুরু করে এ যেন সাফল্যের আকাশ ছোঁয়ার গল্প।
কয়েক বছর আগেও আর দশটা স্কুলের সঙ্গে এই স্কুলের কোনও তফাত ছিল না। একটু একটু করে তফাতটা বাড়তে লাগল। আজ যে কোনও স্কুল এই স্কুলকে দেখে ঈর্ষা করতেই পারে। যত মডেল স্কুলই হোক, এই স্কুলের কাছে দশ গোল খাবে। এই সাড়া জাগানো পরিবর্তনটা যাঁর জন্য সম্ভব হয়েছে, তিনি প্রধান শিক্ষক পবিত্র মোহন্ত। শিক্ষক দিবসে সেই উদ্যমী মানুষটিকেই জাতীয় শিক্ষকের স্বীকৃতি তুলে দিতে চলেছেন দেশের রাষ্ট্রপতি। সাফল্যের একটা বৃত্ত যেন পূর্ণ হল।
প্রতিবছরই বেশ কিছু শিক্ষক ‘‌জাতীয় শিক্ষক’‌ এর মর্যাদা পেয়ে থাকেন। পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখেও কিছু প্রশ্ন, কিছু সংশয় থেকেই যায়। মনে হয়, এই বাছাইয়ের পেছনে অন্য কোনও সমীকরণ নেই তো?‌ চেঁচাই স্কুলে যদি একবার যান, তাহলে অন্তত এমন কোনও প্রশ্ন, এমন কোনও সংশয় আপনার মনে আসবে না। এককথায় একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ স্কুল। যা আসলে গ্রামটাকেই আমূল বদলে দিয়েছে।
কয়েকটি কর্মকান্ডের কথা বলা যাক।। ১)‌ প্রাইমারি স্কুলে লাইব্রেরি। সেখানে পর্যাপ্ত বই। ২)‌ শুধু বইয়ে ঠাসা লাইব্রেরি নয়, আছে ডিজিটাল লাইব্রেরিও। অনলাইনেও পড়াশোনা করতে পারে প্রত্যন্ত গ্রামের ছেলেরা। ৩)‌ একেবারে অত্যাধুনিক স্কুল বিল্ডিং। ৪)‌ বাইরে বাউন্ডারি ওয়াল। ৫)‌ নিজেদের খেলার মাঠ। ৬)‌ সাজানো বাগান। ৭)‌ চিলড্রেন্স পার্ক। ৮)‌ স্কুলের নিজস্ব ক্যান্টিন, যা ছেলেরাই চালায়। ৯)‌ ক্লাস ওয়ান থেকেই কম্পিউটার শেখার ব্যবস্থা, আলাদা কম্পিউটার রুম ১০)‌ টিভি, ফ্রিজ, গিজার, মিক্সি, ওভেন। ১১)‌ নিজস্ব কমিউনিটি হল, যা গ্রামের মানুষও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে পারে। ১২)‌ বিশাল এলাকা জুড়ে সবজির ক্ষেত, গ্রামের মানুষেরা চাষ করেন, বিক্রি নিয়েও ভাবতে হয় না। কারণ, মিড ডে মিলের সবজি সেখান থেকেই নেওয়া হয়। ১৩)‌ ছোট থেকেই ইংরাজি শেখার ব্যবস্থা। ১৪)‌ নিয়মিত স্বাস্থ্যপরীক্ষা। ১৫)‌ কলকাতা থেকে প্রশিক্ষক এনে নাচ, গান, আবৃত্তি, হাতের কাজ শেখানোর ব্যবস্থা। ১৬)‌ ডিজিটাল পদ্ধতিতে পড়ানোর ব্যবস্থা।

school
কতকিছু যে বাদ থেকে গেল!‌ তালিকাটা ক্রমশ বাড়তেই থাকবে। ফুরোতেই চাইবে না। আপনার চেনা–‌জানা কোনও স্কুলে এইসব পরিকাঠামো আছে?‌ উত্তরবঙ্গের পিছিয়ে পড়া এক গ্রামের একটি অতি সাধারণ স্কুল। শুধুমাত্র নিজেদের চেষ্টায় আর অদম্য ইচ্ছাশক্তিতে অন্যদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছে। রাজ্য পর্যায়ের নানা স্বীকৃতি এসেছে আগেই। চারদিন আগে দেশের সেরা স্কুলগুলির তালিকায় উঠে এসেছে এই স্কুল। উত্তরবঙ্গ থেকে এই একটি স্কুলকেই বেছে নেওয়া হয়েছে। দূরদূরান্তের শিক্ষকরাও পরম বিস্ময়ে একটিবার দেখে যান এই স্কুলকে। বুঝতে চান, কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াল এই স্কুল।
কীভাবে সম্ভব হয়েছে?‌ সাফল্যের সেই রহস্য না হয় তোলা থাক। হাজার চেষ্টা করলেও বোধ হয় এতখানি সম্ভব নয়। তবে সৎ চেষ্টা আর কঠোর পরিশ্রম থাকলে এর কিছুটা তো হয়। যাঁরা জাতীয় শিক্ষকের পুরস্কার নেবেন, তাঁরা দিল্লি থেকে ফিরে একবার অন্তত ঘুরে আসুন প্রত্যন্ত গ্রামের এই স্কুলটি থেকে। গর্ব করে বলতে পারবেন, এই স্কুলের শিক্ষকের পাশে দাঁড়িয়ে আমি পুরস্কার নিয়েছি। শিক্ষামন্ত্রীও বরং একবার ঘুরে আসুন। দেখে আসুন, একক চেষ্টায় একটা প্রতিষ্ঠানকে কীভাবে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়! উত্তরবঙ্গ মানে কি শুধু দার্জিলিং আর ডুয়ার্স?‌ এমন একটি স্কুল যদি পর্যটকদের গন্তব্য হয়, মন্দ কী?‌

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.