স্বরূপ গোস্বামী
মৃত্যুর পর ভাল ভাল কথা বলাটাই রেওয়াজ। সারাজীবন যাঁদের জীবনে নানা বিতর্ক, নানা দুর্নীতি, নানা সমালোচনা, শেষবেলায় তাঁদের ওপরেও কেমন একটা দেবত্ব আরোপ হয়ে যায়। চরম অভদ্র মানুষটিকেও বলা হয়, অত্যন্ত বড় মাপের মানুষ ছিলেন। এমনকী চরম বিরোধীরাও প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। মহত্বের কত কাল্পনিক গল্প ছড়িয়ে পড়ে। সারাদিন ধরে টিভিতে কতরকমের স্মৃতিচারণ। কাগজের পাতাজুড়ে তাঁদের নামে কত প্রশস্তি।
অথচ, এইসব শ্রদ্ধা যাঁর সবথেকে বেশি পাওয়ার কথা ছিল, তাঁর ক্ষেত্রে আমরা কত কৃপণ থেকে গেলাম। প্রায় নীরবেই চলে গেলেন জ্ঞান সিং সোহনপাল। বাংলা রাজনীতির সবচেয়ে শ্রদ্ধেয় মানুষটি। নামটা যতটা পরিচিত, ‘চাচা’ ডাকনামটা বোধ হয় তার থেকেও বেশি পরিচিত। কোনও বাংলা কাগজেই প্রথম পাতায় তাঁকে নিয়ে প্রতিবেদন নেই। ছোট্ট একটি ঘোষণা। ভেতরের পাতায় নাম কে ওয়াস্তে প্রতিবেদন (তিনটি কাগজে আলাদা স্মৃতিচারণ)। আসলে, চারিদিকে অভদ্রতা, অসৌজন্যের এত বেশি ছড়াছড়ি, ভদ্রতা ও সৌজন্য ক্রমশ কোণঠাসা। তিনিই সম্ভবত বাংলার রাজনীতির একমাত্র চরিত্র, জীবদ্দশায় যাঁর সম্পর্কে একটি খারাপ কথাও কারও মুখ থেকে বেরিয়ে আসেনি।
জীবনের বেশিরভাগ সময়টাই কেটেছে বিরোধী বেঞ্চে। কিন্তু কখনও ওয়েলে নেমে চিৎকার করতে দেখেছেন? টেবিলে উঠে নৃত্য করতে দেখেছেন? মাইক ভাঙতে দেখেছেন? কাগজ ছিঁড়ে উড়িয়ে দিতে দেখেছেন? বিধানসভার চেয়ার–টেবিল ভাঙচুর করতে দেখেছেন? বিরোধিতা করতে গিয়ে কখনও নিম্নরুচির আক্রমণ করতে দেখেছেন? মুখ্যমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীদের নামে কুরুচিকর মন্তব্য করতে দেখেছেন?
না, জ্ঞান সিং সোহনপালকে এসব কোনওকিছুই করতে দেখা যায়নি। তবু বাম জমানাতেও নিজের এলাকা থেকে দিব্যি জিতে এসেছেন। আগের দু’দফায় মন্ত্রিত্ব তো আছেই। ৮২ থেকে ২০১৬ টানা কেটেছে বিধানসভায়। কোনওদিন কোনও বিতর্কের জন্য শিরোনাম হয়ে ওঠেননি। সারাজীবন সাদা পোশার পরা মানুষটি চিরকাল সাদা মানুষই থেকে গেছেন। গায়ে কখনও কলঙ্কের কালি লাগতে দেননি।
একসময় তাঁকে মমতা শিবিরেই দেখা যেত। পরের দিকে কেন আর দেখা যায়নি, সেটা এই আচরণগুলো থেকেই পরিষ্কার। মমতার দলে এগুলো সত্যিই বেমানান। জোহুজুর হয়ে শাসকপক্ষে থাকা বোধ হয় তাঁর পক্ষে সম্ভবও ছিল না। আজ তাঁর মৃতদেহ বিধানসভায় আনা হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় বিদায়ের ঘোষণা হয়েছে। কিন্তু বছর দুই আগেই কী চরম হেনস্থাই না হতে হয়েছে শাসকদের হাতে! খড়্গপুর পুরসভায় কংগ্রেসের জয়ের পরেও বোর্ডগঠন করা যায়নি। কীভাবে গায়ের জোরে পুরসভা দখল হয়েছে, শেষজীবনে নিজের চোখেই দেখে গেলেন। সম্ভবত, সেটাই তাঁর জীবনের সবচেয়ে যন্ত্রণাদায়ক অধ্যায়। ওই ভগ্ন শরীর নিয়ে বারবার ছুটে যেতে হয়েছে পুলিশের কাছে। কিন্তু সেখানেও উপেক্ষা ছাড়া কিছুই জোটেনি। সারাজীবন যে মানুষটা সমস্ত দলের কাছে শ্রদ্ধা পেয়ে এসেছেন, তাঁকে শেষ বয়সে এসে কী চরম হেনস্থার মুখেই না পড়তে হয়েছে।
থাক এসব কথা। সারাটা জীবন ধরে এই অকৃতদার মানুষটি দেখিয়ে গেলেন, মূল্যবোধ নিয়ে কীভাবে রাজনীতি করতে হয়। অন্যকে অশ্রদ্ধা না করেও অন্যের সমালোচনা না করেও কীভাবে সারাটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যায়। রাজনীতি মানেই আমি ভাল, অন্যরা খারাপ। এটাই সব দলের মূলমন্ত্র। কেউই এর ব্যতিক্রম নন। স্বাধীনোত্তর বাংলায় তাঁর মতো আর ব্যতিক্রম কেউ আছেন বলে মনে পড়ছে না। বিধানসভায় বলতে গিয়ে অনেকেই তাকিয়ে থাকেন প্রেস গ্যালারির দিকে। তাঁকে কখনও প্রেস গ্যালারির দিকে তাকিয়ে কথা বলতে দেখিনি। কখনও শস্তা মন্তব্য করে শিরোনাম হয়ে ওঠার চেষ্টাও করেননি। পরিষদীয় শিষ্টাচার কাকে বলে, এই মানুষটিকে দেখেই শিখতে হয়। দারুণ বক্তা ছিলেন, এমন নয়। বড় বড় বিষয়গুলি তুলে এনে বাজার গরম করা নয়, বরং এলাকার ছোট ছোট সমস্যা তুলে ধরতেন, মন্ত্রীদের সঙ্গে আলাদা করে কথা বলে সমাধান করার চেষ্টা করতেন। যখনই কোনও আইনি সমস্যা, হাসিম আব্দুল হালিমের মতো তুখোড় স্পিকারও একজনের ওপরই সবথেকে বেশি ভরসা করতেন। আর তিনিও দাঁড়িয়ে সমাধানের রাস্তা বাতলে দিতেন। তখন কংগ্রেসের সদস্য মনে হত না, দলের ঊর্ধ্বে উঠে কথা বলতেন। মনে হত, যথার্থই অভিভাবক।
সভায় ঢোকার সময় দরজা থেকেই মাথা নত করতেন। নিজের চেয়ারে বসার আগে স্পিকারের চেয়ারকে সম্মান জানিয়ে আরও একবার মাথা নত করতেন। একটি দিনও এই সৌজন্যের ব্যতিক্রম হতে দেখিনি। বলতেন, ‘সবসময় অন্যকে ছোট করা, হেয় করা বিরোধীর কাজ নয়। সব ইস্যুতেই যদি বিরোধিতা করেন, তখন বিরোধিতাটাও লঘু হয়ে যায়। তখন সঠিক বিরোধিতাটাও মূল্যহীন হয়ে পড়ে। তাছাড়া, অন্যকে সমালোচনা করে নিজে বড় হওয়া যায় না। নিজের কাজটা মন দিয়ে করা উচিত। সমালোচনা করলে, আগে নিজের সমালোচনা করা উচিত।’
এসব কথা বলার আর কেউ রইল না। এসব কথা মেনে চলারও আর কেউ রইল না। বাংলা রাজনীতির সবথেকে ভদ্র মানুষটি চলে গেলেন। বিধানসভায় সব দলের কাছ থেকে এমন শ্রদ্ধা আর কেউ পেয়েছেন কিনা জানা নেই। স্পিকার সাহেবের কাছে অনুরোধ, প্রতি বছর সেরা বিধায়ককে জ্ঞান সিং সোহনপালের নামাঙ্কিত পুরস্কার দেওয়া হোক।।