ঠিক প্রথাগত ফিল্ম রিভিউ নয়। শঙ্কুদেব পন্ডার ছবি কমরেড দেখে কতগুলি প্রশ্ন, কিছু নিজস্ব অনুভূতি। মেলে ধরলেন অভিরূপ কুমার।।
দু’সপ্তাহ পেরিয়ে গেল। ছবিটা কিছুতে দেখাই হচ্ছিল না। মুক্তির অনেক আগে থেকেই পোস্টারে শহর ছেয়ে গিয়েছিল। শঙ্কুদেব পন্ডা সম্পর্কে কোনওকালেই আমার তেমন ভাল ধারনা ছিল না। শঙ্কুদেব ছবি বানালে সেটা কেমন হবে, মোটামুটি একটা আন্দাজ ছিল। তবু ঠিক করেছিলাম, ছবিটা দেখব। বাংলার একটা অশান্ত সময়কে কীভাবে পর্দায় ফুটিয়ে তোলেন, দেখার আগ্রহ অবশ্যই ছিল। কিন্তু নানা কারণে হয়ে উঠছিল না। অবশেষে সময় ও সুযোগটা এসে গেল, নন্দনে।
শুরুতেই বলে রাখি, ছবি না হলে একে আস্ত গাঁজাখুরি বলাই ভাল। খুব ভাল মানের হবে না, জানাই ছিল। তাই বলে এত মিথ্যের বেসাতি আছে, তা ভাবা যায়নি। সন্দেহ ছিল, হয়ত শঙ্কুর নাম আছে, কিন্তু অন্য কেউ চিত্রনাট্য লিখেছেন। কিন্তু ছবিটা দেখার পর মনে হল, এই চিত্রনাট্যে তাঁর ভূমিকাও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। গোটা ছবি জুড়েই গালাগালের ফোয়ারা। দু–অক্ষর, চার অক্ষর তো আছেই, আরও কয়েকধাপ এগিয়ে। সেন্সর বোর্ড নামক বস্তুটি এক্ষেত্রে বড়ই অসহায়।
ছবির বিষয় কী? সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রামে সরকার জোর করে জমি নিতে চাইছে। তার বিরুদ্ধে জনতার প্রতিরোধ। এমন বিষয় নিয়ে কোনও পরিচালক চাইলে ছবি বানাতেই পারেন। সিপিএম–কে সমালোচনাও করতে পারেন। এটুকু অধিকার নিশ্চয় একজন পরিচালকের থাকা উচিত। তাই বলে প্রতি পদক্ষেপে এমন মিথ্যের বেসাতি! ধর্ষণ, খুন যেন মুড়িমুড়কির মতো ব্যাপার। সিঙ্গুর আর নন্দীগ্রাম নাম দুটো নিঃসন্দেহে চমকদার। কিন্তু দুটো ভিন্ন জেলায়। কিন্তু শঙ্কুবাবু এপাড়া–ওপাড়া বানিয়ে ফেলেছেন। একই দল এখানেও হুমকি দিচ্ছে, ধর্ষণ করছে। সন্ধেবেলায় সেই দলই নন্দীগ্রামেও। কোনও নারী ধর্ষিতা হচ্ছেন নন্দীগ্রামে, দেখা যাচ্ছে, তাঁকে আনা হয়েছে সিঙ্গুর হাসপাতালে। গুন্ডারা না হয় এক হতেও পারে, তাই বলে পুলিশেরাও এক! তপন–সুকুর নাম দুটোর সঙ্গে অনেকেই পরিচিত। তাদেরই আদলে তৈরি চরিত্র স্বপন–সুকুমার। যতদূর জানি, তারা পশ্চিম মেদিনীপুরের। ধরেই নিলাম নন্দীগ্রাম অপারেশনে তারা ছিল। তাই বলে সিঙ্গুরেও তপন, সুকুর? গল্পের গরু গাছের কোন মগডালে উঠেছে, কে জানে!
সিঙ্গুরে মাস্টারমশাইয়ের আদলে একটি চরিত্র। ধরেই নেওয়া যাক, তিনি রবীন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। দেখা যাচ্ছে, তাঁর ছেলেকে খুন করা হল। পরিচালক ভুলেই গেছেন, সিঙ্গুর আন্দোলনের সময় তিনি মোটেই অসহায় মাস্টারমশাই ছিলেন না, তিনি সেখানকার বিধায়ক ছিলেন। তাও প্রথমবারের নয়, দ্বিতীয়বারের। তখন সিঙ্গুরে সিপিএম নয়, দাপট যদি কারও থাকে, তা তৃণমূলেরই। সিপিএমের পক্ষে সেই সময় সিঙ্গুর বা নন্দীগ্রাম কোথাও মদ–মোচ্ছব বা আইটেম গার্ল এনে নাচন–কোঁদনের মতো পরিস্থিতি ছিল না।
পলিটব্যুরো যেন পাড়ার ক্লাব, সকালে বিকেলে সেখানে মিটিং হচ্ছে। আর সেখানে সবাই বাংলারই লোক। কারাত–ইয়েচুরি বলে কিছুই নেই। পলিটব্যুরো মিটিংয়ে টাটা আসছে। টাকা পয়সার ভাগাভাগি হচ্ছে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য সরাসরি ঘুষ চাইছেন। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য গুন্ডাদের ফোন করে লাশ ফেলে দিতে বলছেন। গৌতম পলিটব্যুরো মিটিংয়ে টাকা গুনছেন। একজন একটু প্রতিবাদী, সোমনাথ। নামগুলো লক্ষ করুন। ধরে নেওয়া যায়, একজন গৌতম দেব, অন্যজন সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়। হায়! তাঁরা কেউই তো পলিটব্যুরো মেম্বার নন। ছবিতে বারবার এসেছে ‘৩৪ বছর’ শব্দ দুটো। সিঙ্গুরে আন্দোলন হচ্ছে ২০০৭–০৮ নাগাদ। ২০১১ তে বললে ৩৪ বছর মানা যায়। তাই বলে ২০০৭–০৮ এও ৩৪ বছর? পরিচালক অঙ্কে এত কাঁচা? দেখা যাচ্ছে, প্রায় সবার হাতেই স্মার্ট ফোন। একটু পিছিয়ে যান। ২০০৭–০৮ এ গ্রাম বাংলায় হাতে হাতে স্মার্টফোন, ছবিটা বিশ্বাসযোগ্য?
অনেক ছবির শুরুতে লেখা থাকে, ছবির সমস্ত চরিত্র কাল্পনিক। যদি তেমন কিছু থাকত, তাহলে বলার কিছু ছিল না। কল্পনা হিসেবেই না হয় ধরে নেওয়া যেত। কিন্তু এখানে শুরুতেই বলা হয়েছে, সত্য ঘটনা অবলম্বনে। তারপর এই সব গাঁজাখুরি। ভাল কি কিছুই নেই? হ্যাঁ, আছে। নচিকেতার একটি গান সত্যিই অসাধারণ। খরাজ মুখার্জি, ইন্দ্রাশিসসহ কয়েকজনের অভিনয় কিছুটা হলেও লজ্জার হাত থেকে বাঁচিয়েছে। প্রথম ছবি, সৎ প্রচেষ্টা থাকলে ছোটখাটো ত্রুটিকে উপেক্ষা করাই যায়। কিন্তু এখানে ভিত্তিটাই হল লাগাতার মিথ্যাচার।
এই ছবি নাকি বিদেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় দেখাতে চাইছে। বাংলার বিভিন্ন মিডিয়ায় শঙ্কুবাবু এমন খবর খাইয়েছিলেন। খোদ বিধানসভা স্পিকারের কাছে চলে গিয়েছিলেন, বিধায়কদের এই ছবি দেখাবেন বলে। এই ছবি নাকি সারা বিশ্বে দারুণ সাড়া ফেলেছে। নন্দনে হল পেতেও তাই সমস্যা হয়নি। দেখা গেল, সর্বসাকূল্যে ১৯ জন। তাও আবার ছুটির দিনে, দুপুরে নয়, একেবারে সন্ধেবেলায়, প্রাইম টাইমে। এমন ছবি নন্দনে? কারা চালাচ্ছেন নন্দন? এমন ছবি সেন্সর ছাড়পত্র পেয়ে গেল? কারা বসে আছেন সেন্সরের মাথায়? একা শঙ্কু নয়, আরও অনেককে নিয়েই প্রশ্ন তুলতে হয়। শঙ্কু নিজেকে চেনালেন, এঁদেরও চিনিয়ে দিয়ে গেলেন। বাংলা ছবিতে অন্তত এটুকু অবদান শঙ্কুদেব পন্ডার থেকেই গেল।