অযোধ্যা পাহাড় এবং আমরা তিনজন

দেবাশিস হালদার

অনেক অনেক দিন ধরে হাতছানি দিয়ে ডাকছিল অযোধ্যা। সে ডাকে সাড়া না দিয়ে আর পারলাম না। বর্ষার আগমনে পাহাড় সুন্দরীর সৌন্দর্য উপভোগে বেরিয়ে পড়লাম ব‌উ আর চারবছরের ছেলেকে বগলে দেবে। প্রথমেই বলে রাখি হিল টপে ওঠার যে চারটে রাস্তা রয়েছে তারমধ্যে বাঘমুন্ডি ও শিরকাবাদ হয়ে ওঠার রাস্তাদুটি সহজতর। না এদুটি পথকে মাড়িয়ে আপার ডেম বা বামনি ফলসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে যেতে পারিনি। যাত্রা শুরু করেছিলাম নির্মিয়মাণ খামার-অযোধ্যার বিপদসঙ্কুল রাস্তা ধরে। হ্যাঁ, বলতে পারেন রিস্কটা একটু বেশিই নিয়ে ফেলেছিলাম। বর্তমান আর ভবিষ্যতকে সামনে পিছনে বসিয়ে। মনের মধ্যে অ্যাডভেঞ্চারটা তখন টগবগ টগবগ। তাই ও বিপদের দিকটা তখন পাহাড়ের নীলাকাশে চরতে গেছে বলেই ছেড়ে দিয়েছি। সে যাই হোক, কারণটা আর কিছুই নয়, যাত্রাটা শুরু করেছিলাম ঝালদা থেকে। এপথেই আমার স্কুল। ব‌উ ছেলেকে আমার কর্মভূমি দর্শন করিয়ে বেলা বারোটার সময় আমার ছয় বছরের পুরানো এন.এক্স.জি স্পেলন্ডরে স্টার্ট দিই তেইশ কি.মি দূরের অযোধ্যা সুন্দরীর উদ্দেশ্যে।

ajodhya3
সামনে ছেলে পিছনে ব‌উ। মাঝে আমি হ্যান্ডেল ধরে পাহাড়ের এক একটা বাঁক সমেত চড়াই তুলছি ফার্স্ট গিয়ারে। গোটা গাড়িটা কেঁপে উঠছে। চার বছরের ছেলে বলছে, বাবা,আমার গা টা কেমন করছে, শহুরে ব‌উ পেছন থেকে- এ তুমি কোথায় আনলে? মেরে ফেলবে নাকি? এরপর সহ্য করতে না পেরে চোখ বুজে মহামন্ত্র আওড়াতে থাকে, মহাদেব: মহাত্রান:…ইত্যাদি ইত্যাদি। ইতিমধ্যে চড়াই শেষ করে ইউ টার্ন নিচ্ছে। দুই দিকে গভীর ঢাল। অকস্মাৎ সামনে একটা ডাম্পার। হাত সাতেক দূরে। ক্যাঁএএএএ ক্যাঁচ। মহাদেবের রক্ষামন্ত্র কাজ করেছে বোঝা গেল। ব‌উ বোধয় চোখ বুজেই ছিল। না হলে কি হত আর ভাবতে পারছি না। সলিল সমাধি, না না সপরিবারে পাহাড় সমাধি। ওটা এত তাড়াতাড়ি চিত্রগুপ্ত লেখেনি বোঝা গেল। আর লিখলেও মহাদেবের বরাভয় এ যাত্রা অযোধ্যায় নিয়ে ফেলবে বলেই বাঁচিয়ে দিল। এমন গোটা চারেক বাঁক সমন্বিত চড়াই উতরাই পেরিয়ে পৌঁছলাম জিলিং সেরেং প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে। জিলিং সেরেং পাহাড়ি ছোট সাঁওতালি গ্রাম। বছর তিনেক আগে এই গ্রাম ও প্রাথমিক বিদ্যালয়টি দেখে গিয়েছিলাম। কথা বলেছিলাম স্কুলের শিক্ষক আদিত্যবাবুর সঙ্গে, গ্রামের মানুষদের সঙ্গে। সে এক অন্য অভিজ্ঞতা। সেদিন‌ই এই অভিজ্ঞতা ফেসবুকে পোস্ট করে বন্ধুদের সঙ্গে ভাগ করে নিয়েছিলাম। পরে এই জিলিংসেরেঙকে পটভূমি করে ‘রাবণ’ নামে একটা গল্প‌ও লিখেছিলাম। সে অন্য কথা। আজ তিনবছর পর জিলিং সেরেঙ এর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেখলাম প্রকৃতি তার অপার সৌন্দর্য নিয়েই দাঁড়িয়ে আছে। তবে সে সময়টা ছিল হেমন্ত এখন বর্ষার প্রাক্ মুহূর্ত। তাই পাহাড় গুলো যেন আরও বেশি সবুজ, আরও বেশি মোহময়ী। একবার আঁখি পাখি যেদিকে উড়ে যায়,শুধু উড়েই যায়। ফেরার ইচ্ছেটা যেন বন্ধক দিয়ে রেখেছে ওই পাহাড়, গিরিখাত, শ্যামল বনানীর কাছে। ব‌উয়ের ভয়মিশ্রিত তাড়ায় সেটা বেশিক্ষণ স্থায়ী হয়নি যদিও। উন্নয়নের কথা বলতে গেলে পাশ দিয়ে পি.সি.সি ঢালাই এর রাস্তা ছাড়া এ তিন বছরে বড় কিছু চোখে পড়ল না। স্কুল বিল্ডিং এর তথৈবচ। জিলিং সেরেঙ আছে জিলিং সেরেঙ‌ই। সে যাই হোক প্রকৃতির রূপ দেখতে বেরিয়েছি সমাজ বিজ্ঞানী না হলেও চলে। আবার বাইকে স্টার্ট দিলাম। ব‌উয়ের বাড়ি ফিরে চলো, বাড়ি ফিরে চলো কে অগ্রাহ্য করেই। পায়ের মধ্যে সর্ষেটা তখন পিছলে পিছলে গড়িয়ে যাচ্ছে। গিন্নিকে বল্লাম, এতদূর এসে স্বর্গ দর্শনে অতৃপ্ত থাকবে। বাড়ি গিয়ে মনস্তাপে পুড়ে মরবে। যাই বাহান্ন তাই তেপ্পান্ন। দিলাম গাড়িকে পাহাড়ের বুক চিরে এগিয়ে যেতে।
এখান থেকে রাস্তার চড়াই উতরাইটা অনেকটা কমে এসেছে। ইউ টার্ন বাঁকগুলোও। ছেলে আনন্দে মাথা দোলাতে শুরু করেছে। আর আমার কাছে একের পর এক প্রশ্ন। বাবা, এত পাহাড় কেন? আমরা কোথায় যাচ্ছি? এদের বাড়িগুলো (খাপরার বাড়িগুলো দেখে) এমন কেন? রাস্তায় কোনও দোকান নেই কেন? একটাও লোক দেখছি না কেন? ইত্যাদি ইত্যাদি। তার প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে দিতে আমি নাজেহাল। বেলা তখন একটার দিকে। জিলিং সেরেঙ থেকে আটদশ কিমি পার করেও কোনও জনবসতি চোখে পড়েনি। রাস্তাও শুনশান, জনমানবহীন। থেকে থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার আওয়াজ আর এক দুটো নাম না জানা পাখির ডাক ছাড়া সারা বন-পাহাড় নীরব। ব‌উ ভীত কণ্ঠে জানতে চাইল, কী গো। কোনও হিংস্র জন্তু নেই তো? আমি সাহসের সঙ্গে হাসি বের করে বল্লাম, ধূরর্! বুনো হাতি আর বনবরা ছাড়া কিছুই নেই এখানে। তাও সহজে কি তেনাদের দেখা পাবে? ব‌উ রাগত ভঙ্গীতে বলে, এমন করে বলছ যেন ওদের দেখার জন্যই বেরিয়েছো। কী বীরপুরুষ আমার! সঙ্গে বাচ্চাটা আছে সে কথা খেয়াল আছে তো?
আমি বলি, আমার কথাতেই ওনারা বেরিয়ে এসে পথ আটকে বলবে না তো দিন দুই আতিথ্য নিয়ে যান মশাই আমাদের ডেরায়, সপরিবারে। টিকিটটা বহু কষ্ট করে কেটে রেখছি। ব‌উ আমার রসিকতায় মন না দিয়ে বলে, বলি যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। আর কতদূর?
আমি আর কোনও প্রশ্নের জবাব দেওয়ার উচিত মনে করি না। যত্ন করে গাড়িটা চালিয়ে যাই।
কিছুদূর আসার পর জঙ্গল শেষ হয়। অনেকটা সমতলের মধ্যে এসে গেছি মনে হচ্ছে। দূরে কয়েকটা ছোট ছোট দোচালার বাড়ি দেখা যায়। এতক্ষণে ব‌উ অঢেল অক্সিজেন ভরা বাতাসেও গভীর নি:শ্বাস ছাড়ে। যা:বাব্বা!এতখনে একটা গায়ের দেখা মিলেছে। পথ চলতি দু’একটা মেয়ে পুরুষকে দেখি। তাদের কার‌ও মাথায় লম্বা কাঠের বোঝা, আবার কোনও পুরুষ সাইকেলের পিছনে বেঁধে কাঠ নিয়ে চলেছে বাড়ি মুখে। এটাই এখানকার মানুষের প্রধান জীবিকা।
‌গ্রামটার কাছে আসতেই রাস্তার ধারে একটা আমতলায় গাড়িটাকে দাঁড় করালাম। সূর্য তখন মধ্যগগন থেকে খানিকটা ঢলে পড়েছে। রোদের দাপট খুবই। নেমে সকলে জলপান করছি। বউ সামনের একটা খাপরার মাটির বাড়ি লক্ষ্য করে বলল, বাড়ির ভেতরটা একটু দেখে আসব? আমি কিছু বলার আগেই ওদের বাড়ির দুয়োরে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতরে উঁকি মারতে লাগল। একটা বছর সাত আটেকের বাচ্চা দাওয়াই আপনমনে খেলছে খালি গায়ে। ভেতরে ওর মা একটা ছোট বাচ্চাকে পিটছে নিজেদের ভাষায় বকতে বকতে। বউ ছেলেটাকে জিজ্ঞেস করে, কী রে স্কুলে যাস? (দিদিমণি তো, সবছেলেরাই ওর কাছে ছাত্র)ছেলেটা কী বুঝল কী জানি, শুধু বউয়ের মুখেরদিকে ড্যাব ড্যাব করে চেয়ে আছে দেখলাম। সে চোখের ভাষা পড়ার শক্তি দেখলাম বউয়ের নেই। ডেকে নিলাম ওকে। চলো ফিরতে দেরি হয়ে যাবে। এমন সময় ঘরটার পিছনের দুয়ার দিয়ে সেই মা ক্রন্দনরত বাচ্চাটিকে নিয়ে আপন মনে বেরিয়ে এল। আমাদের সঙ্গে কোনও কথা বলারও ইচ্ছে প্রকাশ করল না। দেখি পাশের বাড়ি থেকে এক বছর পঞ্চাশের পুরুষকে বেরিয়ে আসতে। খালি গা। একটা ময়লা ধুতিকে লুঙ্গির মতো করে পরা। পা দুটো টলমল, চোখগুলো রাঙা, গোল গোল। আমার ছেলেটা তাঁকে দেখেই তখন গাড়িতে উঠে বসেছে। বাবা, চলো, চলো।
‌কড়া রোদটাকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে গাড়ি নিজের গতি ধরল। অযোধ্যার হিলটপ তখনো দশ-এগারো কিমি। জনবসতি একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। রাস্তায় কোনও মাইলস্টোন চোখে না পড়ায় একটা মোড়ে এসে ধন্দে পড়ে গেলাম। কোন পথটা অযোধ্যা গেছে? কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর একটা পনেরো ষোল বছরের ছেলেকে এদিকেই হেঁটে আসতে দেখলাম। তাকে জিজ্ঞেস করলাম কোন পথে অযোধ্যা যাব? আর কতদূর? সে হাতের ইশারায় ডান দিকের পথ দেখিয়ে দিল। তারপর দু’তিনটে গায়ের নাম করে বলল, ‘হেঁইগুলা পেরালেই পাবি।’

ajodhya4
পরের গ্রামগুলোকে আগের গ্রামগুলো থেকে কিছুটা উন্নত দেখা গেল। বাড়িগুলোর মধ্যে কয়েকটা পাকা বাড়িও চোখে পড়ল। কয়েকটা গ্রামে মাটির দেওয়াল ও খড়ের ছাউনির আশ্রমিক বিদ্যালয় রয়েছে। পাহাড়ের শীর্ষস্থান হলেও এখানকার ভূমি অনেকটা সমতল। গাছ গাছালিও অনেকটা কমে এসেছে।রাস্তার ধারে কয়েক জায়গায় বহুতল বাড়ির কাজ চলছে। দেখে মনে হল কোনও সরকারি প্রকল্প। কিংবা এন.জি.ও র প্রজেক্ট‌ও হতে পারে। দেখতে দেখতে জামনঘুটু নামে একটা গ্রামে এসে পৌঁছলাম। এখানকার বেশির ভাগ গ্রামের শেষে ঘুটু বা হাতু শব্দটি লক্ষ্যণীয়। ঘুটু মানে পাহাড় আর হাতু মানে গ্রাম। আদিবাসী ভাষার‌ই শব্দ। গ্রামগুলোতে বেশিরভাগ মানুষ‌ই মুড়া, সিংসর্দার, সাঁওতাল সরল কষ্টজীবি মানুষের বাস। হাজার অনাড়ম্বরতার মধ্যে বাড়িগুলির দেওয়ালগুলিতে শৈল্পিকবোধের উজ্জ্বলতা মনকে ভীষণভাবে টানে। ঘর গৃহস্থালিগুলি খুব‌ই সাজানো গোছানো। স্থানে স্থানে বড় বড় মহুল ও কুসুম গাছগুলি নিবিড় সবুজপাতায় ভরা আছে। মহুলফুলের রস আর কুসুমবীজের তেল আদিবাসী জীবনে খুব‌ই প্রয়োজনীয় সামগ্রী হ‌ওয়ায় এদের এত প্রাচুর্য, বোঝা গেল। শুধু এ গ্রামে নয়, গোটা জঙ্গলমহলজুড়ে এ দুটি গাছের অবস্থান লক্ষ্য করেছি।
বাইক এসে পড়েছে বিরাট হোর্ডিং লাগানো রাস্তার কাছে। লেখা আছে অযোধ্যা পাহাড় এখান থেকে এক কিমি। ডান পাশদিয়ে একটা পিচরাস্তা বেরিয়ে গেছে। পথনির্দেশিকায় লেখা রয়েছে ‘আপার ডেম ও বামনি ফলস্ যাওয়ার পথ। আমরা ও পথে না গিয়ে সোজা অযোধ্যা গ্রামের রাস্তায় ঢুকলাম। কিছুটা গিয়েই কয়েকটা মন্দিরের চূড়ো চোখে পড়ল। মনে মনে ভাবলাম, পাহাড় আছে আর মন্দির থাকবে না সে কী হয়। সাধুবাবাদের আখড়াটাও পেয়ে যাব নিশ্চয়। গ্রামে ঢুকতেই ব‌উ বলে উঠল এখানে ঠান্ডা টান্ডা পাওয়া যাবে কিনা? মুহূর্তে ও নিজেই আবিষ্কার করল রাস্তার ধারে একটা দোকান। কোকা, পেপসির বোতলগুলো দোকানের বাইরে সাজানো দেখেই আবিষ্কার করেছে বুঝতে পারলাম। বাইকটাকে দোকানের পাশে স্ট্যান্ড দিয়ে ঢুকলাম দোকানে। একজন আদিবাসী মহিলা দোকান চালাচ্ছেন। সদা হাসিখুশি মুখ। আমার ছেলেকে দেখেই আলাপ জমিয়ে নিল। ঠান্ডা নিলাম। দামটা একটু বেশি শুনে ব‌উ কিছু বলতে যাচ্ছিল। আমি ওর কিছু বলার আগেই বললাম। অনেক নীচ থেকে বহুকষ্টে এখানে মাল ওঠানামা করতে হয়। তাই একটু বেশি না নিলে ওঁদের কিছু থাকে না। দোকানির কথাটা আমিই বলে দেওয়ায় মহিলা কৃতজ্ঞতার দৃষ্টিতে আমারদিকে তাকাল। কিছুক্ষণ আলাপের মধ্যদিয়ে বেশ জমে গিয়েছিল। আমার স্ত্রী আবার একটু মিশুকে, গল্প‌ও করতে পারে অনর্গল। চঞ্চল ছেলাটাকেও ওদের ভালো লেগেছে বুঝলাম। সামনেই ভারত সেবাশ্রমের মন্দির, কিছুটা দূরেই রাম মন্দির। অযোধ্যা আছে আর রামমন্দির থাকবে না, সে কি হয়! অযোধ্যার আর‌ও কয়েকটি দর্শনীয় স্থানের হদিশ নিয়ে আমরা ভারত সেবাশ্রমে ঢুকে পড়লাম।

(কী কী আছে অযোধ্যয়?‌ অপেক্ষা করুন পরের কিস্তির জন্য।)
debasis.halll@gmail.com

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.