আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে

আজ কিংবদন্তি শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ৯৮ তম জন্মদিন। মৃত্যুর ২৮ বছর পরেও জীবনের কত অনুভূতিতে সঙ্গ দিয়ে চলেছে তাঁর গান। দীর্ঘ সঙ্গীত জীবনের নানা অজানা কথা। তুলে আনলেন সত্রাজিৎ চ্যাটার্জি।।
১৯৮৯ সাল। আমার তখন মাত্র ৪ বছর বয়স। সেই সময়েতো আর এখনকার মত সিডি বা ডিভিডি প্লেয়ার ছিল না। তাই টেপ ক্যাসেটই চলতো বাড়িতে। তখন থেকেই “রানার”, গাঁয়েরবধূ”, “অবাক পৃথিবী”, পালকির গান এসব শুনতাম। কার গাওয়া, কার সুরারোপ কিছুই তখন জানার বা বোঝার বয়স হয়নি। বাড়ির গুরুজনদের মুখে গায়কের নাম হয়তো অনেকবারই শুনেছিলাম, কিন্তু সেই উজ্জ্বল নামটি মনে রাখার মত বয়সও তখন হয়নি। আর কাকতালীয় ভাবে সেই বছরেই বাঙালিকে একরকম সঙ্গীতহারা করে এবং শোকের সাগরে ভাসিয়ে সেই অবিস্মরনীয় গান “রানার”, “গাঁয়ের বধুর” সঙ্গীতকার, বাঙালির চিরকালের “প্রাণের শিল্পী” হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সুরলোক থেকে অমৃতলোকে চলে যান। আজ ১৬ই জুন। বাংলা গানের একচ্ছত্র সম্রাট ও মধুক্ষরা কন্ঠের অধিকারী প্রবাদপ্রতিম শিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ৯৮ তম জন্মদিন।

hemanta3
আসলে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের মত বরেণ্য মানুষেরা সত্যিই কম জন্মান। গায়ক হিসেবে, সুরকার হিসেবে যিনি তাঁর জীবদ্দশায় আকাশছোঁয়া খ্যাতির শিখরে উঠেছিলেন, মানুষ হিসেবেও তাঁর কোনও তুলনা ছিল না। কত অখ্যাত শিল্পীকে বাংলা কি হিন্দি চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সুযোগ দিয়ে, গান করিয়ে বা তাঁদের সুরে নিজে গান রেকর্ড করে তাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছিলেন বা কঠিন পেশাদার জীবনে প্রতিষ্ঠার পথে আলোক দিশারী হয়েছিলেন, তার কোনও হিসেব স্বয়ং হেমন্তবাবুর কাছেও ছিল না। এই অজাতশত্রু মানুষটিকে শ্রদ্ধা করতেন না বা ভালোবাসতেন না, এমন মানুষও তখন বাংলা তথা ভারতবর্ষে ছিল কিনা সন্দেহ ! প্রথম জীবনে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাস করে যাদবপুর ইউনিভার্সিটিতে ইঞ্জিনিয়ারিং এ ভর্তি হয়েছিলেন তরুণ হেমন্ত। কিন্তু গানের প্রতি সুতীব্র অনুরাগই তাঁকে গানের জগতে নিয়ে এসেছিলো। বন্ধু তথা স্বনামধন্য কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের কথাতেই প্রথম রেকর্ডিং করেন ১৯৩৭ সালে শৈলেশ দাশগুপ্তের সুরে ও নরেশ্বর ভট্টাচার্যের কথায়। গানটি ছিলো “জানিতে যদি গো তুমি”। এর অপর পিঠের গানটি ছিলো একই গীতিকার ও সুরকারের সুরে “বলো গো বলো মোরে”। বলা বাহুল্য যে গানদুটি জনপ্রিয় হলেও তরুণ গায়ক হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাংলা গানের জগতে গায়ক হিসেবে প্রতিষ্ঠা কিন্তু ৪০ এর দশকের মাঝামাঝি। এই সময় হরিপ্রসন্ন দাসের সুরে “নিমাই সন্ন্যাস” ছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম বাংলা ছায়াছবিতে প্লে ব্যাক করেন। ১৯৪৪ সালে নিজের সুরে গাওয়া বাংলা বেসিক সং “কথা কয়ে নাকো শুধু শোনো” গানটি তুমুল জনপ্রিয় হওয়ার পরেই অনেক স্বনামধন্য সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালকের সুনজরে পড়েন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। তাদের একজন অবশ্যই কিংবদন্তী সুরকার সলিল চৌধুরি। সলিল চৌধুরিই ১৯৪৮ সালে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় কে দিয়ে রেকর্ড করান সেই কালজয়ী “গাঁয়ের বধু”। সলিল বাবু তখন আই.পি.টি এর সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত। বামপন্থী চেতনার উন্মেষে প্রতিবাদের গান লিখে তখন তিনি দিকে দিকে বিপ্লবের আগুন জ্বালছেন। তাঁকে যোগ্য সঙ্গত করেলন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় স্বয়ং। ১৯৫০ সালে তৈরি হল এই জুটির অপর এক বিখ্যাত গান “রানার”। সুকান্ত ভট্টাচার্যের এই গীতিকবিতাটিতে সলিলবাবু এমন অসাধারণ সুর করলেন এবং ততোধিক দক্ষতায় জলদমন্দ্র কণ্ঠস্বরে হেমন্তবাবু সেই গান গাইলেন, যা আজও প্রায় ৭০ বছর অতিক্রান্ত হলেও জনপ্রিয়তায় সমুজ্জ্বল। এর পর আর পিছনে তাকাতে হয়নি। সলিল-হেমন্ত জুটি মানেই সে গান জনতার মুখে মুখে ফিরত। কি প্রেমের গান, কি বিরহের গান, কি বিপ্লবের গান—সব গানই বাংলা আধুনিক গানের জগতে একটা নতুন দিগন্তের সন্ধান দিল। “পালকীর গান”, “আমি ঝড়ের কাছে রেখে গেলাম”,”পথ হারাবো বলেই এবার”, “ধিতান ধিতান বলে”, “দুরন্ত ঘূর্ণির এই লেগেছে”,”শোনো কোন একদিন”,”আমায় প্রশ্ন করে নীল ধ্রুবতারা”,”মনের জানালা ধরে” ইত্যাদি প্রেম-বিরহের গান যেমন ছিল সেখানে, তেমনি “অবাক পৃথিবী”,”আয়রে ও আয়রে”,”ঠিকানা”, “পথে এবার নামো সাথী” র মতো বৈপ্লবিক আবেদনযুক্ত গান ও সেখানে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের ঈশ্বরপ্রদত্ত মধুক্ষরা কণ্ঠে এক আলাদা মাত্রায় ধ্বনিত হয়েছিল।

hemanta2

এর মাঝে মাঝে হেমন্তবাবু নিজের সুরেও বেশ কয়েকটি কালজয়ী বেসিক গান রেকর্ড করেন। যার মধ্যে “ও আকাশ প্রদীপ জ্বেলো না”, “আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি”,”অলির কথা শুনে বকুল”, “আরো ভালো হত”,”বন্ধু তোমার পথের সাথীকে চিনে নিও”, “মা গো ভাবনা কেন” ইত্যাদি জনপ্রিয়তার শিখরে পৌঁছেছিল। তবে ইতিহাস রচনা করেছিল প্রখ্যাত সুরকার নচিকেতা ঘোষের সুরে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা “আমার গানের স্বরলিপি গানটি। ১৯৫৮ সালে রেকর্ড হওয়া এই গান জনপ্রিয়তার নিরিখে আজও অম্লান। এই নচিকেতা ঘোষের সুরেই “মেঘ কালো আঁধার কালো”,”তুমি এলে অনেক দিনের পরেই যেন”,”তার আর পর নেই”,”কোনও নতুন কিছু কথা”,”একগোছা রজনীগন্ধা” ইত্যাদি কালজয়ী গান রেকর্ড করেছিলেন। শুধু তাই নয়, বাংলা বেসিক গানে সলিল চৌধুরি বা নচিকেতা ঘোষ ছাড়াও শ্যামল মিত্র, সতীনাথ মুখোপাধ্যায়, নিজ সহোদর অমল মুখোপাধ্যায়, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় প্রমুখ প্রখ্যাত সুরকার দের সুরে গান করেছিলেন তিনি। ১৯৩৭ থেকে ১৯৮৪ সাল অবধি ৩০০ টিরও বেশি বাংলা বেসিক গান করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়, যার অধিকাংশই পরে এই প্রজম্নের বহু শিল্পী রিমেক করেছিলেন বা আজও টেলিভিশন চ্যানেলের বিভিন্ন সঙ্গীতানুষ্ঠানে বিভিন্ন শিল্পী গেয়ে থাকেন।
এবারে আসি ছায়াছবির গানের প্রসঙ্গে। বাংলা ছায়াছবিতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় প্রথম প্লে ব্যাক করেছিলেন,”নিমাই সন্ন্যাস” ছবিতে। হরিপ্রসন্ন দাসের সুরারোপিত সেই ছবিটি ১৯৪১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত। তারপরে ৪০ এর দশকে আরও বেশ কয়েকটি ছবিতে কণ্ঠদান করলেও সেগুলি বাণিজ্যিকভাবে সেরকম সাফল্য পায়নি । আর ১৯৪৮ সালে বম্বে চলে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেখানে গিয়ে হেমেন গুপ্তের “ফিল্মিস্তান” সংস্থার সাথে যুক্ত হন। তার আগে অবশ্য বাংলার পাশাপাশি কয়েকটি হিন্দি ছবিতেও গান করেছিলেন তিনি। যার মধ্যে “ইরাদা”,”গিরিবালা”, ইত্যাদির নাম করা যায়। তবে ১৯৫২ সালে শচীন দেব বর্মণের সুরে “জাল” ছবিতে দেব আনন্দের লিপে গাওয়া “ইয়ে রাত ইয়ে চাঁদনী” গানটি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে হিন্দি ছবির জগতে প্লে ব্যাক সিঙ্গার হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছিল বলা চলে। ফলস্বরূপ শচীনকর্তার সুনজরে পড়লেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ওরফে হেমন্ত কুমার। আর তারপরে দেব আনন্দের লিপে গান মানেই শচীনকর্তার প্রথম পছন্দ হয়ে দাঁড়ালেন তিনি। “সাজা”,”মুনিমজি”,”হাউস নং ৪৪”,”সোল্ভা সাল”,”মনজিল”,”বাত এক রাত কি” ইত্যাদি। এই ছবিগুলিতে দেব আনন্দের লিপে হেমন্ত গাইলেন “দিলকি উমঙ্গে হ্যায় জাঁহা”,”তেরি দুনিয়া মে জিনে সে”,”হ্যায় আপনা দিল তো আওয়ারা”,”ইয়াদ আ গয়ি”,”না তুম হামে জানো” র মত সুপার হিট কালজয়ী গান। তা ছাড়া অবিস্মরণীয় ছবি “পিয়াসা” তেও শচীনকর্তার সুরেই গুরু দত্তের লিপে গাইলেন তিনি” জানে ওহ ক্যায়সে লোগো থে জিনকে” র মত মর্মস্পর্শী গান। বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি তে তখন হেমন্ত কুমার মধ্যগগ্নের সূর্যের মত দেদীপ্যমান। প্লে ব্যাক করার পাশাপাশি সুরারোপ করছেন একের পর এক ছবিতে। সব ছবি বাণিজ়্যিকভাবে সফল না হলেও ছবিতে ব্যবহৃত গান সবই লোকের মুখে মুখে ফিরছে। ১৯৫২ সালে প্রথম সুরারোপ করলেন “আনন্দমঠ” ছবিতে। প্রথম ছবিই জাত চিনিয়ে দিল কতখানি গভীর সাঙ্গীতিক ধারণা ছিল হেমন্ত বাবুর। ১৯৫৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত তাঁর সুরারোপিত দ্বিতীয় ছবি “নাগিন” বম্বে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে তাঁকে সুরকার ও সংগীত পরিচালক হিসেবে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই ছবিতে হেমন্ত গাইলেন “তেরে দ্বার খাড়া এক যোগী”, “ও জিন্দেগী কে দেনেওয়ালে” মতো মন ভোলানো গান। আর লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে গাওয়ালেন “মেরা দিল ইয়ে পুকারে আজা”, “মন ডোলে মেরা, তন ডোলে মেরি”, যাদুগর সাঁইয়া” র মত সুপার ডুপার হিট গান। “নাগিন” ছবিই আপাদমস্তক বাঙালি হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিয়েছিল। এরপরে “শর্ত”, “ফেরি”,”হামারা ওয়াতন”,”এক হি রাস্তা”,”এক ঝলক”, “হিল স্টেশন”,”ফ্যাশন” —-এক এর পর এক ছবিতে সুরারোপ করার আহ্বান পেলেন তিনি। ১৯৫৭ সাল হেমন্তের জীবনে ব্যস্ততম একটি বছর। ওই বছর একদিকে যেমন ৮ টি হিন্দি ছবিতে সুরারোপ করলেন তিনি, তেমনি বাংলাতেও তিনটি ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। আর একটি মারাঠি ছবি “নায়িকিঞ্চি সাজ্জা”। বাংলা ছবির জগতেও ততদিনে শাহেনশা হয়ে গেছেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। মহানায়ক উত্তমকুমারের সঙ্গে তাঁর এক হৃদ্যতাপূর্ণ জুটি তৈরি হয়ে গেছে সেই ১৯৫৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত “শাপমোচন” ছবি থেকে। এই ছবিতেই হেমন্ত উত্তমকুমারের লিপে গেয়েছিলেন “ঝড় উঠেছে বাউল বাতাস”,”সুরের আকাশে তুমি যেগো সুখতারা”,”বসে আছি পথ চেয়ে” ইত্যাদি অবিস্মরণীয় গান। তখন উত্তম কুমার মানেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের গান বা সুরারোপ ও গান উভয়ই। বন্ধুবরেষু ও স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষেরও প্রথম পছন্দ হেমন্তের স্বর্ণকণ্ঠ। “ইন্দ্রাণী” ছবিতে নীড় ছোট ক্ষতি নেই”,”সূর্য ডোবার পালা”, পৃথিবী আমারে চায় ছবিতে “দূরের মানুষ কাছে এসো,”নিলামওয়ালা ছ আনা”, বন্ধু ছবিতে “মৌবনে আজ মৌ জমেছে”,”মালতী ভ্রমরে করে ঐ”,”চাওয়া পাওয়া” ছবিতে “যদি ভালো এতো খেলা নয়”,—নচিবাবুর সুরে উত্তমকুমারের লিপে হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের সব এক একটি অবিস্মরণীয় গান। তা ছাড়াও উত্তমকুমারের ছবিতে অন্য কোনও নায়কের লিপে গান থাকলেও সেই গান বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই গাইতেন হেমন্তমুখোপাধ্যায়। যেমন “মরুতীর্থ হিংলাজ” ছবিতে অনিল চট্টোপাধ্যায়ের লিপে “পথের ক্লান্তি ভুলে” ,”তোমার ভুবনে মাগো”,চৌরঙ্গী ছবিতে বিশ্বজিতের লিপে “কাছে রবে কাছে রবে” ইত্যাদি গান খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। ১৯৫৮ সালে কিংবদন্তী চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন পরিচালিত একটি অনবদ্য ছবি “নীল আকাশের নীচে” প্রযোজনা ও সঙ্গীত পরিচালনা করেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এই ছবিতে গাওয়া “নীল আকাশের নীচে এই পৃথিবী” এবং “ও নদীরে একটি কথা শুধাই” গান দুটির আবেদন আজও অম্লান। ছবিটির অসাধারণ সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর থেকে উষ্ণ অভিনন্দন লাভ করেছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। এরপরে এই বিশ্বজিৎকেই মুম্বই তে নিয়ে যান হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। “নিজের প্রযোজিত প্রথম হিন্দি ছবি “বিশ সাল বাদ”-(১৯৬২) তে বিশ্বজিৎকেই চয়ন করেন খ্যাতনামা নায়িকা ওয়াহিদা রমনের বিপরীতে। এই ছবিতে গাওয়া “ বেকরার করকে হামে ইউনা যাইয়ে” হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের জনপ্রিয় গানগুলির মধ্যে অন্যতম। তা ছাড়া লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে এই ছবিতেই হেমন্ত গাইয়েছিলেন “কহি দীপ জ্বলে কহি দিল” ,যা লতাজ়ির জীবনের অন্যতম সেরা প্লে ব্যাক। পরে নিজের প্রযোজিত ছবি “কোহরা” তেও বিশ্বজিৎ ও ওয়াহিদা রামনকেই বেছেছিলেন হেমন্ত। ততদিনে বাংলাতে উত্তম-হেমন্ত জুটির মতোই বাংলা ও হিন্দিতে বিশ্বজিৎ হেমন্ত জুটিও বেশ জমে উঠেছিলো। “দুই ভাই”, “মণিহার”,”শেষ পর্যন্ত”,” অগ্নিবন্যা”, গুলমোহর”, চৌরঙ্গী , গোধুলী বেলায়,কুহেলী ইত্যাদি ছবিতে বিশ্বজিতের লিপে গান করেছিলেন হেমন্ত। তেমনি হিন্দিতেও “বিবি আউর মকান, রাহগীর, কোহরা, মজবুর ইত্যাদি ছবিতে বিশ্বজিৎ ও হেমন্ত জুটি। আর সুরকার হিসেবেও হেমন্ত তখন খ্যাতির সর্বোচ্চ শিখরে। কোনো ছবিতে মহম্মদ রফিকে দিয়ে গান করাচ্ছেন তো ঠিক তার পরের ছবিতেই মান্না দে বা তালাত মাহমুদ বা পরের দিকে কিশোরকুমার কে দিয়ে নায়কের লিপে গান করাচ্ছেন। বাংলা তে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, লতা মঙ্গেশকর, গীতা দত্ত প্রমুখ স্বনামধন্যা শিল্পীদের দিয়ে যেমন গান করাচ্ছেন,তেমনি নবাগতা বনশ্রী সেনগুপ্ত বা হৈমন্তী শুক্লা কেও সুযোগ দিচ্ছেন নায়িকার লিপে গান গাওয়ার জন্য। সব গান হয়তো বাণিজ্যিক ভাবে সাফল্য পায়নি। কিন্তু নতুন শিল্পীদের সুযোগ দিয়ে তিনি তাদের আত্মবিশ্বাস যেমন বাড়িয়েছিলেন তেমনি সাঙ্গীতিক জীবনে প্রতিষ্ঠা পাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রেরণ যুগিয়েছিলেন। বাংলার লব্ধপ্রতিষ্ট পরিচালকদের সঙ্গেও তাঁর গভীর হৃদ্যতার সম্পর্ক তখন। তপন সিনহার ছবিতে যেমন গান গাইছেন বা সঙ্গীত পরিচালনা করছেন, তেমনি তরুণ মজুমদারের ছবি মানেই হেমন্তের গান ও সঙ্গীত পরিচালনা। “পলাতক”,ফুলেশ্বরী”,”কুহেলী”,”সংসার সীমান্তে”, “দাদার কীর্তি”, “ভালোবাসা ভালোবাসা”,”পথভোলা” ইত্যাদি তরুণ মজুমদারের প্রায় ৩১ ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেন তিনি। অজয় কর, অসিত সেন, অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ যশস্বী পরিচালকের ছবি মানেই সুরকার হিসেবে প্রধান পছন্দ হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। সেখানে উত্তম কুমার থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, অনিল চট্টোপাধ্যায় , রঞ্জিত মল্লিক,দীপঙ্কর দে, সমিত ভঞ্জ, তাপস পাল প্রমুখের নায়কের লিপে গান যেমন আছে, তেমনি ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর রায়, অনুপকুমার বা রবি ঘোষের মত কৌতুকাভিনেতার লিপের গানও তিনিই গাইলেন। ১৯৭১ সালে হেমন্ত প্রথম ক্যামেরার পেছনে আসেন পরিচালক হিসেবে। শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায় ও নিজ পুত্রব্ধু মৌসুমী কে দিয়ে অভিনয় করান “অনিন্দিতা” ছবিতে। ছবিটি ব্যবসায়িক ভাবে খুব সফল না হলেও এই ছবিতে গাওয়া রবীন্দ্রসংগীত “দিনের শেষে ঘুমের দেশ” অসাধারণ জনপ্রিয় হয়েছিল হেমন্তের জলদমন্দ্র কণ্ঠে। তা ছাড়া এই ছবিতেই কিশোরকুমারের গাওয়া “ওগো নিরুপমা” গানটিও যেমন জনপ্রিয় হয়েছিলো তেমনি বাংলা ছায়াছবির গানে কিশোরকুমারকেও আলাদা স্বীকৃতি দিয়েছিল। এই বছরেই হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বম্বে তে তাঁর শেষ ছবি “বিশ সাল পেহলে” প্রযোজনা করে, যেখানে হেমন্ত পুত্র জয়ন্ত মুখোপাধ্যায় নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন। ছবিটি একেবারেই চলেনি। বম্বের বাজারে হেমন্তবাবুর তখনপ্রায় ৪৫ লাখ টাকার দেনা। সেই দেনা শোধ করতে তখন আসমুদ্র হিমাচল পাবলিক ফাংশন করছেন তিনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও কঠিন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছিলেন। হিন্দি ছায়াছবির জগৎ থেকে একপ্রকার বিদায় নিয়েই কলকাতা ফিরে এলেন তিনি। বলিউড হারাল একজন অনন্য সাধারণ সুরকার ও সঙ্গীতকারকে। আর আশ্চর্যজনকভাবেই যেসব সুরকার বা পরিচালকদের তিনি খ্যতির মধ্যগগনে থাকার সময় আর্থিকভাবে বা পেশাগত ভাবে সহায়তা করেছিলেন ,এই কঠিন সময়ে প্রায় কেউই তাঁর পাশে এলেন না। রবির মত তাঁর একসময়ের সহকারী সঙ্গীত পরিচালক এবং মিউজিক্যাল অ্যা্রেঞ্জার হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে দিয়ে গান না করিয়ে মুকেশ, মহম্মদ রফি বা মান্না দে কেই নির্বাচিত করলেন। পেশাগত এই সঙ্কীর্ণতার কারণেই কিছুটা হতাশ হয়েই বাংলায় ফিরে এলেন হেমন্ত। তবে বাংলাতে ফিরেও তিনি তাঁর আকাশছোঁয়া জনপ্রিয়তা ধরেই রেখেছিলেন। উত্তমকুমারের লিপে “সোনার খাঁচা”,বিকেলে ভোরের ফুল”,”সন্ন্যাসী রাজা”,”বাঘবন্দী খেলা”,ইত্যাদি ছবিতে যেমন গান গাইলেন, তেমনি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়্যের লিপে “স্ত্রী”,”নিশিমৃগয়া”,”প্রতিমা”,”মন্ত্রমুগ্ধ” বা সমিত ভঞ্জের লিপে “ফুলেশ্বরী”, রঞ্জিত মল্লিকের লিপে “রাগ-অনুরাগ”,”প্রক্সি” ইত্যাদি ছবিতে অসাধারণ সব গান উপহার দিলেন। সেগুলোর কোনটি রোমান্টিক গান তো কোনোটি আবার কৌতুকগীতি বা মাতাল চরিত্রের লিপে গান বা রাগাশ্রয়ী গান। আর সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে বাংলা ছবিতে একের পর এক কাজ করে যেতে লাগলেন। আর সেই সঙ্গে চললো বেসিক গান আর রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, অতুলপ্রাসাদী, রজনীকান্ত,দেশবন্ধুর গান রেকর্ড করা। রবীন্দ্রসঙ্গীতে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় চিরকালের সমুজ্জ্বল একটি নক্ষত্র। বাংলা ছায়াছবিতে রবীন্দ্রসঙ্গীত ব্যবহার করতে যেমন তাঁর অনবদ্য দক্ষতা,তেমনি অন্যান্য শিল্পীকে রবিঠাকুরের গান রেকর্ড করানোর ভার ও পড়তো তাঁরই ওপরে। লতা মঙ্গেশকরকে দিয়ে সর্বপ্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত তিনিই রেকর্ড করিয়েছিলেন। ৮০ এর দশকে কিশোরকুমার কে দিয়েও তিনি বেশ কয়েকটি রবীন্দ্রসংগীত রেকর্ড করান। এই ৮০ এর দশকেই তিনি সলিল চৌধুরীর সুরে গাওয়া “রানার”, “গাঁয়ের বধু”,”অবাক পৃথিবী” ইত্যাদি গানগুলি পুনরায় রেকর্ড করেছিলেন। তখন তিনি শুধুমাত্র একজন গায়ক বা সঙ্গীত পরিচালক ই নন, একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় নমস্য ব্যক্তি। কত নবাগত শিল্পী কে দিয়ে নিজের সুরে গান করিয়েছেন, তাদের পেশাগত ভাবে সমৃদ্ধির পথা দেখিয়েছেন তার ঠিকানা নেই। শিবাজী চট্টোপাধ্যায়, অরুন্ধতী হোম চৌধুরী, হৈমন্তী শুক্লা, বনশ্রী সেনগুপ্ত, মাধুরী চট্টোপাধ্যায়—তালিকাটি ক্রমেই দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর। শুধু তাই নয়,রবীন্দ্রসংগীতের প্রবাদপ্রতিম শিল্পী ও অগ্রজ পথিক দেবব্রত বিশ্বাস কে তাঁর মৃত্যুর কয়েক মাস আগে রবীন্দ্রসদনে এক অভূতপূর্ব সম্বর্ধনা জ্ঞাপন অনুষ্ঠানেও হেমন্তই ছিলেন মূল উদ্যোক্তা। ওই বছরেই অর্থাৎ ১৯৮০ তে মহানায়ক উত্তমকুমারের অকাল প্রয়াণের পরে মানসিকভাবে খুব ভেঙে পেড়েছিলেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায়। যার কণ্ঠের সাথে আশ্চর্য মিল ছিলো তাঁর, যার লিপে প্রায় ৩২ টি ছবিতে গান করেছিলেন হেমন্ত, সেই মহানায়কের আকস্মিক মৃত্যুটা মানসিকভাবে খুবই আঘাত দিয়েছিলেও হেমন্তকে। তাই কাকতালীয়ভাবে শরীরটাও ভেঙে পড়ছিল ধীরে ধীরে। গলায় সুর, সেই রোমান্টিক মধুক্ষরা কণ্ঠ হারিয়ে যাচ্ছিল। তবুও ৮০ এর দশকে কয়েকটি বাংলা ছবিতে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন, গান রেকর্ড ও করেছিলেন বেশ কয়েকটি। সারা জীবনে প্রায় সাড়ে ৪০০০ গান রেকর্ড করেছিলেন। বাংলা ও হিন্দির পাশাপাশি মারাঠি,গুজরাটি, ভোজপুরী, ওড়িয়া,অসমীয়া,কোঙ্কনি ইত্যাদি ভাষাতেও গান রেকর্ড করেছিলেন। এই সময়ের আর একটি গৌরবোজ্জ্বল ঘটনা হলো ১৯৮৫ সালে নেতাজী ইন্ডোরে সঙ্গীত জীবনের ৫০ বছর পূর্ণতা উপলক্ষে এক বর্ণাঢ্য সঙ্গীতানুষ্ঠান ,যেখানে স্বয়ং লতা মঙ্গেশকর উপস্থিত ছিলেন। আর এরপর ১৯৮৭ সালে “লালন ফকির” ছবিতে গানের জন্য তিনি বি.এফ.জে.এ পুরস্কার লাভ করেছিলেন। যদিও জাতীয় পুরস্কার তিনি এর আগে আরো দু দুবার লাভ করেছিলেন। আর হিন্দি ছবিতে সুরারোপের জন্য ফিল্ম ফেয়ার অ্যাওয়ার্ডও পেয়েছিলেন বেশ কয়েকবার। বিশ্বভারতী তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট উপাধিতেও অভিষিক্ত করেছিল। ১৯৮৯ সালে জীবনের শেষবেলায় বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সেখানকার মানুষজন ও সরকারের থেকে যে উষ্ণ অভ্যর্থনা ও আন্তরিক শ্রদ্ধা-সম্মান পেয়েছিলেন তার তুলনা নেই। এই বাংলাদেশ সরকারই তাঁকে মাইকেল মধুসুদন দত্ত পুরস্কারে ভূষিত করেছিলেন। অথচ অকল্পনীয়ভাবে ভারত সরকার তাঁর না পদ্মশ্রী বা পদ্মভূষণের জন্য সঠিক সমইয়ে সুপারিশ করেইনি। যখন তাঁকে “পদ্মশ্রী” দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছিলো,হেমন্ত মুখোপাধ্যায় সসম্মানে তা প্রত্যাখ্যান করেন । সত্যিই তো। তাঁর মত আকাশছোঁয়া খ্যাতির শিখরে উন্নীত, আকাশের মত বিশাল হৃদয়বান ব্যাক্তিত্বের কাছে ওই সার্টিফিকেটের কোনও মূল্য নেই। সারা জীবনে যে মানুষটা “অজাতশত্রু” ছিলেন, আসমুদ্র-হিমাচল ভারতের অগণিত মানুষের শ্রদ্ধা, ভালোবাসা পেয়েছিলেন,যাঁর মৃত্যুর পরে সারা বাংলা শোকের সাগরে নিমজ্জিত হয়েছিল ,শেষযাত্রায় লাখো মানুষ শ্মশান অবধি পদযাত্রায় সাথী হয়েছিলো সেই মানুষটির কাছে তাঁর শ্রোতারাই সম্পদ। ১৯৮৯ সালের ২৬ শে সেপ্টেম্বর আপামর বাঙালি যখন শরতের শুভারম্ভে দেবীপক্ষের প্রতীক্ষা করছে, সেই শরতেই হেমন্তের চিরবিদায়। সময় তরঙ্গের দুর্নিবার গতিতে আর ২৮ বছর অতিক্রান্ত। তবু হেমন্ত মুখোপাধ্যায় বেঁচে আছেন প্রতিটি সঙ্গীর প্রেমীর মনে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শুভোদ্যোগে রবীন্দ্র সরোবরে তাঁর পূর্ণাবয়ব মূর্তি স্থাপিত হয়েছে অনেক আগেই। বনস্পতির ছত্রছায়ার ঘেরা সেই মূর্তির পাদদেশে খোদাই করা লাইন “আমার গানের স্বরলিপি লেখা রবে”। সত্যিই তাঁর মত মানুষের মৃত্যু নেই। তিনি যে বাঙালির প্রাণের শিল্পী। সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্না, আনন্দ-বেদনা, মিলন বিরহে চিরকালের সাথী।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.