শোভন চন্দ
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে প্রকৃতিপ্রেম, অরণ্যের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা কিংবা অপুর জীবনের টানাপোড়নের চিত্তাকর্ষক বর্ণনায় আজও তিনি বাঙালি পাঠক হদয়ে স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। বাংলা সেলুলয়েডেও সমান জনপ্রিয় বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় । খানিকটা “উপেক্ষিতা” হয়ে শুরু করলেও ছোট্ট গাঁ নিশ্চিন্দিপুর থেকে চাঁদের পাহাড়ে তার সুদীর্ঘ পথযাত্রার পাঁচালি অত্যন্ত আকর্ষণীয়। আজ ৬৫ বছর অতিক্রান্ত তিনি আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন । কিন্তু আজও হয়তো কোন “আদর্শ হিন্দু হোটেলে” কিংবা “ইছামতী”র তীরে তিনি নিশব্দে পথ হেঁটে চলেছেন। তবে কেমন ছিলেন মানুষ বিভূতিভূষণ, কেমন ছিলেন রসিক, আড্ডা প্রিয় বন্ধু বিভূতিভূষণ? সেই অজানা –অদেখা বিভূতিবাবুর স্মৃতিচারণে নানান মজার কথা তুলে ধরলেন আমাদের সকলের প্রিয় ভানুবাবু (সবীতেন্দ্রনাথ রায়)।
র্যাক আলমারি চেয়ার টেবিলের ভিড়ে বইয়ের দোকানের ভিতরের জায়গা আরও সংকীর্ণ। তবে সেখানেই কেউ টুলে, কেউ বেঞ্চিতে, কেউ বা মাটিতে রাখা বইয়ের ওপর বসে পড়তেন। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায় বলেছিলেন তেতুঁল পাতায় ন’জন। জানতাম এইটুকু ঘরে আঠারোজন! কিছুক্ষন পরেই মুড়ি বেগুনি ডালমুটের ফরমাস হল, ভাবা যায় ! এইসবের মধ্যে জমে উঠত আড্ডা আর এই আড্ডার অন্যতম প্রাণপুরুষ ছিলেন বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়।
মুড়ি বেগুনির সাথে জমে উঠল আড্ডা আগাগোড়া ঈশ্বরাভিমুখী ছিল বিভূতিভূষণের চরিত্র। আড্ডার মধ্যেই কবিশেখর বলে উঠলেন যাই বল বিভূতি, তোর একটু জ্যাঠামো আছে । ওপার থেকেবিভূতিবাবু নির্বিকার ভাবে বলে উঠলেন কি জ্যাঠামো করলাম কালীদা? সেদিন দেখলাম একজনের অটোগ্রাফে লিখেছিস “গতিই জীবন, গতির দৈন্যই মত্যু”। ইতিমধ্যে সজনিকান্তবাবু এসে গেছেন, তিনি বলে উঠলেন আসলে কি জানো -কালীদা অত গতির হাঁটাচলা পছন্দ করেন না। সবাই হেসে উঠল। বিভূতিবাবু আড্ডাকে খুব ভালবাসতেন। বলতেন মাঠে হাওয়া খাওয়ার মত আড্ডায় এলেই মনটা ফ্রেশ হয়ে যায় । তাঁর প্রথম পত্নী গৌরী দেবী বিবাহের এক বৎসরের মধ্যেই বিসূচিকা রোগে মার যান। এই সময়ে বিভূতিবাবু খুবই ভেঙে পড়েছিলেন । আত্মা পরলোক-তত্ব নিয়ে ভাবতেন। পরিচয় পত্রিকা গোষ্ঠীর লেখক শ্যামলবাবুর সান্নিধ্যে এসে আফ্রিকার জঙ্গলে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। তিনি মনে করতেন জঙ্গলে নির্জন বাস হলে পরলোকের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাবে।
হরিণাভিতে যখন পড়াচ্ছেন, একটি মেয়ে তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হয়। তরুণীর সুনাম হানি হতে পারে ভেবে অন্ন-সংস্থান না থাকলেও চাকরি ছেড়ে চলে আসেন। এই ঘটনাই বিভূতিভূষণের প্রথম গল্প “উপেক্ষিতা”র পটভূমি। ছোটবেলা থেকেইঅল্প-স্বল্প সাহিত্য রচনার চেষ্টা ছিল। পত্নী বিরহের পর সাহিত্যে আরও বেশি করে মনোনিবেশ করলেন । বেশ কয়েক দিন ভাগলপুরের জঙ্গল মহলেও বাস করছিলেন। তাই হয়তো আমরা পথের পাঁচালি, দেবযান, আরণ্যক পেলাম।
খুব সহজেই তিনি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে যেতে পারতেন। বিবাহের পর তিনি সংসার জীবন শুরু করতে থাকেন ব্যারাকপুরে, বনগ্রামের কাছে, ইছামতীর তীরে। পরে ঘাটশিলায় বাড়ি হল। বিভূতিবাবুর জন্ম হয় মামা বাড়িতে মুরাতিপুরে। পিতা মহানন্দ চিরকাল উদাসীন, কবিতা আর কথকতা নিয়ে থাকতেন। দুই ভাই, দুই বোন ছিল, এক বোন অল্প বয়সেই মারা যান ।অন্যজন অল্প বয়সে বিধবা হয়ে দাদার সংসারে থাকতেন। একদিন নদীতে স্নান করতে গিয়ে কুমিরের হাতে মারা যান। পোষাকে পরিচ্ছদে কি অনাড়ম্বর ছিলেন তিনি ভাবা যায় না। ভাগ্নি উমা তাঁর কাছেই মানুষ হয়। ঘাটশিলায় লেখক শচীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে তার ভাগ্নির বিয়ে হয়। বিয়ের রাতে সবচেয়ে মজার বিষয় ছিল বন্ধুদের নিয়ে এঁদেলবেড়ের জঙ্গলেঘুরে আসা। বিভূতিবাবু বললেন দেখুন বর এসেছে তার মনে বিয়ে ঠিকই হবে, কিন্তু এমন অপরাহ্ন এই সূর্যাস্ত পাব কোথায় ? এমনি প্রকৃতি পাগল ছিলেন তিনি ।
বিভূতি বাবুকে সঙ্গী হিসেবে সবাই সব সাহিত্যিকই পছন্দ করতেন। একদিন ট্রেনে তারাশঙ্করবাবুর সাথে ছিলেন।খাওয়ার পর বললেন আমি আর উঠতে পারছি না ঠান্ডায়,তারাশঙ্কর বাবু অকুন্ঠচিত্তে হাত ধুইয়ে দিলেন। লেখকদের ভালবাসা এরকমই ছিল তাঁর প্রতি। ঘাটশিলার বাড়িটি পান অদ্ভুতভাবে। ঋণ দিয়েছিলেন তা আর শোধ হয়নি, সে লোক ঋণ মুক্ত হওয়ার জন্য তাঁকে বাড়িটি দেন প্রথম স্ত্রীর নামে রাখেন গৌরীকুঞ্জ ।আমরা গিয়ে দেখেছি রমা বৌদি, পুত্র তারাদাস ভাই ডাক্তার নুটুবিহারি তার স্ত্রী যমুনা বৌদিদের ভর্তি সংসার।
এক বিজয়া সম্মীলনীর খাওয়া দাওয়ার পরে তিনি হঠাৎই অসুস্থ হয়ে পড়েন।কয়েকদিনের মধ্যেই ঘর- সংসার ছেড়ে চলে যান বিভূতিভুষণ ১৯৫০ সালের ১লা নভেম্বর তারিখে । তাঁর শ্রাদ্ধ বাসরে লেখকগণ গিয়েছিলেন ।ঘাটশিলা স্টেশনে জমা হয়েছেন সাহিত্যিকরা, এক বাউল গাইছে “সজনী আর কি খাবি, সজনী আর কি খাবি”। সজনীকান্ত বলে উঠলেন আচ্ছা বিজয়ার উৎসব খেয়ে মারা গেল বিভূতি । আর এ ব্যাটা আবার গাইছে দেখ -“সজনী আর কি খাবি” দুঃখের মধ্যেও বিভূতিভূষণের বন্ধুরা হেসে উঠলেন । কে জানে হয়তো বন্ধুদের রসিকতায় আজও এই অমর স্রষ্টা সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে কোন ইছামতীর তীরে সবার আড়ালে মৃদু হাসছেন………।