সেদিন বুদ্ধদেবকেও কেউ বুঝতে চাননি

স্বরূপ গোস্বামী

ইতিহাস বোধ হয় এভাবেই ফিরে ফিরে আসে। একদিন যদি গুজবের সুযোগ নিয়ে থাকেন, গুজব এভাবেই গুজবের কাছে মাশুল দিতে হয়। সেদিন যতই বোঝান, কেউ বুঝবে না।
এমনই হয়েছিল নন্দীগ্রামে। বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য বারবার বলেছিলেন, কেমিক্যাল হাবের জন্য জমি নেওয়া হবে না। নন্দীগ্রামের মানুষ যদি শিল্প না চান, সেখানে কেমিক্যাল হাব হবে না। কোনও জমি অধিগ্রহণ হবে না। একবার নয়, দুবার নয়। শতাধিকবার কথাটা বলেছিলেন। কিন্তু তা সত্বেও থেকে গিয়েছিল ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটি। তারপরেও রাস্তা কাটা হয়েছিল। প্রশাসনকে মাসের পর মাস ঢুকতে দেওয়া হয়নি। একটি মুক্তাঞ্চল করে তোলা হয়েছিল নন্দীগ্রামকে। খুব পুরনো ঘটনা নয়। মাত্র আট–‌নয় বছরের পুরনো। এত তাড়াতাড়ি ভুলে যাওয়ার কথাও নয়।

buddhababu3আজও যেন সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাছি পাহাড়ে। মুখ্যমন্ত্রী রাজ্যের সব স্কুলে বাংলা পড়ানোর কথা বলেছিলেন। সেটা ব্যুমেরাং হয়েছিল পাহাড়ে। ফের পাহাড়ের জাতিসত্ত্বারে উসকে দেওয়ার খেলায় মাতলেন বিমল গুরুং। পাহাড়বাসীকে উসকে দিলেন, জোর করে বাংলা চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে। মুখ্যমন্ত্রী অনেকটাই পিছিয়ে এলেন। বললেন, পাহাড়ে বাংলা মোটেই আবশ্যিক করা হচ্ছে না। এটা থাকবে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে। যার ইচ্ছে হবে, সে পড়বে। যার ইচ্ছে হবে না, সে পড়বে না। সরকার কোনওকিছুই জোর করে চাপিয়ে দেবে না।
কিন্তু বিমল গুরুং সে কথা শুনলে তো?‌ তিনি গোঁ ধরে বসলেন, মুখের কথায় হবে না। লিখিত প্রতিশ্রুতি দিতে হবে। ক্যাবিনেট মিটিংয়ে আলোচনা করে এই সিদ্ধান্ত ঘোষণা করতে হবে। কিন্তু তাঁর দাবির কাছে এতখানি নতজানু হলেও সরকারের পক্ষে মুশকিল। তাহলে যে ‘‌রাফ অ্যান্ড টাফ’‌ সরকার বলা যাবে না। অতএব, ক্যাবিনেটে বিষয়টা নিয়ে আলোচনা হল না। সিদ্ধান্তও হল না। এদিকে পাহাড়ে ফের আগুন জ্বলল। আতঙ্কে পাহাড় ছাড়ছেন হাজার হাজার পর্যটক। সরকার যতই আশ্বাস দিক, যাঁরা বুকিং করেছিলেন, অধিকাংশই বাতিল করছেন। এমনকী পুজোর বাজারেও বড়সড় ধাক্কা খাবে পর্যটন ব্যবসা। এত বছরের চেষ্টায় যে শান্তি ফেরানো গিয়েছিল, মোর্চার একদিনের হঠকারিতায় তা আবার প্রশ্নের মুখে পড়ে গেল।

mamata4
হ্যাঁ, মোর্চার কাছে এটাই অস্ত্র। তারা এই ইস্যু সহজে ছাড়বে না। তারা দেখাতে চাইবে, সরকার পিছু হঠতে বাধ্য হল। অবোধের যেমন গোবধে আনন্দ, বিমল গুরুংদের তাতেই আনন্দ। মুখ্যমন্ত্রী বারবার বলবেন, বাংলাকে চাপিয়ে দেওয়া হবে না। কিন্তু সেই আবেদনে তেমন কাজ হবে না। দোষটা মমতা ব্যানার্জির নয়। তিনি সত্যিই আর চাইছেন না জোর করে বাংলাকে চাপিয়ে দিতে। যেমন সেদিন বুদ্ধদেববাবুও চাননি নন্দীগ্রামের জমি জোর করে দখল করতে।

সেদিন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সদিচ্ছায় ভরসা রাখতে পারেনি নন্দীগ্রাম। আজ মমতা ব্যানার্জির যত সদিচ্ছাই থাক, এই মুহূর্তে পাহাড়বাসীর কাছে তা বিশ্বাসযোগ্য হবে না। এটাই গুজবের মাহাত্ম্য। সেদিন জমি দখলের গুজবকে উসকে দিয়েছিলেন মমতা ব্যানার্জি। আজ তিনি আশ্বস্ত করলেও গুজব নিজের নিয়মেই তার ডালপালা মেলবে। এটাই ইতিহাসের ট্র‌্যাজেডি। ইতিহাস এভাবেই ফিরে ফিরে আসে।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.