স্বরূপ গোস্বামী
বেশ কয়েকটি কাগজে ছবিটি ছাপা হয়েছে। বিমল গুরুং তাঁর দলের কাউন্সিলরদের শপথ নেওয়াচ্ছেন। কীসের শপথ? যাঁরা মোর্চার হয়ে জিতেছেন, তাঁরা মোর্চাতেই থাকবেন, দল ছাড়বেন না।
ভেবে দেখুন। দার্জিলিংয়ে মোর্চা ৩২ টির মধ্যে ৩১ আসনে জিতেছে। তার পরেও নিশ্চিত থাকতে পারছে না। আশঙ্কা, তাঁর দলের জেতা কাউন্সিলরদের ভাঙিয়ে নিয়ে যাওয়া হবে। ভয় দেখিয়ে, বা টাকার লোভ দেখিয়ে, নিয়ে যাওয়া হতে পারে শাসক দলে। কালিম্পং বা কার্শিয়াংয়েও নির্বাচনে বিরাট সাফল্য পেয়েছে মোর্চা। একতরফা জয় বলতে যা বোঝায়, তাই।
অন্যদিকে, ভেবে দেখুন মিরিকের কথা। সেখানে তৃণমূল জিতেছে ৯ টির মধ্যে ৬টি আসনে। এককভাবেই বোর্ড গঠন করার কথা। তা সত্বেও তারা নিশ্চিন্ত হতে পারছে না। ছয় কাউন্সিলরকে জেতার দিনই নামিয়ে আনা হয়েছে সমতলে। প্রথমে এনে তোলা হয় শিলিগুড়ির একটি হোটেলে। কিন্তু সেখান থেকে যদি কেউ পালিয়ে যায়! তাই নিয়ে যাওয়া হল ডুয়ার্সে। এই গরমের মাঝে ঠান্ডা পাহাড় থেকে রোদ ঝলসানো ডুয়ার্সে।
আসলে, কেউ কাউকে বিশ্বাস করে না। মোর্চার আশঙ্কা, তৃণমূল তাঁদের কাউন্সিলরদের ভাঙিয়ে নিতে পারে। আবার তৃণমূলের আশঙ্কা, মোর্চা তাদের মধ্যে থেকে দু–তিনজনকে ভাঙিয়ে নিতে পারে। তৃণমূল এই অবিশ্বাস করছে কেন? কারণ, যাঁরা এসেছেন, মোর্চার ঘর ভেঙেই এসেছেন। কোন অঙ্কে এসেছেন, সেটা তৃণমূল নেতৃত্বের চেয়ে ভাল কে জানে! অঙ্কটা বেড়ে গেলে পুরনো দলে ফিরতেই পারেন। অতএব, এঁদের বিশ্বাস করা যায় না।
আর মোর্চা তো ঘরপোড়া গরু। কোথায় তাঁদের কাকে কীভাবে ভাঙানো হয়েছে, বিমল গুরুং বেশ ভালই জানেন। আর কাকে কাকে টোপ দেওয়া হতে পারে, আন্দাজ করতে পারছেন। কেনা বেচার এই রাজনীতি যে ভয়ঙ্করভাবে শুরু হয়ে গিয়েছে, এটাই কঠোর বাস্তবতা। শিলিগুড়ি পুর নির্বাচনের পর বাম কাউন্সিলরদেরও নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যেতে হয়েছিল। গত বছর কংগ্রেসও নির্বাচিত বিধায়কদের এরকম একটা মুচলেকায় সই করিয়েছিল। কী ফল হল? তুষার ভট্টাচার্য থেকে মানস ভুঁইয়া, কানহাইয়ালাল আগরওয়াল থেকে শম্পা দরিপা, ড্যাং ড্যাং করে নিজেদের ঠিকানা খুঁজে নিলেন। এবং, এঁদের বিধায়ক পদ বাঁচাতে যতরকম ছলচাতুরি করা যায়, স্পিকারমশাই তাই করবেন।
আগে কিন্তু এসবের দরকার পড়ত না। বামেরা জানতেন, তাঁদের লোক তাঁদেরই থাকবে। কোথাও যাবে না। তৃণমূল বা কংগ্রেসও নেতৃত্বও নিশ্চিন্ত থাকতে পারতেন, সিপিএম তাঁদের জেতা সদস্যকে ভাঙাতে আসবে না (দু একটা ব্যতিক্রম থাকতে পারে। তবে মোটের ওপর এই বিশ্বাসটা রাখা যেত)। কিন্তু এখন সেই বিশ্বাসের জায়গাটা ভেঙে গিয়েছে। দল ভাঙানো আর ঘোড়া কেনা বেচার এই সংস্কৃতি গো–বলয় থেকে দারুণভাবেই ঢুকে পড়েছে এই বাংলার রাজনীতিতে। এমনকী সেই দলভাঙানোয় ডিএম–এসপিদেরও নির্লজ্জভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে। ‘উন্নয়নের কর্মযজ্ঞ’ বলে নতুন দুটো শব্দ চালু হয়েছে। যার আড়ালে যে কোনও ডাকাতি, অপহরণও চাপা পড়ে যায়।
কী ভাবছেন, এমন পরিবর্তন এমনি এমনিই এসে গেল!
অনুপ্রেরণা লাগে মশাই, ‘অনুপ্রেরণা’।