সেই বই শুধু উপহার নয়, স্বীকৃতি

কাজের সূত্রে আলাপ। কিন্তু মাঝে ফুটবল আর ইস্টবেঙ্গল। আলাপ থেকে ঘনিষ্ঠ হতে আর কী চাই!‌ পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও স্নেহ মিলিয়ে চমৎকার একটা সম্পর্ক। শান্ত মিত্রর প্রয়াণে কলম ধরলেন তাঁরই বিশেষ স্নেহভাজন কুণাল দাশগুপ্ত।।
‌রবি ঠাকুরকে আঁকড়ে ধরে মানসিক যন্ত্রণার উপশম ঘটাতে পারলাম না। শান্তদা চলে যাওয়ার পর থেকে বহুবার নিজেকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেছি, এই ভেবে, তবুও শান্তি তবু আনন্দ তবু অনন্ত জাগে। আমার কাছে এই শব্দগুলোর ঠিকানা কেবলমাত্র বাংলা অভিধান। শান্তদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় খবরের কাগজের মাধ্যমে। প্রাক্তন ফুটবলার হিসেবে, কখনওবা কোচ হিসেবে। টেলিভিশনের পর্দাতেও বহুবার দেখেছি। চোখের সামনে প্রথম দেখলাম স্টেট ব্যাঙ্কের এক সাংবাদিক বৈঠকে। একজন ফুটবলার কিনা স্টেট ব্যাঙ্কের পূর্বাঞ্চলের সিপিআরও!‌ ওরকম উচ্চপদে একজন মাঠের মানুষকে দেখে কেন জানি না বেশ গর্বিতই হয়েছিলাম। কারণ, ক্রিকেটারদের কলম ফ্র‌্যাকচার হলেও তারা সরকারি আশীর্বাদে হোমরা চোমরায় পরিণত হন। ফুটবলারদের ক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায় না। কয়েকটি ব্যতিক্রম ছাড়া। এই মানুষটিই পরে কলকাতার শেরিফ হয়েছিলেন। সেদিনও একইরকম গর্বিত হয়েছিলাম।

santo mitra

শান্তদার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযোগ ঘটে আইএফএ–‌র কিক অফ পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত হওয়ার পরে। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা দরকার, আইএফএ তে একমাত্র প্রয়াত রঞ্জিত গুপ্ত ছাড়া আর কেউই এই পত্রিকার বিষয়ে যত্নবান ছিলেন না। সত্যি কথা বলতে কী, পত্রিকার গুরুত্বই ওই রঞ্জিতবাবু ছাড়া কেউ বুঝতে পারেননি। এমনকী একসময় কিক অফের কর্মীদের রিসেপশনে বসানোর সিদ্ধান্তও নিয়ে ফেলেছিলেন উদ্ভট প্রশাসকরা। শান্তদা এসবেরই বিরোধী ছিলেন। অভিভাবকের মতোই আগলে রাখতেন। এর জন্য আই এফ এ কর্তাদের সঙ্গে ঝগড়াও কম করেননি।। আইএফএ কর্তাদের একটা বড় অংশ পত্রিকাটিকে সুনজরে দেখতেন না। ভাবখানা এমন, যেন এটা থাকলেও চলে, না থাকলেও চলে। বিজ্ঞাপন না থাকলে যে পত্রিকা ভেন্টিলেশনে চলে যায়, হয় তাঁরা সেটা বুঝতেন না। নতুবা বুঝেও না বোঝার ভান করতেন। মনে আছে, শান্তদা কী পরিশ্রম করে কিক অফকে নো প্রফিট, নো লস পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত উদ্যোগে বিজ্ঞাপনে ভরিয়ে দিয়েছিলেন পত্রিকাকে। তাঁর বাইরের যোগাযোগ ও প্রভাব কতটা, তখন বুঝেছিলাম। বলতেন, ইস্টবেঙ্গলের ফুটবলাররা শেষ অব্দি লড়তে জানে, তারা কখনও জো হুজুর হয় না।

একদিনের কথা তো ভুলতেই পারব না। শান্তদা জানতেন যে আমি স্পোর্টস সায়েন্স নিয়ে সামান্য পড়াশুনো করেছি। এসব নিয়ে টুকটাক আলোচনাও হত। বাড়িতে একদিন ডেকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম। আসলে, কাউকেই রেয়াত করতেন না। আমার হাতে একটা বই ধরিয়ে দিলেন। বইটা স্পোর্টস ইনজুরির ওপর। বললেন, এই বইটা তোমার কাছেই থাকা উচিত। বাকরুদ্ধ হয়ে ঘরে ফিরেছিলাম। জীবনে অনেক উপহার পেয়েছি। আমার বাড়িতে এই সংক্রান্ত বইয়েরও অভাব নেই। তবু শান্তদার মতো মানুষের কাছ থেকে পাওয়া ওই বই শুধু উপহার নয়, তার থেকে অনেক বেশি কিছু। হয়ত স্বীকৃতিও।

ধমকও খেয়েছি বহুবার। প্রথম প্রথম রাগ হত। পরে বুঝেছি, ধমকটা ছিল আসলে আশীর্বাদ। সে বছর আমি মহমেডান স্পোটিং ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম, ফিজিও হিসেবে। ম্যাচটা ছিল মোহনবাগানের বিরুদ্ধে। হাফ টাইমে মাঠে উপস্থিত শান্তদা। আমি একটু অভিযোগের সুরেই বললাম, ‘‌কী রেফারিং হচ্ছে, দেখছেন?‌’‌ শান্তদা ধমকে বললেন, রেফারিং নিয়ে কোনওদিনও আমার কাছে অভিযোগ করবে না।’‌ ম্যাচটা ২–‌২ গোলে অমীমাংসিতভাবে শেষ হয়। পরেরদিন শান্তদাকে বলি, ‘‌আমার একটা রেকর্ড আছে। ছোট বড় যে ক্লাবের হয়েই ডাগ আউটে থেকেছি মোহনবাগানের বিরুদ্ধে, মোহনবাগান সেই ম্যাচে জেতেনি।’‌ আলতো হেসে পিঠ চাপড়ে দিয়েছিলেন। আসলে ইস্টবেঙ্গল অন্ত প্রাণ ছিলেন। শান্তদার বহু স্মৃতি আছে। আজ বড় নিষ্ঠুর নির্মম হচ্ছে তারা। শতচ্ছিন্ন করে দিয়ে যাচ্ছে মনকে। আবার এমনটাও মনে হচ্ছে, মাথায় আশ্বাসের হাত বুলিয়ে শান্তদা বলছেন, দুঃখ কী রে আছি তো। দেখবি, আসব যাব চিরদিনের সেই আমি।

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.