অণু গল্প ১।
(পশু পূজারী)
জুয়েল মিয়াজী
বড় গিন্নি ছেলেকে বারবার কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করে। কিন্তু ছেলে কান্না থামিয়ে কথা বলার প্রয়োজনবোধ করে না। অবিরত কেঁদেই যাচ্ছে সে। জমিদার পুত্র ফটিকচরণ কান্নার রহস্য না উন্মোচন করলেও মা কিন্তু ঠিকই পুত্রের কান্নার কারণ বুঝে নিয়েছেন।
নিশ্চয় পাশে দাঁড়ানো বাড়ির চাকরানীর ছোট্ট দুষ্টু মেয়ে ফটিকের গায়ে হাত তুলেছে। তাই গিন্নি রাগে ঘৃণায় ধপাশ ধপাশ করে কয়েকটা কিল বসিয়ে দেয় মিলুর পিঠে।
এতক্ষণ কোনও কথা না বললেও, এবার মিলুকে মারতে দেখে ফটিকচরণের মুখে বুলি ফুটে, কান্নার স্বরেই বলতে লাগলো, মা মা মিলুকে মেরো না, ও আমাকে মারেনি।
পায়ে বিড়ালে কামড় দিয়েছে! সত্যিই তো, মা দেখলেন ছেলের পা থেকে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। যে মা ছেলেকে মারার বিনা অপরাধে নিরীহ ছোট্ট মেয়েটির পিঠ গরম করতে পারে। সে মা চাইলেই অপরাধী বিড়ালের পরকালের টিকেট কেটে দিতে পারতেন। বিড়ালটি পাশেই ছিল। কিন্তু তা তিনি করলেন না। কারণ এই তল্লাটের জমিদারদের একটা সুখ্যতি আছে, তারা নিরীহ পশুর গায়ে হাত তোলেন না।
অণু গল্প ২
(ব্যবহার)
জুয়েল মিয়াজী
…..
অফিসের প্রথম শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে আমাদের সম্মান ছিল অনেকের চেয়ে বেশি । কিন্তু কেন জানি না, আমাদের সহকর্মী মোতালেব সাহেবের মনে হত যে জুনিয়র কিংবা নিম্নশ্রেণির কর্মচারীরা তাঁকে যথেষ্ট সম্মান করে না। তাই তিনি ভাবলেন যে নিম্নশ্রেণির কর্মচারীদের ভয় দেখানোর জন্য তাদের সাথে অসৌজনমুলক আচরণ করবেন। ফলে তারা ভয়ে মোতালেব সাহেবকে আরও বেশি সম্মান করবে। যে কথা সেই কাজ, সেদিন কী একটা প্রয়োজনে তাঁর অফিস কক্ষে গিয়ে দেখি তিন চার জন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী খুনের আসামীদের মতো ভয়ে কাবু হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। নীরব হয়ে তারা মোতালেব সাহেবের অশ্রাব্য গালিগালাজ শুনছে। তাদের করুণ মুখের দিকে তাকিয়ে আমার কেন জানি মায়া হল খুব। তাই মোতালেব সাহেবের কানের কাছে মুখ নিয়ে বললাম, ভাই ছেড়ে দেন এবারের মত। প্রথমে একটু আমতা আমতা করলেন সাহেব। পরে আমার কথা বিবেচনা করে মোতালেব সাহেব তাদেরকে ক্ষমা করে দিলেন। এরপর ওরা সবাই সালাম দিয়ে চলে যাওয়ার পর, মোতালেব সাহেব আমার দিকে ফিরে বলতে লাগলেন; সাজ্জাদ সাহেব বুঝেন না কেন? এসব ছোটলোকদের ভয় না দেখালে, শাস্তি না দিলে তারা সম্মান করবে না, মনে রাখবে না, ফলে অফিসে আমার বাহাদুরি বাড়বে না। মোতালেব সাহেব যখন কথা বলতেছিলেন তখন আমি খেয়াল করলাম যে তার বামহাতের একটা ক্ষত শুকানো কালো দাগ।
আচ্ছা মোতালেব সাহেব, আপনার হাতে এই কালো দাগটা কীসের? আমার প্রশ্নের জবাবে মোতালেব সাহেব বললেন, এই দাগ কুকুরের কামড়ের। তিনি কুকুরটাকে কিছুই করেনি, শান্ত বালকের মত স্কুলে যাচ্ছিলেন হঠাৎ কুকুরটা তার হাতে একটা কামড় বসিয়ে, দিল তেড়ে মেরে দৌড়, তখন শৈশব ছিল। আমি দুঃখ করে বললাম, আহ! আচ্ছা স্যার আপনাকে যে কুকুরটা কামড় দিয়েছিল সে কুকুরটার কথা আপনার এখনও মনে আছে? মোতালেব সাহেব আমার দিকে বিচক্ষণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ, মনে আছে তো, কুকুরটা লাল রঙের স্বাস্থ্যবান ছিল। এরপর আমি মোতালেব সাহেবকে জিঙ্গেস করলাম, আচ্ছা স্যার আপনি ওই কুকুরটাকে সম্মান করেন? মোতালেব সাহেব হো হো করে হেসে দিয়ে বললেন, কি বলেন সাজ্জাদ সাহেব আবোল তাবোল! কুকুরকে আবার মানুষ সম্মান করে না কি? আমিও হো হো করে হেসে দিয়ে বললাম, ঠিক বলেছেন
মোতালেব সাহেব মানুষ দুষ্টু স্বভাবের কুকুরদের ভয় পায়, মনে রাখে, কিন্তু সম্মান করে না।
***********
অণু গল্প ৩
(না বলা কথা)
জুয়েল মিয়াজী।
চ্যাপ্টাকৃতির নাক, তার উপর ছোট ছোট দুটি নীল চোখ যে মেয়েটির, সে দেখতে অপরূপা না হলেও কুরুপা নয়। সে সত্যবাদী, বিনয়ী, সুমিষ্টভাষী আর তীব্র অভিমানী। প্রতিনিয়ত সৎমায়ের হাতে নিগৃহীত হয় সে। তবুও কোনও দিন এই শোকে কান্না তো দূরের কথা, মন খারাপও করত না সে। এমনটা কেন হয় আমি বারবার জানতে চেয়েছি, কিন্তু মুখ ফোটেনি তার। সৎমা প্রতিনিয়ত তার
উপর পৈশাচিক অত্যাচার করত ঠিকই, কিন্তু পিতার অযাচিত স্নেহের কাছে পাত্তা পায়নি সৎ মায়ের নির্মমতা। সেদিন প্রত্যূষে উল্টো দৃশ্য দেখতে পেলাম। দেখলাম যে মেয়েটি শিউলি গাছের নিচে মন মরা হয়ে বসে ঝিমাচ্ছে। আজ মায়ের উপর রাগ করে বাবা তাকে মেরেছে, কিল মেরেছে পিঠে। তাই উদ্যত অশ্রুকে আড়াল করতে করতে মুখ বিকৃত করে সে কান্নার রব তুলল। আমি উদ্ধিগ্ন হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, পিঠে কি খুব কষ্ট হচ্ছে তোমার? নীলিমা মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়। সত্যিই তার কষ্ট হচ্ছে তবে পিঠে নয়, অন্য কোথাও।
***
জুয়েল মিয়াজী।
ফোকলোর বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল ময়মনসিংহ।
(বেঙ্গল টাইমসের সাহিত্য বিভাগকে আরও সমৃদ্ধ করা হচ্ছে। আপনিও লিখতে পারেন, পাঠাতে পারেন অণু গল্প। লেখা পাঠানোর ঠিকানা: bengaltimes.in@gmail.com)