স্বরূপ গোস্বামী
( ঠিক দুবছর আগে। সেবারও আই লিগ জয়ের মুখে দাঁড়িয়ে মোহনবাগান। বেঙ্গালুরুর সঙ্গে ড্র হলেই চ্যাম্পিয়ন। সেই সকালেই লেখা হয়েছিল সোনির মাকে খোলা চিঠি। আজও লিগ জয়ের সামনে দাঁড়িয়ে লেখাটি এখনও একইরকম প্রাসঙ্গিক। বেঙ্গল টাইমসের সেই পুরনো লেখাটি আবার তুলে ধরা হল। পড়ুন, ভাল লাগবে। )
সোনির মা সমীপেষু,
আপনার নাম জানি না। জানলেও, আমাদের এই বাংলায় মাতৃসমা কাউকে নাম ধরে ডাকার রেওয়াজ নেই। আপনি সোনির মা। আপনি আমাদেরও মা।
মা, আপনি আশীর্বাদ করুন। আমরা যেন আই লিগ জিততে পারি। যদি সত্যিই আশীর্বাদ-অভিশাপ বলে কিছউ থেকে থাকে, তাহলে, অন্তত আজকের দিনে আপনার আশীর্বাদের শক্তি সবথেকে জোরালো। হাজার হাজার বঙ্গজননীর মিলিত আশীর্বাদের যা শক্তি, আপনার একক আশীর্বাদের শক্তি তার থেকে অনেক বেশি।
আপনার ছেলেকে প্রথম দেখেছিলাম গত বছর। সে তখন বাংলাদেশের একটি দলের হয়ে আই এফ এ শিল্ডে খেলতে এসেছিল। উফ, কী অসাধারণ গোলটাই না করেছিল। সেদিনই মনে মনে ভাবতাম, এমন কেউ যদি আমাদের হয়ে খেলত! শুনলাম, কর্তারা নাকি আপনার ছেলেকে আমাদের দলে আনার চেষ্টা করছেন। মনে হল, যাক, এতদিনে একজন ঠিকঠাক বিদেশির সন্ধান পাওয়া গেল। কতটা কর্তাদের চেষ্টায়, আর কতটা আমাদের তখনকার কোচ সুভাষ ভৌমিকের চেষ্টায় জানি না, আপনার সোনি আমাদের ক্লাবে এল।
শুরুতে আমরা ভেবেছিলাম, সব পেশাদার ফুটবলার যেমন টাকার জন্য আসে, সোনি নর্ডিও হয়ত তাই এসেছেন। যেখানে বেশি টাকা, সেখানে যাও, আবেগ-টাবেগ সব গুলি মারো। এটাই তো পেশাদারি দুনিয়ার নিয়ম। আমরা আপনার ছেলেকেও এই নিয়মের ব্যতিক্রম ভাবিনি। ভুলটা ভাঙল গত সপ্তাহে। জানলাম, আপনিই নাকি আপনার ছেলেকে জোর করেছিলেন, ভারতে খেললে সে যেন মোহনবাগানেই খেলে।
অথচ, আপনার দেশকে আমরা কতটুকুই বা চিনি! আমরা জানতাম, হাইতি নামে দেশটা ভূমিকম্পপ্রবণ। ছোট্ট একটা দেশ, আমাদের বাংলার থেকেও অনেক ছোট। উত্তরবঙ্গের সাত জেলা মিলিয়ে যা হয়, তার থেকেও কম। পাহাড় আর অরণ্যে ঘেরা দেশটার লোকসংখ্যা এক কোটিরও কম। আপনার দেশ একসময় স্পেনের, পরে ফ্রান্সের উপনিবেশ ছিল। কিন্তু তা কাটিয়ে স্বাধীনতা পেয়েছেন আমাদেরও প্রায় দেড়শো বছর আগে। ছোট্ট একটা দেশ, কিন্তু স্বাধীনতা পাওয়া প্রথম ক্যারিবিয়ান দেশ। বিশ্বাস করুন, আপনার ছেলে আসার আগে আমরা হাইতি সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানতাম না।
কিন্তু, সুদূর লাতিন আমেরিকায় বসে ইন্টারনেটে আপনি খোঁজ রেখেছিলেন মোহনবাগানের। ১৯১১-র সেই খালি পায়ে খেলে ব্রিটিশদের হারানো, ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধকে একধাপ এগিয়ে দেওয়া, এসব কাহিনী পড়ে আপনি রোমাঞ্চিত হয়েছিলেন। ছেলেকে বলেছিলেন, টাকা পয়সার কথা ভুলে যাও, এমন ক্লাব থেকে ডাক পাচ্ছো, এটাই বড় সম্মান। চোখ বুজে এখানেই সই করো।
আমাদের এই ক্লাবে অনেক বাঙালি ফুটবলার ছিলেন, আছেন। অনেক অবাঙালি ফুটবলারও আছেন। কজনের মা তাঁকে এভাবে মোহনবাগানে খেলতে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন, জানা নেই। জানেন মা, আপনার সোনি একটু একটু করে আমাদের সোনি হয়ে উঠল। আমাদের এই ক্লাবে ব্যারেটো নামে একজন ফুটবলার এসেছিল। ভায়-মন্দ মিলিয়ে তাঁর জীবনের অনেকগুলো বসন্ত কেটেছিল এই বাগানে। সেও আমাদের ক্লাবের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিল। আমরাও তাকে বড় বেশি ভালবেসে ফেলেছিলাম। তার অভিমান হলে আমাদের চোখের কোনও ভিজে গেছে বহুবার। জানেন মা, অবসর নেওয়ার পরেও সে দেশে ফিরে যায়নি। মনে মনে সে এখনও মোহনবাগানী। কোনও একদিন হয়ত আমাদের ক্লাবের কোচও হতে পারে। সে কত বড় কোচ, জানি না। সাফল্য আসবে কিনা, তাও জানি না। তবে বাগান জনতা যে সেদিন তাকে বুক দিয়ে বরণ করবে, এটুকু জানি।
আপনার ছেলের কথাতেই ফিরি। আপনার ছেলের মধ্যেও আমরা সেই ব্যারেটোকেই খুঁজে পাচ্ছি। সেই নিষ্ঠা, সেই দায়বদ্ধতা, সেই নিজেকে উজাড় করে দেওয়া, সবার সঙ্গে সুন্দরভাবে মিশে যাওয়া। ছোট্ট ছোট্ট পায়ে আপনার ছেলে আমাদের আই লিগের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়েছে। আর একটা ম্যাচ। জিতলে বা ড্র করলেই আবার আমরা ভারত-সেরা হব।
যে গুলো বলছি, তার কোনওকিছুই হয়ত আপনার অজানা নয়। শুনেছি, মোহনবাগানের খেলা থাকলে আপনার চোখ থাকে ইন্টারনেটে। লাইভ আপডেট পৌঁছে যায় আপনার কাছে। ছেলে হয়ত ফোন করে গোল করার খবর দিল। ওপার থেকে আপনি বললেন, ‘সেকেন্ড হাফে ওই সহজ গোলটা মিস করলি কেন ? বাঁ দিকের ছেলেটা তো ভাল জায়গায় ছিল, ওকে পাস বাড়ালেই তো পারতিস।’ তিরস্কার নয়, একাত্মতা, যা বারবার উঠে আসে সোনির কথায়। এই সোনিকে আমরাও যে বড় ভালবেসে ফেলেছি। আজ যদি মোহনবাগান জিতে যায়, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন, এবার ধুতি পাঞ্জাবি পরিয়ে তাকে দিয়ে পুজো উদ্বোধন করানো হবে।
গত সপ্তাহে ম্যাচ জেতার পরই সোনি বলল, ‘শেষ ম্যাচে মা-কে নিয়ে আসব। বেঙ্গালুরুর গ্যালারিতে আমার মাও থাকবে।’ সেদিন থেকে আপনার ছেলেকে আরও বেশি করে ভালবাসতে শুরু করলাম। কই, আমাদের বাঙালি ফুটবলাররা তো মাকে নিয়ে যাওয়ার কথা ভাবেনি। বেঙ্গালুরু তো ছেড়ে দিন, যুবভারতীতেই বা মা-বাবাকে নিয়ে কজন এসেছে ? অতীতের ফুটবলাররাও মা, বাবা বা স্ত্রীকে কোনওদিন মাঠে আনতেন না, পাছে সাপোর্টারদের গালাগাল শুনতে হয়।
কিন্তু আপনার ছেলে বুঝিয়ে দিল, সে কতটা আলাদা। শুনেছি, আপনি নিজেই নাকি আসতে চেয়েছিলেন। মা, সেদিন আপনার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। শুনেছি, গতবছর সোনি বাংলাদেশে খেলার সময় নাকি আপনাকে ঢাকায় নিয়ে এসেছিল। আমাদের সবার ঘরে যদি এমন মা থাকত! খুব আশায় ছিলাম, আপনি এলে বিমানবন্দরে আপনাকে অন্তত একবার দেখতে যাব। সম্ভব হলে, একবার প্রণাম করে আসব। কিন্তু পরে শুনলাম, ভিসা সমস্যার জন্য আপনার আসা হচ্ছে না। একটু কষ্ট হয়ত পেলাম। কিন্তু মনে হল, আপনি তো আমাদের সঙ্গেই আছেন।
জানেন, এই শহর থেকে কাতারে কাতারে মানুষ ছুটছে বেঙ্গালুরুতে। কেউ তিনদিন আগেই ট্রেনে উঠেছে। অনেকে পৌঁছে গেছে। অনেকে সকালে বিমান ধরবে। আজ, এই ছুটির দিনে কলকাতা তাকিয়ে থাকবে বেঙ্গালুরুর দিকে। মা, আমরা জানি, আপনার চোখও আজ থাকবে বেঙ্গালুরুতে। যদি লিগ ঘরে আসে, আপনার খুশির পরিমাণটা আমাদের থেকে কোনও অংশে কম হবে না। আমি যদি মোহনবাগানের সভাপতি হতাম, বিজয়োৎসবের পতাকা তোলার জন্য আপনাকে উড়িয়ে আনতাম হাইতি থেকে।
মা, আশীর্বাদ করুন, আপনার মোহনবাগান, আমাদের মোহনবাগান যেন জিততে পারে। আগেই লিখেছি, হাজার বঙ্গজননীর আশীর্বাদের চেয়েও আজ আপনার আশীর্বাদ অনেক বেশি মূল্যবান।।



