অম্লান রায়চৌধুরী
অমল কান্তি নীরেন চক্রবর্তীর কবিতায় রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। আমার গল্পে আজকের অমল কান্তি ওরফে কমল কান্তি রোদ্দুরের ঘ্রান নিতে চেয়েছিল খালি । চনমনে ঠান্ডায়, কিংবা কিছুক্ষণ এসি ঘরে কাটিয়ে– যেমন রোদ্দুরের প্রয়োজন হয় তেমনই। আসলে আমরা বড় প্রয়োজন ভিত্তিক জীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছি । এই দরকার, তো হাজির যান, হাজির, ওলা/উবের। এই দরকার মসলা পাতি– হাজির মোবাইল ফোন – অপেক্ষা কয়েক মিনিটের মাত্র। এই যে চাইলেই পাওয়া যেটা আজকের অমলদের স্বভাবের মধ্যেই পড়ে। তৈরিও হয়েছে– এখানে । যেখানে এখনও অনেক মানুষের প্রয়োজনের গন্ডিটা এতটাই বাঁধা যে– সকালবেলায় উঠে নিজের প্রয়োজনটাকে ঠিক করতে হয়, যদি কাজ জোটে তো ডিমভাত, নয়ত পাড়ার পুকুরের কলমী সেদ্ধ আর ভাত। এরা সংখ্যায় সেই আমার বাবার আমলে যা দেখেছিলাম – তার থেকে বেড়েছে ছাড়া কমেনি।
প্রয়োজনীয় হলেই কল্কে পাবে নচেত নয়– এই ধারনায় প্রয়োজনীয়র পরিধিটা বাড়তে বাড়তে ঠেকেছে গিয়ে – মধ্যবিত্ত্ব ছেলের সদ্য চাকরি পাওয়া অবস্থায় ইএমআই এর হিসাব করে গাড়ি কেনে। কারণ গাড়ি আর লাক্সারি নয়, প্রয়োজনীয়। যেমন অতি প্রয়োজনীয় বলে কিছু নেই- সবই কেমন যেন না হলেই নয় । ঘোষ বাবুর বৌ তো বলেই বসল– মাইক্রো ওভেন ছাড়া চলে কি করে । রাত বিরেতে লোক এলে কী হবে। একে শীত তাতে আবার গ্যাস জ্বালিয়ে রান্না। পোশাবে না। মনে পড়ে, আমার পিসেমশাই প্রায়শই রাত এগারোটার পরে বাড়ি ফিরতেন যখন পিসি আমাদের বাড়িতে থাকতেন । মা জেগে বসে থাকত , উনুনে নিভু আঁচ জাগিয়ে রেখে। এলে পরে, গরম করে দেওয়া হবে সব খাবার, গরম জল করে দেওয়া হবে হাত মুখ ধোওয়ার জন্য। এটা বাস্তব- দেখা। আজকের এই নানান উপকরনে এই কষ্টটা করবে কেন। মানছি এর আজ আর প্রয়োজন নেই । এটাও মানছি এরই সাথে আমরা বোধ হয় সেই সময়কার বোধগুলোকেও হারিয়ে ফেলেছি বা যন্ত্রের সাথে সখ্যতা পাতিয়ে যান্ত্রিক বোধ বানিয়ে ফেলেছি ।
শুনেছি জানতে জানতে নাকি প্রয়োজন বাড়ে। আমি একবার কিছু দিনের জন্য আফ্রিকাতে গেছিলাম। একেবারে গ্রামের ভিতরে যেখানে ওরা কেউই মোবাইল চেনে না, রেডিও শোনেনি কখনও। ওদের কাছে যান বাহন বলতে কেবল সাইকেল, গাড়ির আসা যাওয়া দেখছে বটে কিন্তু– এখনও গুরুত্ব বা নিজের কাছে প্রয়জনীয় হয়ে উঠতে পারেনি। কাজেই ওদের চাহিদা খুবই কম। সন্তুষ্টির মাত্রাটা এতটাই কম যে চা বাগানের কাজের জন্য গাড়ি পাঠালেও ওরা কাজে আসতে চায় না। ওরা মনে করে এভাবেই চলবে। এতদিন চলল আগামীটাও চলবে। আমাদের পূর্বপুরুষেরা এইভাবেই ভাবত। বিশেষজ্ঞরা বলবে অনুন্নত শ্রেনীর এটাই সমস্যা। পরিবর্তন মানতে চায় না ।
কিন্তু আমার অমল কান্তি এখন সব জানে , সারা পৃথিবীর খবর হাতের মুঠোয় । সেই নিয়ে কি সন্তুষ্টি , যেন সব জানা হয়ে গেছে। হ্যাঁ সুযোগ গুলোর ও সদব্যবহার করে । সব কিছুই তৈরি পায় — তৈরি করতে হয় না ।
নীরেনবাবুর অমল কান্তি কিন্তু রোদ্দুরকে ওর মতন করে দেখেনি বলেই রোদ্দুর হতে চেয়েছিল। রোদ্দুরের স্বচ্ছতা, তেজ , বিনাশের ক্ষমতা– ওকে মুগ্ধ করত। ও ভেবেছিল রোদ্দুরের ওই স্বভাবটাকে আটকে রাখবে ওর মধ্যে, দেখবে পারে কিনা ধীরে ধীরে রোদ্দুর হয়ে উঠতে । পারেনি, নীরেন বাবু ওকে সেই স্বাধীনতা দেননি, কারন পরিবেশ বা পরিস্থিতি কোনোটাই সেদিন ওর সাথে ছিলোনা । ভেবেছিলাম হয়ত সম্ভবও ছিলোনা ।
আমার কমল কিন্তু, সব লাভ করতে পারবে । পরিস্থিতি পাল্টে গেছে, পরিবেশ সহযোগী হয়েছে। এরা খোলস দিচ্ছে বিনি পয়সায়। নানান মাপের নানান মানের । আমার কমলরা ওগুলো কিনছে , ক্যাপসুলের মতন । ভিতরের ওষুধটার স্বাদ জানা নেই, তাই মিষ্টি দিয়ে মুড়ে বানানো । খুব চলছে এই ক্যাপসুলের মতন খোলস গুলো আজকাল । এখানে লক্ষ্যটা পাওয়া হয়ে যায়, প্রথম যেদিন লক্ষ্য স্থির হয় সেদিন-ই। কমলেরও হয়েছিল সেই দিনই যেদিন ও চেয়েছিল, অনেক টাকা, অনেক সুখ , অনেক আনন্দ। আসলে লক্ষ স্থির করা আর লক্ষ্যতে পৌঁছানর রাস্তাটাকে বেশ রঙ্গীন করা হয়েছে আজকাল। আকর্ষিতও তাই।
এটা বোধ হয় মেনে নেই এখন , নীরেন বাবুর কালের শেষ হয়েছে । অন্তত আমাদের কাছে যারা নীরেন বাবুর লেখা পড়তে ভালবাসি । কিন্তু ভেবে দেখার ফুরসত বোধ হয় হয়নি যে, ওই সেদিনকার নীরেন বাবুর কাল– ও সেই কালের সেই অমলরা গেল কোথায়– পাল্টে গেল, নাকি একটা শূন্যস্থান সৃষ্টি করল । নাড়াচাড়া দিলে দেখা যায় , নীরেন বাবুর দেখা কাল আজও বর্তমান। পাল্টেও যায়নি, ওরকমই আছে — কিছু মাজা ঘষা হয়েছে– দেখতে চাকচিক্য এসেছে, অমলকান্তির মতন অন্ধকার, স্যাঁতসেতে ছাপাখানার কুঠুরিতে জীবন কাটাতে হচ্ছেনা ঠিকই, কিন্তু অন্ধ কূপের গন্ধ পাওয়ার কালটা এখনো আছে । এখনো রোজ না খেতে পাওয়ার ব্যাথাটা বোঝে অনেক মানুষ , এখনো সাধারন ইচ্ছার মৃত্যু হয় প্রতিনিয়ত, এখনও অনেকেরই না পাওয়ার ক্ষোভ জন্মায় না- শুধু মাত্র চাইতে শেখে না বলে। এরা কারা, গেল কোথায়, কেন দেখিনা এদেরকে সমাজের মাঝমাঠে– কারণ এরাই সমাজের সেই ক্ষতর চিহ্ন- এদের প্রকাশেও শিকল, স্তোত বাক্যের আড়ালে । এরা তাই আজও আশ্বাসের ঝান্ডাকে মান্যতা দেয়- উপায়হীনতায়। আমরা কিন্তু বেশ আছি ।