তিনি ছিলেন কিংবদন্তি সাংবাদিক। একইসঙ্গে সুচিত্রা সেনের বন্ধু। তিন বছর আগে সুচিত্রা বিদায় নিয়েছেন। তিনিও বিদায় নিলেন গত বছর। কীভাবে আলাপ? তিন বছর আগে সেই স্মৃতিই মেলে ধরেছিলেন বর্ষীয়াণ সাংবাদিক অমিতাভ চৌধুরি।
জীবনের পশ্চিম সীমান্তে এসে গেছি। এই বয়সে এসে অনেক স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসে। আমারও ঘটনাবহুল জীবনের সবকিছু হুবহু মনে আছে, এমন দাবি করছি না। সময়ের স্রোতে অনেক স্মৃতি হারিয়ে গেছে। কিন্তু কিছু স্মৃতি থাকে, যা চাইলেও ভোলা যায় না। টুকরো টুকরো কত ঘটনা, তার কত অভিঘাত। যখন ঘটেছিল, তখন হয়ত সেভাবে রেখাপাত করেনি। এখন, এই পরিণত বয়সে এসে সেগুলো অন্য অনুভূতি তৈরি করে। আবার উল্টো উদাহরণও আছে। তখন হয়ত কোনও একটি ঘটনাকে বিরাট গুরুতর মনে হয়েছিল, এজ সেগুলো মনেও পড়ে না।
দীর্ঘ জীবনে অনেক গুণী মানুষের সাহচর্য পেয়েছি। খুব কাছ থেকে তাদের দেখারও সুযোগ পেয়েছি। খাসখবর পত্রিকার অনুরোধে আমার তেমনই এক বিশেষ বন্ধুকে নিয়ে স্মৃতিচারণ। শুরুতেই কয়েকটা কথা অকপটে বলে রাখা দরকার। আমার সেই বন্ধুকে নিয়ে আমি আগেও নানা জায়গায় লিখেছি। তাই যাঁরা আগের সেই লেখাগুলো পড়েছেন, তাঁরা ঘটনাগুলো জানেন। তাদের মনে হতে পারে পুনরাবৃত্তি। তবে এমন সুন্দরী নায়িকাকে নিয়ে এক কথা বারবার বলাটা দোষের কিছু নয়। তাছাড়া, নতুন নতুন কথা তো আর আবিষ্কার করতে পারব না। অতিরঞ্জন করতেও পারব না। বানিয়ে বলতেও পারব না। যা ঘটেছিল, তাই বলব। কথায় কথায় ব্যাখ্যা দেওয়া আমার কাজ নয়। এভাবে অনেকে লেখার কলেবর বাড়ান। আমার আবার এই অভ্যেসটাও নেই। তাই যা ঘটেছিল, শুধু তাই তুলে ধরব। অনেককিছু হয়ত ভুলে গেছি। তাই কিছু ঘটনা বাদও পড়ে যাবে।
আমার সেই বন্ধু কে? আর ভনিতা করে লাভ নেই। তাঁর নামটা বলেই ফেলা যাক। সুচিত্রা সেন। হ্যাঁ, এই সুচিত্রা সেন আমার বন্ধু। তাঁকে বন্ধু ভাবতে বেশ গর্বই হয়। আমরা প্রায় সমবয়সী। একে অন্যকে তুমি বলেই সম্বোধন করি। দুজনেই দুজনকে বিশ্বাস করি। দুজনে দুজনের সঙ্গে খুনসুটিও করি। গত তিন দশক সে লোক চক্ষুর আড়ালে। কিন্তু আমার মাঝে মাঝেই সৌভাগ্য হয় তার সঙ্গে কথা বলার। সে মাঝে মাঝেই আমার বাড়িতে হানা দেয়। বলে আজ খেয়ে যাব। মাঝে মাঝে আমারও ডাক পড়ে তার বাড়িতে। নিজের আনন্দের কথা বলে, যন্ত্রনার কথাও বলে। এখানে কোনও অভিনয় নেই। দুই বন্ধুর প্রাণখোলা আড্ডা। সেসব কথা উঠে আসবে এই স্মৃতিচারণে।
নিশ্চয় অনেকদিনের আলাপ!
একেবারেই না। ওর খুব বেশি ছবি দেখেছি, এমনও নয়। ও যতদিন অভিনয় করে গেছে, আমি শুধুমাত্র সাড়ে চুয়াত্তর ছবিটা দেখেছিলাম। আর কোনও ছবিই দেখিনি। আলাপ হওয়ার পরে অবশ্য কয়েকটি ছবি দেখেছি। কীভাবে আলাপ হল, সেটা বরং বলা যাক। না, কোনও অনুষ্ঠানে আলাপ নয়। আলাপটা হয়েছিল ঝগড়া দিয়ে। সেটাও উত্তম কুমারের মৃত্যুর দিনে।
আমি তখন যুগান্তরে। মাঝরাতে মারা গেলেন উত্তম কুমার। সকাল থেকেই ছুটে বেড়াচ্ছে রিপোর্টাররা। এমন দিনে বাঙালি পাঠক সবার আগে কার প্রতিক্রিয়া জানতে চায়? হ্যাঁ, ঠিক ধরেছেন, সুচিত্রা সেন। সন্ধে নাগাদ আমিও আমার কাগজের একজন রিপোর্টারকে পাঠালাম সুচিত্রা সেনের বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পরেও সে সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করতে পারেনি। সুচিত্রা বাড়িতেই ছিলেন। কিন্তু দেখা করেননি। আমার সেই রিপোর্টার আর কোনও আশা না দেখে অফিসে ফিরে এল।
তার কাছে শোনার পর তাকেই বকাঝকা করলাম। খবরের কাগজে এমনটা হয়েই থাকে। তাকে বললাম, কাল কাগজ খুলেই মানুষ জানতে চাইবে সুচিত্রা সেন কী বলেছেন। তাদের সেই চাহিদাও তুমি পুরণ করতে পারলে না। এমন একটা অ্যাসাইনমেন্ট পেয়েও তুমি সুচিত্রার সঙ্গে দেখা করতেই পারলে না। তখন জানতে চাইলাম, আনন্দবাজার ইন্টারভিউ পেয়েছে কিনা। শুনলাম, আনন্দবাজারের সেবাব্রত গুপ্তর সঙ্গে নাকি সুচিত্রা কথা বলেছে। তখন রাগ আরও বেড়ে গেল। ও পারল, আর তুমি পারলে না! কী আর করা যাবে? রেগেমেগে নিজেই ফোন করে বসলাম সুচিত্রার বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডের বাড়িতে। অনেকক্ষণ টেলিফোন বাজার পর কে একজন ধরলেন। বললেন, উনি কথা বলতে পারবেন না। তখন আমি তাঁকে শুনিয়ে দিলাম, ‘কথা বলবেন না মানে? একটু আগে উনি আনন্দবাজারের সঙ্গে বাড়িতে বসে কথা বলেছেন। তাহলে, আমাদের সঙ্গে এমন ন্যাকামি করছেন কেন?’ হ্যাঁ, সেদিন রাগের মাথায় ন্যাকামি শব্দটাই প্রয়োগ করেছিলাম। নিজের পরিচয় দিয়ে বললাম, ঠিক আছে, আমি এগুলোই কাগজে লিখব। বলেই ফোনটা রেখে দিলাম।
ঠিক আধঘণ্টা পরে একটা ফোন এল। এক মহিলা কণ্ঠস্বর। নিজের পরিচয় দিয়ে তিনি দুঃখপ্রকাশ করলেন। বললেন, আমার ভুল হয়ে গেছে। স্বয়ং সুচিত্রা সেন ফোন করেছেন! তখনও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না। কিন্তু আমার তো সেই রাতেই প্রতিক্রিয়া দরকার। নিজেই চটপট করে কয়েকটা প্রশ্ন করলাম। উনি একের পর এক উত্তর দিয়ে গেলেন। সেটাই পরেরদিনের কাগজে ছাপা হল। সেই থেকে বন্ধুত্বের সূচনা। একদিন ওঁর বাড়িতে ডাকলেন। গেলাম। খাওয়া দাওয়া হল। এ কথা–সে কথার পর সম্পর্কটা আরও গাঢ় হতে লাগল। কখনও সকালে যাচ্ছি, কখনও দুপুরে, আবার কখনও সন্ধ্যায়। আপনি থেকে তুমি তে নেমে আসতে খুব একটা দেরি হল না। সুচিত্রা থেকে আমার কাছে সে হয়ে উঠল রমা। হ্যাঁ, ইন্ডাস্ট্রি ওকে যে নামেই ডাকুক, আমি ওকে রমা বলেই ডাকি। আমি একদিন মজা করে বললাম, ‘রমা আমার’। সে কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে বলল, কী বলছ? আমি বললাম, ‘রমা আমার’ এই কথাটাকে উল্টে দাও। দেখবে মানেটা একই থাকবে। আসলে, আমি তোমাকে সামনে পেছনে সমানভাবে দেখি, তাই। এভাবেই শুরু হল নতুন বন্ধুত্ব। আজ, এত বছর পরেও আমরা বন্ধু। যে বন্ধুত্বে আজও চিড় ধরেনি।
(তিন বছর আগের এক স্মৃতিচারণ। সেখান থেকেই হয়েছিল অনুলিখন। ছাপা হয়েছিল একটি পত্রিকায়। সেই পত্রিকাগোষ্ঠীর অনুমতি নিয়ে পাঠকদের স্বার্থে পুনরায় তা প্রকাশ করা হল বেঙ্গল টাইমসে। )