রবি কর
বাংলার মানুষ, বিশেষ করে যারা নিজেদের বুদ্ধিজীবী, সংস্কৃতিপ্রেমী বলে দাবি করেন, তারা যে কতটা ক্লীব তার প্রমান দিচ্ছে নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বর। এত লোকের যাতায়াত সত্ত্বেও বঙ্গলক্ষ্মীর এতবড় অপমান কারও চোখে পড়ছে না? দেখেও সবাই না দেখার ভান করছে? কেউ প্রতিবাদে গর্জে উঠছে না?
কিছুদিন আগেই নন্দন চত্বরে ফিল্ম ফেস্টিভ্যাল হয়ে গেল। দেশবিদেশের অতিথি, টলিউড-টেলিউড, সাংবাদিক, দর্শক, প্রেমিক ছোঁড়া, পেটুক ছুঁড়ি সবাই ওই চত্বরে ভিড় করল। তারপর কাছেই অ্যাকাডেমি। কত লোক নাটক দেখতে আসে, এগজিবিশন দেখতে আসে। আমি অবশ্য সিনেমা নাটক কিছুই দেখি না। অফিস যাওয়ার সময় নন্দন চত্বর দিয়ে গেলে শর্টকাট হয়, তাই ভিতরে ঢুকি। সেই সামান্য যাতায়াতেই যে ব্যাপারটা আমার চোখে পড়ছে তা আঁতেলদের চোখে পড়ছে না কেন?
ওই চত্বরে সব ভবনের সামনে একটা করে বিশাল ফলক বসানো হয়েছে। কোনও কোনও ভবনের সামনে একাধিক ফলক বসানো
হয়েছে। তাতে লেখা “নবরূপে সজ্জিত নন্দন-রবীন্দ্রসদন চত্বরের উদ্বোধন করলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।“
নন্দনের সামনে লেখা “নবরূপে সজ্জিত নন্দন প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন করলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।“
নবরূপে শব্দটা ছোট করে লেখা। যার চোখে পাওয়ার কম সে সহজে দেখতেই পাবে না। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আর উদ্বোধন শব্দটা এত বড় করে লেখা যে কানা লোকেও দেখতে পাবে। যদিও নীল সাদা রঙ, টুনি বাল্ব আর ফুটপাথে টাইলস ছাড়া নবরূপটা কোথায় তা চোখে পড়ে না।
এই রবীন্দ্র সদনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপ্ন করেছিলেন জহরলাল নেহরু। নন্দনের উদ্বোধন করেছিলেন সত্যজিৎ রায়। জ্যোতি
বসুর আমলে। নন্দন ছিল বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের চারণভূমি। কিন্তু নবরূপের গুঁতোয় তাঁদের নাম নিশান হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। তাঁদের ফলক কোথায় কে জানে। যে জানে না সে ভাববে, এসবই দিদির কীর্তি। শুধু কি নন্দন, রবীন্দ্রসদন? কবিতা অ্যাকাডেমি, শিশির মঞ্চ, গগনেন্দ্র প্রদর্শশালা, কলকাতা তথ্যকেন্দ্র সবই নবরূপে তাঁর উদ্বোধন।
হয়তো ভাবছেন, এই সব ফলক দেখে আমি ক্ষুব্ধ। হয়তো ভাবছেন আর পাঁচজন হিংসুটে বাঙালির মতো আমি দিদির বিরুদ্ধে হাওয়া গরম করতে চাইছি। কিন্তু না। যিনি এমন সুন্দর কবিতা লেখেন, কবিতা অ্যাকাডেমির সামনে তাঁর নাম থাকবে না তো কার নাম থাকবে? যিনি এমন সুন্দর ছবি আঁকেন, গগনেন্দ্র প্রদর্শশালায় তাঁর নাম থাকবে না তো কার নাম থাকবে? কলকাতার সব মিডিয়া যার দাসানুদাস তথ্যকেন্দ্রে তাঁর নাম থাকবে না তো কার নাম থাকবে?
আমি মনে করি, এই ফলক বসানর ফলে মরা নেহরু, সত্যজিৎ, জ্যোতি বসুর মতো ফুল মরা আর বুদ্ধর মতো আধমরা লোকদের উচিত শিক্ষা হয়েছে। কে নেহরু? কে সত্যজিৎ? কবে কী করেছেন তাই নিয়ে ঘি খেলে হবে? যিনি এত যত্নে নীল সাদা রঙ করলেন, টুনি বাল্ব লাগালেন তিনিই তো আসল। সব থেকে টাইট হয়েছে ব্যাটা বুদ্ধ। আর জিন্দেগিতে এ তল্লাটে ঢুকতে পারবে না। ঢুকলেই যেদিকে তাকাবে দিদির নাম। অমনি ব্যাটার হাপানির টান বেড়ে যাবে। যদি পটকে যায় আর রবীন্দ্র সদনে
বডিটা রাখা হয়, যা মজা হবে না! শেষ শয্যায় শুয়ে শুয়ে ব্যাটা দেখবে মমতার নাম। ভালো হয় যদি দিদি কেওড়াতলা আর নিমতলায় নিজের নামের ফলক লাগিয়ে দেয়।
কিন্তু এইসব উচিত কাজের মধ্যেও আমার মনে আগুন জ্বলছে। জ্বলছে বুদ্ধিজীবীদের প্রতি। নন্দন চত্বরে একাধিক পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেট। দিদির জমানায় সেগুলোতেও নতুন টাইলস বসেছে। অর্থাৎ নবরূপ দেওয়া হয়েছে। প্রতিদিন শতশত বুদ্ধিজীবী সেখানে যাচ্ছে, হিসি করছে। কারোর মনে হচ্ছে না টয়লেটগুলোর সামনে ফলক লাগানো উচিত। বলা উচিত, “নবরূপে সজ্জিত পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেটের উদ্বোধন করলেন মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়।“
উচিত অবশ্যই উচিত। যদি কারও মনে এব্যাপারে সন্দেহ থাকে তাহলে, গড়িয়াহাট ফ্লাইওভারের তলায় ঘুরে আসুন। সেখানকার পে অ্যান্ড ইউজ টয়লেটটা কার উদ্বোধন করা দেখে আসুন।