রবি কর
বেঙ্গল টাইমসের এডিটর যা প্যাঁচে পড়েছে না! প্যাঁচ কাটানোর জন্য কাউকে না পেয়ে আমাকেই ডেকে পাঠিয়েছে।
প্রথম থেকে বলি শুনুন। আপনারা তো জানেন, আমাদের এডিটর একটি বুদ্ধির ঢেঁকি। ওদিকে আবার শ্বশুরবাড়িতে বলে বেড়িয়েছে, তিনি নাকি একজন বুদ্ধিজীবী। বুদ্ধিজীবীরা যখন মিছিল টিছিল করে, তখন এডিটরও সেই মিছিলে হাঁটে। মিডিয়া তো ছবি তোলে না, তাই নিজেই নিজের ছবি তুলে, শালা-শালীদের দেখায়, “এই দ্যাখ আমিও বুদ্ধিজীবী।”
কিন্তু এই বলে বেড়ানোটাই কাল হয়েছে। পশ্চিমবঙ্গের নামবদল নিয়ে এত ডামাডোল। একেক বুদ্ধিজীবী একেক মত দিচ্ছে, এডিটরের শ্বশুরবাড়িতে সবাই বলছে, কি জামাইয়ের মতামত তো জানা যাচ্ছে না। এখন এডিটর কী করবে?
যেমন তেমন মতামত দিলে হবে না। শ্বশুরবাড়িতে প্রেস্টিজ বলে কথা। এমন একটা মতামত দিতে হবে, যা কেউ দেয়নি। মনস্থির করতে না পারে এডিটর আমাকে বাড়িতে ডেকে পাঠাল পরামর্শ করতে।
এডিটরের বাড়িতে দুজনে অনেকক্ষণ আলোচনা হল। দিদি যখন বলেছেন তখন নাম বদল হবেই। বদলা নয় বদল চাই। অন্য কিছু যখন বদলাল না তখন নামটাই বদলাক। প্রশ্ন হল নতুন নাম কী হবে?
আমিঃ পশ্চিম বাদ দিয়ে শুধু বঙ্গ বললে ল্যাটা মিটে যায়।
এডিটরঃ কিন্তু ইংরেজি বানানটা নিয়েই সমস্যা। BANGA লিখলে লোকে ‘ব্যাঙা’ পড়তে পারে। BANK উচ্চারণ যদি ব্যাঙ্ক হয়, BANG যদি ব্যাং হয়, BANGA উচ্চারণ তাহলে ‘ব্যাঙা’ হওয়া উচিত। BANGO লিখলে আরেক সমস্যা সবাই ভাববে ব্যঙ্গ। তাছাড়া অনেকে বলছে, বঙ্গ নামে একটা বাদ্য যন্ত্র আছে। তাই বাঙলা হলেই ভালো।
আমিঃ ‘বঙ্গ’ মানে যদি বাদ্য যন্ত্র হয়, ‘বাঙলা’ তাহলে একরকমের মদ। মদের নামে রাজ্যের নাম রাখতে চান ? “মদের গরব মদের আশা” লোকে এই গানটা গাইবে?
এডিটরঃ বাংলাও হল না, বঙ্গও হল না। তাহলে শ্বশুরবাড়িতে কী বলব? একটা আইডিয়া এসেছে। দিদি তো বলেছেন, বাংলায় বঙ্গ আর ইংরিজিতে বেঙ্গল দুটো নামই থাকবে। আমি বরং প্রস্তাব দিই এর পাশাপাশি হিন্দিতে বঙ্গাল নামটাও রাখতে হবে। ওফ, একটা জায়গার তিনটে নাম পৃথিবীতে কস্মিনকালে হয়নি মশাই। দিদিও রেকর্ড করবেন, আমিও শ্বশুরবাড়িতে নাম কিনব।
আমিঃ না মশাই। বঙ্গাল ফঙ্গাল করে লাভ নেই। বঙ্গই ভালো। জানেন তো মাইকেল মধুসুদন বলেছেন,”হে বঙ্গ
ভাণ্ডারে তব…”
মাইকেলের নাম করতেই বিপদ হল। এডিটরের বউ যে বাঙলার অধ্যাপিকা তা জানতাম না। তিনি এতক্ষণ রান্নাঘরে কী কাজকর্ম করছিলেন। এবার বাইরে এসে বললেন, “দেখুন মাইকেল আরও অনেক কিছু বলে গেছেন। অলীক কুনাট্য রঙ্গে, মজে লোক রাড়ে বঙ্গে।” আরও বলেছেন, “গৌড়জন যাহে আনন্দে করিবে সুধাপান নিরবধি।”
এখন বঙ্গই যদি নাম হবে, তাহলে রাঢ় হবে না কেন? গৌড় হবে না কেন ? সমতট, পৌণ্ড্রবর্ধন, গঙ্গারিডি হবে না কেন? এতগুলো অপশন শুনে মাথা ঝিমঝিমিয়ে গেছিল, কিন্তু গঙ্গারিডি শুনেই চমক লাগলো। বললাম, “ম্যাডাম এই জায়গাটা কোথায়?”
উত্তর এলো ,”গঙ্গার মোহানার কাছে অবস্থিত প্রাচীন এক সভ্যতা। গঙ্গাহৃদি থেকে গঙ্গারিডি।”
আমিঃ ব্যস! ব্যস! অতেই হবে। স্যার, রাজ্যের নাম পেয়ে গেছি। আপনি দাবি তুলুন, রাজ্যের নাম হোক,‘আদিগঙ্গাহৃদি।’ A এবং আ দিয়ে শুরু তাই রাজ্যের নাম একেবারে প্রথম দিকে থাকবে। ইতিহাসকে সম্মান জানানো হবে। সর্বোপরি আদিগঙ্গা বললেই, টালিনালা, কালীঘাট, টালির বাড়ি, হাওয়াই চটি এইসব মনে হবে। অর্থাৎ মা-মাটি-মানুষকে সম্মান জানানো হবে।
শুনে এডিটরের বউ এমন সপ্রশংস দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকাল যে ভাবলাম, এডিটরের কপাল না পোড়ে। আরও ভাবলাম, এবার বোধহয় মাইনে বাড়বে।
কিন্তু না, আমার কপালে যে লবডঙ্কা, সেই লবডঙ্কা। আমার পরামর্শ শুনে, এডিটরের শ্বশুরবাড়িতে ধন্য ধন্য পড়ে গেল। সবাই বলল, এই মতামত একবার যদি দিদির কানে পৌছায়, জামাই বঙ্গবিভূষণ পাবেই পাবে। এডিটরের বউ রোজ এডিটরকে বড় বড় মাছের মাথা খাওয়াতে লাগল। দাবি জানাল, বঙ্গবিভূষণ পেলে ঢাকাই জামদানি কিনে দিতে হবে। কিন্তু কেউ ভুলেও আমার কৃতিত্ব স্বীকার করল না।
পাঠকগণ, যদি রাজ্যের নাম কোনওদিন ‘আদিগঙ্গাহৃদি’ হয়, কেউ না জানুক আপনারা জানবেন আইডিয়াটা কিন্তু আমারই ছিল।