সব্যসাচী কুণ্ডু
ক্ষেতে কাজ করতে করতে অনুকূল লক্ষ্য করলো যে ক্ষেতের পশ্চিম দিকের আলটা যেন একটু বেশি সরু লাগছে।অনুকূলের পাশেই আব্দুলের ক্ষেত। সেখ আব্দুল, অনুকূলের প্রতিবেশীও বটে। আব্দুলের ছেলে আর মেয়ে অনুকূলকে জেঠু বলে ডাকে আর আব্দুলের বৌ ডাকে বড়দা বলে।আব্দুলের ছেলে-মেয়েরা অনুকূলের ছেলেমেয়ের সাথেই খেলে ও স্কুলে যায়।কিন্তু আব্দুলটা একটু বোকাসোকা।আজ বিশ বছর ওরা পাশাপাশি আছে,কখনো সখনো একটু আধটু ঝুট ঝামেলা যে হয় না তা নয় কিন্তু আবার মিটমাটও হয়ে যায়। নতুন গ্রামের উত্তরে বড় বাঁধের ধারে ওদের ক্ষেত।
খানিক এদিক ওদিক চাইতেই অনুকূল দেখল আব্দুল ওর ক্ষেতে কাস্তে নিয়ে আগাছা কাটায় ব্যস্ত।অনুকূল আব্দুলের কাছে গিয়ে জানতে চাইল , “কি রে তুই আমার ক্ষেতের আল কেটেছিস?” আব্দুল বেশ রুক্ষ ভাবে বলল, “আমি কেন কাটতে যাব দাদা ,আমি কি এতই গরিব যে তোমার খেতের আল কেটে আমি বড়লোক হয়ে যাব।” এবার অনুকূল বেশ গলা চড়িয়ে বলল , “আমি খালি জানতে চাইলাম তুই কেটেছিস কি না, তাতে এতো কথা শোনানোর কি আছে শুনি।তুই না কাটলে কি ঐ বট গাছের ব্রহ্মদত্তিটা আমার খেতের আলটা কেটে গেলো?” দেখতে দেখতে ঝগড়াটা এমন পর্যায়ে পৌঁছল যে পাশের ক্ষেত থেকে পরান খুড়ো, দুখু, সেলিম, জাকিররা ছুটে আসতে বাধ্য হল।তারপর খানিক কথা কাটাকাটি ধাক্কা ধাক্কির পর সবাই মিলে ওদের শান্ত করল।রাগের মাথায় দেখে নেবো খুন করে ফেলবো এই সব কথা বার্তাও ওদের মুখ থেকে বেরিয়ে পড়ল।সেই সময় পাশের রাস্তা দিয়ে এক পাল নীল পার্টির লোক শহরের দিকে যাচ্ছিল। ওদের কানে অনুকূল আর আব্দুলের ঝগড়ার কথা পৌঁছাতে বেশি সময় নিলো না। তারপর যা হয়, বিদ্যুৎ বেগে সারা অঞ্চলে রাষ্ট্র হয়ে গেলো যে নতুন গ্রামে হিন্দু মুসলমানে ঝগড়া হয়েছে। আব্দুল নামে এক গরিব সংখ্যালঘু চাষা কে এক হিন্দু খুব মেরেছে। ভোটের সময় আর সাংবাদিক কুলের সৌজন্যে খবরটা সংবাদের শিরোনামে আসতে বেশি সময় নিল না। আস্তে আস্তে সংবাদপত্রের লোকেরা আর নীল সাদা লাল গেরুয়া দলের লোকেরা চেলা চামুণ্ডা নিয়ে নতুন গ্রামে হাজির। দেখতে দেখতে এতো লোক জমে গেলো যে গ্রামের সংক্রান্তির মেলা এই ভিড়ের কাছে নস্যি। এক পার্টির নেতা বলে আমি আমার মুসলিম ভায়ের ওপর হওয়া অত্যাচার মেনে নেব না। আর এক নেতা বলে আমি আমার হিন্দু ভায়ের সাথে আছি।এক নেতা তো সব সীমা অতিক্রম করে বলেই ফেলল যে এই ঝগড়ার জন্য দায়ী আমাদের প্রধানমন্ত্রী, ওনাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ক্ষমা চাইতে হবে।
সবাই চিৎকার করতে লাগলো এর বিহিত চাই। কিন্তু বিহিত করবে কে? শাসক দল দেখলো ভোটের সময় এই সুযোগ! সংখ্যালঘু মন জয় করতেই হবে। তাই অনুকূল কে ছাড়া যাবে না। পুলিশ এসে অনুকূল কে তুলে নিয়ে গেলো। অনুকূলের বৌ ছেলে আর আমিনা ওদের পা ধরে কতো আকুতি মিনতি করল, কিন্তু কে শোনে কার কথা! দারগা সাহেব বললেন, “বড়কর্তার হুকুম তাই আমরা কিছু করতে পারব না।” এদিকে বোকাসোকা আব্দুলকে নিয়ে কতো লোকে যে কতো কিছু বলিয়ে নিলো কতো কাগজে যে টিপ সই করিয়ে নিলো তার ইয়ত্তা নেই। পাক্কা তিনদিন ধরে এই নাটক চলতে থাকল, অনুকূলের বাড়িতে হাড়িই চড়লনা। এই কদিন বড্ড হ্যাপা গেল আমিনার ওপর। বৌদি বাচ্চা গুলোর খাওয়াদাওয়া যত্নআত্তি তে কোন ত্রুটি রাখল না। গ্রামের মোড়ল গ্রামের সবাই কে ডেকে বলল, “ ভোটের সময় তাই সবাই একটু সাবধানে থাকিস,এই রকম উটকো ঝামেলা যেন আর না হয়।ঝামেলাটা মিটলে আগে অনুকূলকে ফিরিয়ে নিয়ে আনতে হবে।”
তিনদিন পর ভিড় আস্তে আস্তে পাতলা হয়ে গেল। দেশের কোথায় একটা সন্ত্রাসবাদী হামলা হয়েছে তাই সবাই ওখানেই ব্যস্ত হয়ে পড়ল।তবে এখানের কাজ মোটামুটি শেষ।অনুকূলের বৌ আর আমিনা আর গ্রামের কজন ছেলে ছোকরা একদিন শহরে গেল অনুকূলকে ছাড়াতে।দারোগা-বাবুর পায়ে পড়ে অনেক আকুতি-মিনতি করে শেষে দুই হাজার টাকার বিনিময়ে ওরা অনুকূলকে মুক্তি দিতে রাজি হল।এই তিনদিনে অনুকূলের বয়েস যেন দশ বছর বেড়ে গেছে,চোখ মুখ কাল হয়ে গেছে,সারা গায়ে কালশিটের দাগ। পুলিশ খুব মেরেছে বেচারাকে।
এদিকে দুতিনদিন আব্দুলের কোন পাত্তা ছিল না। সাংবাদিক আর পার্টির নেতারা ওকে নিয়ে খুব টানাটানি করছিল তাই বাড়ির কথা ভাবার একদম ফুরসৎ পায়নি।বাড়ি ফিরে যখন আমিনার মুখে অনুকূলের খবর শুনল তখন পড়ি কি মরি করে ছুটল অনুকূলের কাছে। অনুকূলের পা ধরে এক চোট কেঁদে বলল, “দাদা আমায় ক্ষমা করে দাও,আমি কিছু বুঝতে পারিনি। এক বাবু পকেটে এক গোছা নোট দিয়ে বলল , “আমার কথা মতো চলবি তো ভালো না হোলে তোকেও থানায় চালান করে দেবো।” এতো গুলো কাঁচা টাকা দেখে লোভে পড়ে গেছলাম দাদা।তোমার নামে অনেক বদনাম দিয়েছি দাদা আর না। এবারটি ক্ষমা করো দাদা।” অনুকূল ধরা গলায় বলল , “ বাচ্চাদের মতো কেন কাঁদছিস আয় আমার বুকে আয়। দিব্যি করে বল আর কক্ষনো এই রকম করবিনা।” আব্দুল অনুকূলকে জড়িয়ে ধরে হাওমাও করে কেঁদে উঠলো।অনুকূল এবার বলল, “চল অনেকদিন খেতে যাওয়া হয়নি ,খেতের কি অবস্থা কি জানি।” আব্দুল চোখ মুখ মুছে বলল , “ না দাদা এবেলা তোমার ক্ষেতে গিয়ে লাভ নেই,তুমি বরং আরাম করো। আমিই ঘুরে আসি।” বারান্দা থেকে একটা কোদাল তুলে নিয়ে আব্দুল ক্ষেতের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। অনুকূলের বৌ আর আমিনা হাতজোড় করে কপালে ঠেকিয়ে বলল , “ দুগ্গা দুগ্গা ।”