অন্তরা চৌধুরি
মোয়ার দেশে
একদিনের জন্য কলকাতার কাছাকাছি কোথায় যাওয়া যায়? সেই নিয়ে বেশ কয়েকদিন ধরেই গবেষণা চলছিল। ইউটিউবে সার্চ করলে অনেক জায়গা পাওয়া যায় বটে, কিন্তু মনের মতো জায়গা খুঁজে পাওয়া জটিল। তাছাড়া, ছবিতে অনেককিছুই সুন্দর লাগে, কাছে গেলে নিতান্তই সাধারণ মনে হয়। অনেকদিন ধরেই ইচ্ছে ছিল সুন্দরবন যাওয়ার। কিন্তু নানা জটিলতায় হয়ে ওঠে না। বিস্তর খোঁজাখুঁজির পর ডেস্টিনেশন ঠিক হল কৈখালি। পরিপূর্ণ সুন্দরবন না হলেও আংশিক সুন্দরবন ভ্রমণের মাধুর্য এখানেই পাওয়া যাবে। যাওয়ার আগে নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশনে ফোন করে রুম বুকিং করে নেওয়া হল। সেখানকার মহারাজরাই প্রয়োজনীয় তথ্য ও রুট ডিরেকশন দিয়ে দিলেন। তারপর নির্দিষ্ট দিনে শিয়ালদহ থেকে নামখানা লোকালে চেপে পড়লাম। ঘণ্টা দেড়েকের পথ শেষে আমরা গিয়ে নামলাম মজিলপুর জয়নগর স্টেশনে। মোয়ার জন্য বিখ্যাত এই জয়নগর। তবে জয়নগরের আগের স্টপেজ বহড়ুর মোয়াই নাকি আসল মোয়া। এই তথ্যটি অনেকের অজানা। আকাশে বাতাসে তখন কনকচূড় ধান, নতুন ওঠা নলেন গুড় আর গাওয়া ঘি–এর গন্ধ। বোঝাই গেল, মোয়ার দেশে চলে এসেছি।
নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশন
স্টেশন থেকে মোটর ভ্যানে চেপে পৌঁছে গেলাম নিমপীঠ রামকৃষ্ণ মিশনের গেটে। স্টেশন থেকে আসতে প্রায় মিনিট কুড়ি। রাস্তাও বেশ এবড়ো খেবড়ো। তারপর ওই বিচিত্র ভ্যানে চেপে সারা শরীরে ব্যথা তো হয়েইছে, মনটাও যেন কিছুটা বিগড়ে গেছে। কিন্তু রামকৃষ্ণ মিশনে ঢুকতেই মনটা বেশ ভাল হয়ে গেল। অনেকখানি জায়গা জুড়ে এই আশ্রমের বিস্তার। ১৯৬০ সালে স্বামী বুদ্ধানন্দ দক্ষিণ চব্বিশ পরগণার এই প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মঠটি স্থাপন করেছিলেন। ঠাকুরের মন্দিরে প্রণাম করে আমরা গেলাম অফিসে। সেখানে সদা হাস্যময় এক মহারাজ আমাদের বুকিং কনফার্ম করে আমাদেরকে আশ্রম সংলগ্ন একটি রুম খুলে দিয়ে বললেন, ‘মা আপনারা এখানে বিশ্রাম করুন। অনেক দূর থেকে এসেছেন। স্নান সেরে মায়ের মন্দির, গোশালা, মধু উৎপাদন কেন্দ্র ঘুরে আসুন। ঠিক সাড়ে বারটার মধ্যে চলে আসবেন। প্রসাদ পাবেন।’
মহারাজের সুমিষ্ট ব্যবহার মন ছুঁয়ে গেল। এমন আন্তরিকতা, এমন বিনয় এখন বেশ দুর্লভ। স্নান সেরে আমরা পায়ে হেঁটেই বেরিয়ে পড়লাম। সময় তখন সকাল সাড়ে নটা। রাস্তায় দেখলাম বারুইপুরের টাটকা পেয়ারা জলের দরে পাওয়া যাচ্ছে। সামনেই প্রচুর জলাশয়। সেখানে থেকে কেজি কেজি উঠছে পানিফল। তাই সেদিন পানিফল, পেয়ারা আর ডাব দিয়েই হল ব্রেকফাস্ট। সত্যি কথা বলতে কী, এত সুমিষ্ট টাটকা ফল খেয়ে ভেতরটা কেমন শান্ত আর ঠাণ্ডা হয়ে গেল। অবশ্য অন্য কিছু খেতে চাইলে, আশপাশের দোকানে পেয়ে যাবেন। শহরের জৌলুস এখানে নেই। নিতান্ত আটপৌরে এক গ্রামাঞ্চল। পরম মমতায় জড়ানো, আন্তরিকতায় মোড়া একটা গঞ্জ। না গ্রাম, না শহর। প্রয়োজনীয় সব কিছুই হাতের নাগালে পাওয়া যায়।
তিন ভুবনের পারে
সেসব দেখতে দেখতে আমরা সরু জঙ্গলের রাস্তা ধরে পৌঁছে গেলাম সারদা মা এর মন্দিরে। সেখানে রয়েছে মেয়েদের স্কুল ও হোস্টেল। তারাই মন্দিরের যাবতীয় কাজকর্ম করে। বেশ কয়েকজনের সঙ্গে পরিচয় হল। তাদের শান্ত, মার্জিত ব্যবহার বেশ লাগল। কিশোরী সুলভ কোনও চাপল্য তাদের আচরণে প্রকাশ পেল না। উন্মুক্ত প্রকৃতির মাঝে রামকৃষ্ণ মিশনের অনুশাসনে ওরা প্রতিপালিত। তাই ছোট থেকেই জীবন পাঠের দীক্ষায় ওরা দীক্ষিত হয়ে চলেছে।
অখণ্ড নীরবতায় ঘেরা মায়ের মন্দির যেন এক শান্তিধামের ঠিকানা। এরপর বনস্থলীর সংকীর্ণ পথ পেরিয়ে আমরা গেলাম গোশালা ও মধু উৎপাদন কেন্দ্রে। গোশালাটি আয়তনে বেশ বড়। গোশালার পাশেই রয়েছে হানি রিসার্চ ল্যাবরেটরি। রয়েছে একটি ছিমছাম মিনি কফি হাউস। চা কফি ও বিভিন্ন রকম স্ন্যাক্সের অফুরন্ত ভাণ্ডার। স্বনির্ভর গোষ্ঠীর মহিলারা বিভিন্ন রকম মুখোরোচক খাবার তৈরি করে চলেছেন। সেখানেই পাওয়া যাচ্ছে সুন্দরবনের বিখ্যাত মধু। ইচ্ছে হলে নেওয়া যেতে পারে।
অন্নভোগঃ
মহারাজের কথানুযায়ী আমরা দুপুর সাড়ে বারটার মধ্যেই মূল মন্দিরে চলে এসেছিলাম। সেখানে ঠিক সাড়ে বারটায় আমরা প্রসাদ পেলাম। মোটা চালের ভাত, ডাল, দুরকম তরকারি, চাটনি, পায়েস, মিষ্টি দিয়ে ভরপেট খাওয়া হল। এমন অপূর্ব স্বাদ সেই খাবারের যে, বাড়িতে যা খাই, তার ডবল খেয়ে ফেললাম। এরপর সেই মহারাজই আমাদের জন্য অটো ঠিক করে দিলেন। পরের গন্তব্য কৈখালি। নিমপীঠ থেকে কৈখালির দূরত্ব তিরিশ কিলোমিটার। অটো ভাড়া সাড়ে তিনশ টাকা। কিন্তু রাস্তা তেমন ভাল নয়। বিশেষ করে, প্রথম অর্ধেক রাস্তা বেশ খারাপ। পরের দিকটা অবশ্য তুলনায় ভাল। মোটামুটি একঘণ্টা লেগে গেল। যাওয়ার সময় সঙ্গে নিয়েছিলাম কেজি দুয়েক টাটকা পানিফল। সেই খেতে খেতে আমরা প্রায় দুটো–আড়াইটে নাগাদ পৌঁছে গেলাম।
নরম রোদে আলসে ভ্রমণ
টুরিস্ট লজটা এক ঝলক দেখেই মনটা ভাল হয়ে গেল। লজ থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরে বয়ে চলেছে সুন্দরী মাতলা নদী। আমরা রুমের মধ্যে ব্যাগ পত্তর রেখে শীতের মিঠে রোদ গায়ে মেখে বেরিয়ে পড়লাম। লজের পাশেই বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে কৈখালি রামকৃষ্ণ মিশন। আমরা মিনিট দুয়েকের মধ্যেই নদীর ধারে পৌঁছে গেলাম। আমাদের চোখ গঙ্গা দেখেই অভ্যস্ত। খুব বেশি হলে দামোদর, গন্ধেশ্বরী ইত্যাদি। সেখানে বর্ষাকাল ছাড়া জল দেখা যায় না। কিন্তু মাতলাকে দেখে নদী সম্পর্কে সমস্ত ধারণা ভেঙে গেল। নদী যে এরকম সমুদ্র সদৃশ হতে পারে, তা মাতলাকে না দেখলে বোঝা যায় না। কলকাতার গঙ্গাকে সে অনায়াসেই কয়েক গোল দিয়ে পেছনে ফেলে দিতে পারে। মাতলার পাড়ে টুকটাক খাবারের দোকান। তার পরেই একটা ইটের সরু রাস্তা চলে গেছে সামনের গ্রামে। দুপাশে সবুজের সারি। আর মাতলার জলে সুন্দরী, গরাণ, গেওয়ার দৃষ্টিনন্দন উপস্থিতি সেই সৌন্দর্যকে আরও কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিয়েছে। রাস্তার নীচে গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখা যায় স্থানীয় মানুষদের বসতি। গরু, বাছুর, ছাগল, হাঁস মুরগি প্রকৃতির আপন খেয়ালে ঘুরে বেড়াচ্ছে। যেতে যেতে মনে হচ্ছিল, এই রাস্তা ধরে অনন্তকাল হেঁটে যাওয়া যায়। বেশ কিছু জায়গা আছে যেখানে গিয়ে মনে হয়, এ যেন কতদিনের চেনা। বড় আপন, বড় নিজের। অথচ সেই জায়গাতে প্রথমবার গেছি। এই জায়গাটাও ঠিক সেরকম। অনাড়ম্বর অথচ নিরহঙ্কার।
অচেনা অতিথি
হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ এসে পড়েছি। প্রকৃতির মধ্যে এক অদ্ভুত মাদকতা আছে। যে তার স্বাদ পেয়েছে, তার পক্ষে ফিরে আসা মুশকিল। আমাদের অবস্থাও তাই। মাতলার বুকে সূর্য তার রক্তিম আভা ছড়িয়ে সেদিনকার মতো বিদায় জানাচ্ছে। এদিকে হাঁটতে হাঁটতে পায়ে ব্যথা শুরু হয়েছে। কিন্তু সেই পড়ন্ত সাঁঝবেলায় বসব কোথায়। দেখলাম রাস্তার পাশেই তিনিজন মহিলা ঝকঝকে নিকোনো উঠোনে বসে মাছ কাটছে। খানিকটা উপযাজক হয়েই তাদের কাছে গেলাম শুধুমাত্র পা দুটোকে খানিক বিশ্রাম দেওয়ার জন্য। তাদের সহজ সরল গ্রাম্য চোখে কিছুটা প্রশ্ন চিহ্নর ছায়া পড়লেও তা খুব বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। ওরা কিছু বলার আগে আমরাই বললাম, ‘তোমাদের বড়ি দেখতে এলাম।’ একজন বলল, ‘আমাদের আর বাড়ি কী দেখবে গো! সবই আয়লাতে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে। বলতে বলতেই ঘরের ভেতর থেকে একজন চেয়ার ও তালপাতার আসন এনে বিছিয়ে দিল। সামনেই রয়েছে ধানের মরাই। তার পাশে তুলসীথান। ঘরের উঠোন গোবর দিয়ে পরিপাটী করে নিকোনো। আর পাশেই রয়েছে পুকুর। তাদের সেই উঠোনে দু দণ্ড বসে পথশ্রমের ক্লান্তি কোথায় যেন মিলিয়ে গেল। প্রান্তিক মানুষদের সঙ্গে কথা বলতে ও মিশতে বড় ভাল লাগে। তাই গল্পের ছলে জানলাম, তাদের যাপন কথার ইতিবৃত্ত। সব থেকে ভাল লাগল তাদের খাবার মেনু। তিন বেলাই মাছ ভাত খায়। নদীতে যখন যে মাছ ওঠে, সেই মাছ আর ঘরের উঠোনে হওয়া সব্জি খেয়েই তারা মহানন্দে আছে। একজনের কথায়, ‘বাড়ির সেলে পুলে সক্কাল বেলায় সব সলা ভাত আর মাস ভাসা খেয়ে বেরিয়ে সায়।’ এরা সকলেই পূর্ববঙ্গীয়। লোটে মাছের রেসিপি জিজ্ঞাসা করতে গিয়ে একজন বলল, ‘লইটা মাস কত্তে পার না ক্যান? এট্টু আদা দিবা, এট্টু ওসনা দিবা…’বাকিটা আর লিখলাম না।
জোনাক জ্বলা রাত্রি
ওদের সঙ্গে গল্প গল্প করতে করতে চারিদিকে কখন যে ঘুটঘুটে অন্ধকার ঘনিয়ে এসেছে। প্রদীপ ধূপ আর শাঁখের আওয়াজে মাতলা নদীর পাড়ের সেই সন্ধ্যে হয়ে উঠল মোহময়ী। এবার লজে ফেরার পালা। কিন্তু তারা তো না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। তাদের স্পেশাল মাছ রান্না দিয়ে ভাত খেতেই হবে। আমরা অনেক অনুনয় বিনয় করে ‘পরের বার এসে খেয়ে যাব’ এই সব আধা সত্যি প্রতিশ্রুতি দিয়ে লজে ফেরার পথ ধরলাম। রাস্তায় কোনও ইলেক্ট্রিসিটি নেই। বহুদূরে লজের টিমটিমে আলো দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পথ চলার ক্ষেত্রে আধখানা চাঁদের আলোই একমাত্র ভরসা। আলো থাকার সময় যে রাস্তাকে দেখে মনের মধ্যে কবি কবি ভাবের কুলু কুলু জোয়ার বয়ে গিয়েছিল; এখন ঘুটঘুটে রাস্তায় সেসব ভাব চুপসে গেছে। একপাশে জঙ্গল আর একপাশে জঙ্গল ঘেরা নদী। তার মাঝখান দিয়ে হেঁটে চলেছি আমরা। এমন সময় লক্ষ করলাম, গাছে গাছে অজস্র জোনাকির আলোর মালা। সেই দৃশ্য দেখে এক অদ্ভুত ভাল লাগায় মন ভরে গেল। কলকাতা থেকে মাত্র ঘণ্টা দুয়েকের পথ পেরোলেই যে রূপকথারা আনাচে কানাচে অপেক্ষা করে আছে আমাদের জন্য, তা কেই বা জানত! ভয় মিশ্রিত ভাললাগার সে এক অপূর্ব সন্ধিক্ষণ।
রাতপরীর রূপকথা
লজে ফিরে এসে যেন ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। সন্ধ্যেবেলায় গরম চা এর সঙ্গে গোল গোল মুড়ি আর মোটা মোটা চপ মন্দ লাগল না। তারপরেই গেলাম সামনের রামকৃষ্ণ মিশনে। সেখানে প্রচুর ছোট ছোট ছেলে আশ্রমে থেকে পড়াশোনা করে। সন্ধ্যেবেলায় সেই সমবেত কচিকাঁচাদের কচি গলায় রামকৃষ্ণ স্তোত্র শুনতে মন্দ লাগছিল না। সেই অপূর্ব সন্ধ্যারতি এই জীবনের এক পরম পাওয়া।
সারাদিনের ধকলে সকলেই পরিশ্রান্ত। তাই হাত মুখ ধুয়ে সকলেই কিছুক্ষণ বিশ্রাম নেওয়ার পর রাতের খাবারের পালা। গরম গরম চিকেন সহযোগে গরম ভাত বেশ অমৃতের মতো লাগল। তার ওপর নতুন হাতের রান্না। আসলে মানুষের ধর্মই এটা। যখন কোনও জায়গা ভাল লাগতে শুরু করে তখন তার সবটাই ভাল লাগে। খেয়ে দেয়ে সবাই এসে জড়ো হলাম ছাদে। যে পথ দিয়ে একটু আগে পেরিয়ে এসেছি, সেই পথটাকেই তখন যেন ভয়ঙ্কর মনে হচ্ছে। অথচ এও জানি, অন্ধকারের কালিমা মুছে গেলে নতুন আলোর স্পর্শে আবার সবকিছু প্রাণ ফিরে পাবে। সেই খোলা ছাদে চাঁদের আলো, সঙ্গে নদীর বাতাস। জমজমাট আড্ডার আবহ। ভাল সঙ্গী থাকলে আড্ডায় রাত গভীর থেকে গভীরতর হতেই পারে। কিন্তু শরীর ও মন দুই তখন ক্লান্ত। তাই রাত্রির কোলে মাথা রেখে নিশ্চিন্ত ঘুম।
সূর্য ওঠার পালা আসে যদি আসুক বেশ তো
খুব ভোরেই উঠে পড়েছিলাম। কারণ একদিনের ট্যুরে কোনও মুহূর্তই মিস করা যাবে না। তাই গায়ে শীতবস্ত্র জড়িয়ে সোজা নদীর পাড়ে। সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে মাতলার বুকে। আলোর স্পর্শে গতরাতের ভয় কোথায় যেন একনিমেষে চলে গেছে। ঝির ঝির করে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। পাখিদের ঘুম ভাঙছে। অল্প অল্প করে জলের তলা থেকে উঠে আসছে আমাদের সূয্যি মামা। সে দৃশ্য অবর্ণনীয়। টাইগার হিল থেকে বা সমুদ্র থেকে সানরাইস অনেকেই দেখেছেন। কিন্তু মাতলার বুকে সূয্যি ওঠা ভোর এক অপূর্ব ভাললাগার আবেশে মন ভরিয়ে দেয়।
সেখান থেকে আমরা হাঁটতে হাঁটতে চারপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। প্রচুর ট্রলার ও লঞ্চ ঘাটে দাঁড় করানো রয়েছে। সেই ভোর বেলাতে প্রচুর মৎস অবতারের দেখা পাওয়া গেল। কুচো চিংড়ি টন টন উঠছে। মাত্র কুড়ি টাকা কেজি। আরও যে কত বিচিত্র মাছ উঠেছে, তা বলার নয়।
পুচ্ছপাকা টুরিস্ট
সকালে রামকৃষ্ণ মিশনটা ভাল করে ঘুরে ফিরে এলাম লজে। সেখানে স্নান খাওয়া সেরে লঞ্চে করে আমরা যাব ঝড়খালি। গরম গরম লুচি আর আলুর দম দিয়ে ব্রেকফাস্ট জাস্ট জমে গেল। তারই মধ্যে কলকাতার কিছু পুচ্ছপাকা টুরিস্ট প্লাস্টিকে মুড়ে নিয়ে গেছে কর্নফ্লেক্স। কেউ আবার নিয়ে গেছে কলা। কারও চাই গরমা গরম হাত রুটি। সর তোলা দুধ। না হলেই ‘কমপ্ল্যান করব’ বলে গোবেচারা ম্যানেজারকে হুমকি। ভীষণ রেস্ট্রিক্টেড ডায়েট ফলো করেন আসলে। লুচি নৈব নৈব চ। আলুতো একেবারে সিলেবাসের বাইরে। এই সব অতিবাচাল লোকেদের জন্য বড় করুণা হয়। এতরকম বায়না যাদের, তাদের বাড়ি থেকে বেরোনোই উচিত নয়। সকলেরই বেশ বয়স হয়েছে। একদিন একটু রুটিন ব্রেক করলে রামকৃষ্ণের কথামৃত অশুদ্ধ হয়ে যাবে না। এই সহজ সত্যিটা এদের কে বোঝায়! জীবনের টুকরো টুকরো আনন্দগুলো নিতেই শিখল না। খাঁচার পাখি হয়েই জীবনটাকে কাটিয়ে দিল।
ঝড়খালি
ছক ভাঙা জীবনের বাইরে বেরিয়ে যে কী আনন্দ, সে কি আর সকলে বোঝে! যাই হোক, আমরা গিয়ে বসলাম লঞ্চে। একটু পরে আরও কয়েকজন সহযাত্রীকে নিয়ে লঞ্চ ছাড়ল। ভাড়া পনেরশো টাকা। কিন্তু কিছুদূর যাওয়ার পরই সকলের মুখগুলো কেমন থমথমে হয়ে গেছে। এমনকী যিনি লঞ্চ চালাচ্ছেন, তিনিও কোনও কথা বলছেন না। উপরন্তু কিছু জিজ্ঞাসা করলেই প্রচণ্ড বিরক্ত হচ্ছেন। চারিদিকে শুধু জল, জল আর জল। তার সঙ্গে মাতলায় চলছে প্রচণ্ড জোয়ার। মাঝির এক মুহূর্তের অসর্তকতায় এতগুলো লোকের জীবন বিপন্ন হয়ে যেতে পারে। নৌকা মাতলার ঢেউয়ে তখন উঠছে আর নামছে। ছবি তোলা তখন মাথায় উঠেছে। তীব্র ঠাণ্ডা হাওয়া এসে বিঁধছে শরীরে। সকলেই প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে বসে আছে। নদী যে ওরকম ভয়ঙ্কর হতে পারে, তা মাতলাকে না দেখলে বিশ্বাসই করা যেত না। প্রায় দেড়ঘণ্টার পথ। আর কখনও বাড়ি ফেরা হবে কি না এই প্রশ্নই সকলের মনে জাঁকিয়ে বসেছিল। অবশেষে ঝড়খালির কাছাকাছি এসে মাঝিদের মুখে হাসি ফুটল। তাঁরা স্বীকার করলেন যে, আজকে বেশ রিস্ক ছিল। আমরা সেসব ভয় কাটিয়ে নতুন জায়গা এক্সপ্লোর করার উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লাম। ঝড়খালিতে টিকিট কেটে আমরা সেখানে কুমীর প্রজনন কেন্দ্র দেখলাম। দেখলাম রয়্যাল বেঙ্গল টাইগার। বেশ গজেন্দ্র গমনে শীতের রোদ মেখে তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এসব দেখে আবার লঞ্চে করে ফিরে এলাম কৈখালি। দুপুরের দিকে ছিল আমাদের ট্রেন। কাজেই সেখানে খাওয়া দাওয়া করে জয়নগরের মোয়া কিনে আবার ফিরে এলাম কলকাতার জন অরণ্যে। রোজকার চেনা রুটিনে ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু মনের মাঝে এখনও সেই মাতলার ঢেউ।
****
কীভাবে যাবেন?
শিয়ালদা থেকে ট্রেনে মজিলপুর–জয়নগর স্টেশন। মোটামুটি সোয়া এক ঘণ্টার পথ। নিমপীঠ আশ্রমে দুপুরের খাওয়া সেরে অটো নিয়ে যেতে পারেন কৈখালি।কোথায় থাকবেন?
কৈখালিতে বেসরকারি হোটেল তেমন নেই। আছে কৈখালি পর্যটক আবাস। সরকারি ভবন। কিন্তু চালানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে রামকৃষ্ণ মিশনকে। নিমপীঠ থেকেই বুকিং করতে হয়। ফোনেও বুকিং করা যায়। ভাড়া থাকা–খাওয়া সহ মাথাপিছু ৫৫০। সেখানে ভর্তি হয়ে গেলে পাশে রামকৃষ্ণ মিশনেও থাকার ব্যবস্থা আছে। নিমপীঠ আশ্রমের ফোন নম্বর:কী দেখবেন?
মাতলার পাড় ধরে এদিক–ওদিক হেঁটে বেড়ান। পরদিন সকালে চলে যেতে পারেন ঝড়খালি। বিভিন্ন সাইজের লঞ্চ ভাড়া পাওয়া যায়। নিজেও বুক করতে পারেন। পর্যটক আবাসে বললে, তাঁরাও ব্যবস্থা করে দিতে পারেন। এছাড়াও সুন্দরবনের অন্যান্য দিকে যেতে পারেন।