সেদিন কেন দল তুলে নিয়েছিলেন মোহন কর্তারা ?

সত্রাজিত চ্যাটার্জি

আরও একটা ৯ ডিসেম্বর চলে গেল। বিগত চার বছর ধরে এই দিনটা এলেই মনটা একটা দুষ্টুমিতে ভরে যায়। আমরা যারা বাংলার বা ভারতের ফুটবল মানে ইষ্টবেঙ্গলকে বুঝি, তাদের কাছে বছরের এই দিনটা মানেই একটা অদ্ভুত মজা আর তৃপ্তি। চার বছর আগে এই দিনেই তো ইষ্টবেঙ্গলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব, ভারতের তথাকথিত “জাতীয় ক্লাব” মোহনবাগান তার অগণিত সমর্থকদের লজ্জায় মাথা নীচু করিয়ে ইষ্টবেঙ্গলের সাথে ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধে টিম তুলে নিয়েছিলো। কারণ মাঠে নাকি খেলার পরিবেশ ছিলো না!
কিন্তু ম্যাচ রেফারির রিপোর্টে পরিষ্কার লেখা ছিল যে “মাঠে দ্বিতীয়ার্ধে ম্যাচ হওয়ার অনুকূল পরিবেশ অবশ্যই ছিলো।“ ম্যাচ রেফারি এবং অন্যান্য সংগঠকরাও বাগান কর্তাদের বারংবার অনুরোধ জানিয়েছিলেন ম্যাচটা খেলার। কিন্তু মোহনবাগান কর্তাদের ম্যাচ খেলতে ভীতি বা অন্য যে কোন অজ্ঞাত কারণেই হোক, তারা খেলতে চায়নি। ফলস্বরূপ ইষ্টবেঙ্গল যেমন তিন পয়েন্ট পেয়েছিল ,তেমনি তিন গোল ও পেয়েছিল। কিন্তু সবচেয়ে বড় কথা হল, এই সিদ্ধান্তের শাস্তিস্বরূপ মোহনবাগান সেই বছর আই লিগ থেকেই শুধু নয়, যে কোনও প্রতিযোগিতা থেকেই আরও দু বছরের জন্য সাসপেণ্ড হয়েছিল। পরে অবশ্য বাগান কর্তাদের শত অনুনয়-বিনয়ের জন্যই হোক বা কোনও অজ্ঞাত কারণেই হোক, দু কোটি টাকা এ আই এফ এফ কে জরিমানা দিয়ে শতবর্ষ প্রাচীন ঐতিহ্যশালী ক্লাব নিজেদের সাসপেনশন তোলাতে সমর্থ হয়েছিল এবং সর্বভারতীয় প্রতিযোগিতার মূলস্রোতেও ফিরে এসেছিল। কিন্তু সেদিন যে কালি লাগলো ভারতের তথাকথিত জাতীয় ক্লাবের গায়ে, সেই কালি মনে হয় অতি বড় বাগান সমর্থক ও আমৃত্যু মনে রাখবেন ।

mohun bagan3

আসলে সেদিন মোহনবাগান একপ্রকার ভয় পেয়েই পালিয়ে গিয়েছিল। কীসের ভয় ? চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে বড় ব্যবধানে হারের ভয়ে। ম্যাচের ৩৮ মিনিটে ইষ্টবেঙ্গলের পক্ষে হরমোনজ্যোত সিং খাবরা গোল করেন। খেলার ফল তখন ইষ্টবেঙ্গলের অনুকূলে ১-০। তার মিনিট তিনেক পরে মোহনবাগানের ফরোয়ার্ড লাইনের সেরা অস্ত্র, তথা অধিনায়ক এবং দেশের অন্যতম সেরা বিদেশি স্ট্রাইকার ওডাফা ওকোলি ইষ্টবেঙ্গলের কোন এক খেলোয়াড়কে ব্যাড ট্যাকল করে হলুদ কার্ড দেখেন। রেফারির সিদ্ধান্তে চূড়ান্ত অসন্তুষ্ট ওডাফা রেফারির দিকে মারমুখী হয়ে তেড়ে যান এবং হাত পা নেড়ে কুৎসিত অঙ্গভঙ্গি শুরু করেন। সঙ্গত কারণেই রেফারি বাগান অধিনায়ককে দ্বিতীয়বারের জন্য হলুদ কার্ড এবং লাল কার্ড দেখিয়ে মাঠের বাইরে চলে যেতে বলেন। এতে মাঠের বাইরে উপস্থিত বাগান সমর্থকরা ক্ষুব্ধ হয়ে ঢিল, জলের বোতল মাঠের মধ্যে ছোঁড়া শুরু করেছিল। বাগান ফুটবলার রহিম নবির মাথায় একটি ইঁট এসে লাগাতে তিনি মাঠের মধ্যে পড়ে যান এবং খেলা সাময়িক বন্ধ থাকে। পরে অন্যান্য খেলোয়াররা তাকে ধরাধরি করে স্ট্রেচারে তুলে দিয়েছিল। মোহনবাগান সমর্থকদের আচরণে গ্যালারিরে প্রচন্ড উত্তেজনার সঞ্চার হয় এবং মাঠে উপস্থিত পুলিশের কর্তারা ব্যাপক লাঠিচার্জ শুরু করে। পালাতে গিয়ে অনেক বাগান সমর্থকও কমবেশি আহত হন। সব মিলিয়ে একটা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।
কিছুক্ষণ পরে যদিও খেলা শুরু হয়েছিল এবং প্রথমার্ধের বাকি সময়টুকু খেলা হওয়ার পর বিরতিতে গ্যালারিতে আবার গণ্ডগোল শুরু হয়েছিল এবং দুই দলের সমর্থকরাই পরস্পরের দিকে ইঁট,পাটকেল ছুঁড়তে শুরু করেছিল। পুলিশ ব্যাপক হারে লাঠিচার্জ করে পরিস্থিতি আয়ত্তে এনেছিল। তারপরে যখন বিরতি শেষ হওয়ার সময়ে রেফারি দুই দলের খেলোয়াড়দের মাঠে নামতে বলে, তখন থেকেই বাগান খেলোয়াড়রা না খেলার দাবি জানাতে থাকে। ম্যাচ রেফারি এবং পুলিশ কমিশনারের বারংবার অনুরোধেও তারা তাদের সিদ্ধান্তেই অটল থেকেছিল,একটাই কারণে যে দলের সেরা অস্ত্র যেহেতু লাল কার্ড দেখে মাঠের বাইরের ০-১ ব্যাব্ধানে পিছিয়ে থাকা ম্যাচ হয়তো লজ্জাজনক কোনো ব্যবধানে গিয়ে শেষ হত।

derby3
এখন কথা হল ফুটবল মাঠের মধ্যে রেফারির সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত, তা টিমের পক্ষে অনুকূলেই হোক আর বিপক্ষেই হোক। বিশ্বফুটবলেও অনেক ম্যাচেই ভুল রেফারিং এর শিকার হয় ছোট-বড় সব দলই। আর সেইদিন যতক্ষণ খেলা হয়েছিল রেফারি যে ভুল কোন সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এমনও নয়। বাগান অধিনায়ককে লাল কার্ড দেখানোটাও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু সেই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে দ্বিতীয়ার্ধে দল না নামানোর সিদ্ধান্তটা কোনমতেই সমর্থন যোগ্য নয়। খেলার মাঠ থেকে পালাবে কেন ? খেলায় তো হার জিত আছেই। একদল জিতবে, আর একদল হারবে, বা কখনো কখনো সেই ম্যাচটি ড্র হবে-এটাই তো ফুটবল খেলার নিয়ম। কিন্তু মাঠ থেকে দল তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত টা খুবই অপ্রত্যাশিত এবং মোহনবাগানের মত ঐতিহ্যশালী ক্লাবের পক্ষে খুবই লজ্জাজনক। যারা ব্রিটিশ শাসনাধীনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে খালি পায়ে খেলে আই.এফ.এ.শিল্ড জয়ী হয়েছিলো, সেই ক্লাবের কর্মকর্তাদের এমন লজ্জাজনক সিদ্ধান্ত? শুধু চিরপ্রতিদ্বন্দ্বীর কাছে বড় ব্যাবধানে হারের ভয়ে ? আর এমন টিম তুলে নেওয়ার স্বপক্ষে এমন যুক্তি সেদিন দেখিয়েছিলো বাগান কর্তারা যা কিনা হাস্যকর! যেখানে খোদ ম্যাচ রেফারি দাবি করেছিলেন ম্যাচের দ্বিতীয়ার্ধ শুরু করার অনুকূল পরিবেশ আছে মাঠে,তারপরে আর কোন কথা হয় ? ম্যাচ রেফারিও কি ইষ্টবেঙ্গলের সমর্থক নাকি ? আর মাঠে বিশৃঙ্খলা শুরু করেছিল বাগান সমর্থকরাই। তাদের গ্যালারি থেকেই ইঁটবৃষ্টি শুরু হয়েছিল এবং তাদের দলের খেলোয়াড় রহিম নবি গুরুতর আহত হয়েছিলেন। সেই “অন্ধ সমর্থক দের বিরুদ্ধে বাগান কর্তারা কি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তা আমার জানা নেই, বা আদৌ তাদের চিহ্নিত করেছিলেন কিনা তাও জানা নেই, কিন্তু কর্মকর্তাদের সেদিনের সেই সিদ্ধান্তে শতাব্দীপ্রাচীন ক্লাবের যে সম্মানহানি হয়েছিলো এবং যে কালিমা লাগলো,সেই লজ্জা মনে হয় আমৃত্যু সব মোহনবাগান প্রেমীদেরই বুকে নিয়ে বেড়াতে হবে !!

Share

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.