অরিত্র চট্টোপাধ্যায়, মুম্বই
অশোকদার কথা বলতে বা ভাবতে গেলে, প্রথমেই যা মনে আসে, এক সদাহাস্যময় মুখ এবং পিঠের উপর স্নেহশীল হাত। আর তিনি হলেন সব প্রজন্মের, সবার অশোকদা। আর তাঁর অসম্ভব স্মৃতিশক্তি, যা আমার মতো তরুণদের কাছেও রীতিমতো ঈর্ষণীয়।
অশোকদার জীবন এতটাই খোলা বইয়ের মতো যে প্রায় সবাই এখন জানেন। তবুও অশোকদাকে নিয়ে লিখতে বসলে শব্দ কম পড়ে যাবে। সব কিছু লেখার পরেও মনে হবে, যেন কিছুই লেখা হল না। তবু নিজের মনের মধ্যে বহুমূল্য সম্পদের মতো রাখা কিছু স্মৃতির কথা লেখার লোভ সামলাতে পারলাম না তাঁর জন্মদিনে।
শুভ জন্মদিন, অশোকদা। আপনার সেই চির পরিচিত, ‘অরিত্র, কেমন আছো ? কখন এলে ?’ অনেকদিন শোনা হয়নি।
অশোকদাকে প্রথম দেখা ১৯৯৮ সালে সেপ্টেম্বরের কোনও এক বিকেলে পুরানো ফরওয়ার্ড ব্লক অফিসে। তখন শুধু নামেই চেনা, সামনে থেকে সেই প্রথম দেখা। কথা বলার সাহসই হয়নি। তারপর কখনও বর্ধমান, কখনও কলকাতায় দেখা। কিন্তু ফলাফল একই, শুধুই প্রণাম।
তারপর ছাত্র সংগঠনের কাজের সূত্রে ২০০০ সালের সেপ্টেম্বরে দিল্লি যাওয়া। একমাস পরেই অশোকদা দিল্লি এলেন, কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিংয়ে। সেই প্রথম কথা বললাম। আমাকে অবাক করে দিয়ে বললেন, ‘আমি তোমাকে চিনি অরিত্র। এখানে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না তো ?’ সেদিন আরও একবার উপলব্ধি করলাম, কেন তিনি সবার অভিভাবক।
তারপর কাজের সূত্রে মাঝে মাঝে ফোনে কথা হলেও, অশোকদাকে আরও কাছ থেকে জানার ও তাঁর স্নেহ পাওয়ার সুযোগ হল ছাত্র ব্লক-এর অল ইন্ডিয়া কনফারেন্সের প্রস্তুতির জন্য কলকাতায় ১৫ দিন কাজ করার সময়।
সকালে অশোকদার খবরের কাগজ পড়া, চোখে একদমই দেখতে পান না, তাই কেউ একজন খবরের কাগজগুলো পড়ে শোনায়। এবং তিনি একবার শুনেই এগুলো কতটা মনে রাখেন, সেটা এতদিনে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার দৌলতে প্রায় সবাই জানেন। এতটা আপডেটেড, বাস্তববাদী ‘বাইট’ আর কোনও বামপন্থী নেতাকে দিতে আমি এই বাংলায় দেখিনি। বামফ্রন্টের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য ও বাস্তববাদী চেয়ারম্যান হতে পারতেন অশোকদা।
ফিরে আসি কনফারেন্সের সময়ের কথায়। তখন সারাদিনে প্রায় ১০-১২ ঘণ্টা অশোকদার সঙ্গে কাটাবার সুযোগ হয়েছিল। রাজনৈতিক, সাংগঠনিক নানা পরামর্শ তো ছিলই। তার ঊর্দ্বে উঠে ভাল মানুষ হয়ে ওঠার ছোট ছোট সেই পরামর্শগুলো, যা আমি সারাজীবন মনে রেখে দিয়েছি।
একবার কিছু পারিবারিক কারণে খুব মানসিক টানাপোড়েনের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। দিল্লি থেকে চলে আসার কথা ভাবছিলাম। বুঝতে পারছিলাম না, কী করা উচিত। তাই এক বিকেলে পার্টি অফিসে অশোকদার সঙ্গে কথা বললাম। সব শুনে বললেন, ‘অরিত্র, আমরা যারা সর্বক্ষণের রাজনৈতিক কর্মী, তাদের জীবনে এই টানাপোড়েন খুবই স্বাভাবিক। আমি যখন পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে গেলাম, তখন বন্ধুরাই আমার খরচ চালাতো। বাড়িতে অবিবাহিত বোন, যার আর বিয়ে হল না কোনওদিন। তাই তোমাকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।’ এই কয়েকটা কথাই অশোকদার বোনের জন্য ভালবাসা, কিছু করতে না পারার কষ্টটা বুঝিয়ে দেয়। বামপন্থী রাজনীতির আদর্শ, নেতাজি সুভাষচন্দ্রের অনুপ্রেরণা, গরিব মানুষের কষ্টের কাছে নিজের ব্যক্তিগত সুখকে জলাঞ্জলি দেওয়া- এগুলো বইয়ে পড়েছি। কিন্তু তা যে সত্যি হতে পারে, এখনও এমন মানুষ যে আছেন, তা বুঝলাম অশোকদার কাছে এসে। আমার কাছে তিনি এক রাজনৈতিক সন্ন্যাসী।
আমার টানাপোড়েন একমুহূর্তে কেটে গেল। আমার বিশ্বাস, এইরকম দুর্লভ মুহূর্ত আরও অনেকের জীবনেই এসেছে। যারা কখনও অশোকদার কাছে যাওয়ার সুযোগ পায়নি, তারা সত্যিই জীবনের অনেক স্মৃতি থেকে বঞ্চিত রইলেন। আশা করি, অশোকদার শততম জন্মদিনেও এই রকম আরও কিছু একান্ত ব্যক্তিগত স্মৃতির কথা আবার লেখার সুযোগ পাব।
খুব ভাল ও সুস্থ থাকুন।
জয় হিন্দ ।।
(লেখক সারা ভারত ছাত্র ব্লকের প্রাক্তন সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক, বর্তমানে চিত্র পরিচালক)