সরল বিশ্বাস
বছর সাতেক আগের কথা। স্থান বিধায়ক আবাস। রুম নম্বর টু বাই থ্রি। সেই ঘরটি বরাদ্দ ছিল নন্দীগ্রামের সিপিআইয়ের বিধায়ক মহম্মদ ইলিয়াসের নামে।
একদিন সেই ঘরে হাজির দুই মূর্তিমান। তাঁদের দাবি, তাঁরা এসেছেন এন জি ও থেকে। তাঁরা বিদেশ থেকে প্রচুর টাকা পাচ্ছেন। নন্দীগ্রাম এলাকায় উন্নয়নের কাজ করতে চান। বিধায়ককে একটি সার্টিফিকেট লিখে দিতে হবে।
বিধায়ক এক কথায় রাজি। বললেন, আমার এলাকায় যদি কাজ হয়, তাহলে তো ভালই। সার্টিফিকেট লিখেও দিলেন। সেই এনজিও কর্মীর বেশে আসা লোকটি জোর করে ইলিয়াসের হাতে দশ হাজার টাকা দিতে চাইলেন। বিধায়ক বললেন, এসব রাখুন। সার্টিফিকেট দিতে টাকা লাগে না।
সেই এন জি ও কর্মী বললেন, আপনাকে সাহায্য করতে হবে। ইলিয়াস ফের বললেন, যা যা সাহায্য করতে হয়, নিশ্চয় করব। এর জন্য টাকা দেওয়ার কী আছে ? আবার টাকা ধরানোর চেষ্টা হল। ফের ফিরিয়ে দিলেন ইলিয়াস। এভাবেই তিন বার টাকা ফিরিয়ে ছিলেন সেই বাম বিধায়ক। পার্টি ফান্ডের নামে দেওয়া হল। তাও নিতে রাজি হলেন না। শেষমেষ কিছুটা জোর করেই হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল।
লুকোনো ক্যামেরা চালু ছিল। সেই ছবিটা উঠল। বোঝা গেল ওই এন জি ও কর্মীদের আসল পরিচয়। তারা আসলে এন ই বাংলার সাংবাদিক। স্টিং অপারেশনে গিয়েছিলেন নন্দীগ্রামের বিধায়কের কাছে। গ্রামের গরীব বিধায়ক। পরপর তিনবার ফিরিয়ে দিয়েছিলেন প্রলোভন। চতুর্থবারে কার্যত জোর করে ধরিয়ে দেওয়া হয় টাকা। তার ব্রেকিং নিউজ চলল সারাদিন ধরে। দুপুর থেকে সন্ধে পর্যন্ত পুরো ভিডিওটাই দেখানো হচ্ছিল। পরে মনে হল, এতে কেসটা দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। তখন আগের অধ্যায়গুলো মুছে দিয়ে শুধু হাতে টাকার ছবিটা দেখানো হল। গলা কাঁপিয়ে বলা হল, এই দেখুন, বিধায়ক টাকা নিচ্ছেন।
সিডি জমা পড়ল বিধানসভায়। একটি সর্বদলীয় কমিটি গড়লেন স্পিকার। সেই কমিটি রায় দিল, ইলিয়াস যখন টাকা নিয়েছেন, তখন তাঁর সদস্যপদ খারিজ করা হোক। বাম বিধায়করাও শাস্তির দাবিতে সায় দিলেন। সেই সুপারিশের উপর ভিত্তি করে বিধায়ক পদ খারিজ হয়েছিল ইলিয়াসের।
সেদিনের সেই এনজিও কর্মীরূপী সাংবাদিক ছিলেন শঙ্কুদেব পন্ডা। রাজনৈতিক মহলের খবর, পূর্ব মেদিনীপুরের এক তৃণমূল নেতার নির্দেশেই সেদিন ইলিয়াসের কাছে গিয়েছিলেন শঙ্কুদেব। একজন সাংবাদিক হিসেবে স্টিং অপারেশন করলে কিছু বলার ছিল না। ত্যাহেলকা থেকে শুরু করে নানা ঘটনায় দেখা গেছে, সাংবাদিকরা লুকিয়ে ছবি তুলছেন, স্টিং অপারেশন করছেন। কিন্তু তাঁরা কোনও দলের বা নেতার এজেন্ট হয়ে যাননি। অভিযোগটা যে মিথ্যে ছিল না, তা বোঝা গেল কয়েক মাস পরেই। যখন সাংবাদিকতা ছেড়ে শঙ্কুদেব সরাসরি ঢুকে পড়লেন তৃণমূলে, হয়ে গেলেন তৃণমূল ছাত্র পরিষদের রাজ্য সভাপতি।
আর কোনওদিন সাংবাদিকতা করতে দেখা যায়নি প্রফেসর শঙ্কুকে। তবে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কাগজের দপ্তরে গিয়ে জ্ঞান বিতরণ অবশ্য করেছেন। সারদা থেকে শুরু করে চালু না হওয়া চ্যানেলে তিনি নাকি লক্ষ লক্ষ টাকা তুলেছেন। সিবিআইয়ের কাছে দাবি করেছেন, তিনি সাংবাদিক।
সেই ইলিয়াস গুরুতর অসুস্থ। চিকিৎসা করানোর সামর্থ্যও নেই। কাগজে একদিন খবর বেরোলো, তাঁকে দেখতে গেছেন শুভেন্দু অধিকারী। পাশে থাকার বার্তা দিয়েছেন। বামপন্থী নেতারা পুরানো কমরেডকে ভুলে গেছে, এই মর্মে কুমিরের কান্না কেঁদে এসেছিলেন। বেচারা ইলিয়াস। কার নির্দেশে শঙ্কু সেদিন তাঁর হাতে জোর করে টাকা গুঁজে দিয়েছিলেন, সম্ভবত আজও জানেন না।
শঙ্কুদেব আসলে কেমন সাংবাদিক, তা সিবিআই কর্তারা জানলেন কিনা, কে জানে! জানেন একজন, যিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করছেন। সিবিআই বরং সেই ফুটেজ দেখুক। দরকার হলে ডাকুক সেই ইলিয়াসকে। জোর করে টাকা গুঁজে দিয়ে ফাঁসানোর সেই ছবি দেখুক। তাহলে তাঁরাও বুঝতে পারবেন, লাখ লাখ টাকা মাইনে পাওয়া সেই লোকটি আসলে কেমন সাংবাদিক ছিলেন।
টিভিতে তৃণমূলপন্থী তার্কিকদের যুক্তি, শঙ্কু নাকি দিকপাল সাংবাদিক। হায় রে! শহ্কু সাংবাদিক! নাহ, আমাদের আর নিজেদের সাংবাদিক বলা উচিত নয়।